ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার- ফুটবলে বিপ্লব ঘটানো জার্মানির “ডার কায়জার”
পোস্টটি ৫০০ বার পঠিত হয়েছেগতকাল কোচ এবং খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার ৭৮ বছর বয়সে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমান। এমন খবরে যেন পুরো ফুটবল বিশ্ব কেঁপে উঠেছে। "ডার কায়জার" (সম্রাট) নামে পরিচিত, তিনি কেবল শুধু জার্মান ফুটবলেই নয়, সামগ্রিকভাবে খেলাধুলার ইতিহাসে একজন আইকনিক ব্যক্তিত্ব হয়েই থাকবেন।
কারণ তিনি শুধু আধুনিক জার্মান ফুটবল পাওয়ার হাউসের স্থপতিই নন, বরং তিনি গোটা বিশ্ব ফুটবলেই বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বেকেনবাউয়ার তার যে লিগ্যাসি রেখে গেছেন তার কিছু নজির দেখে নেয়া যাক-
লিবেরো-
"বল-প্লেয়িং ডিফেন্ডার" শব্দটি আজকাল খুব ভালোভাবেই সকলের কাছে সুপরিচিত। এটি আজকাল এতটাই সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে যে কোনও ডিফেন্ডার যিনি তার পায়ে বল নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না তাকে অবিলম্বে ফুটবলে "হুফ ইট" তকমা দিয়ে দেওয়া হয়।
তবে বেকেনবাউয়ার যখন তার প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তখন তাকে মুদ্রার উল্টো পিঠই দেখতে হয়েছিল। সেই সময়ে ডাইরেক্ট ফুটবলকে আদর্শ মানতেন বড় বড় কোচেরা। তখন জার্মান ফুটবলে দেখা মেলে একজন অসাধারণ মিডফিল্ডারের যিনি নিছক শারীরিকতার মাধ্যমে নয়, বরং তার একক নৈপুণ্যের দক্ষতার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে পারতেন।
বেকেনবাউয়ার একজন মিডফিল্ডার হিসাবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তবে তার দক্ষতা এতটাই কার্যকর ছিল যে তিনি কিছুটা ডিপে নেমে খেলা শুরু করতেন, যা তাকে সময়ের সাথে সাথে খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা দেয়।
বল-প্লেয়িং ডিফেন্ডারদের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে, তিনি ফুটবলে "লিবেরো" রোলের ভূমিকা তৈরি করেছিলেন। তিনি মূলত ডিপেস্ট ডিফেন্ডার হিসেবে খেলা শুরু করতেন, তার কাজ ছিল প্রতিপক্ষের আক্রমণকে রক্ষণের শেষ লাইনে সুইপ করা এবং আক্রমণের প্রথম লাইনে নিজের দলের আক্রমণ শুরু করা।
এখন আসা যাক দায়িত্বের কথায়- "লিবেরো" শব্দটি ইতালীয় থেকে এসেছে যার অর্থ বিনামূল্যে। যদিও এর অর্থ হ'ল এই পজিশনের খেলোয়াড়রা অবস্থানগতভাবে কিছুটা বেশি ফ্রি থাকে। তবে বেকেনবাউয়ারের ক্ষেত্রে এটা ভিন্ন অর্থই বহন করত বলা চলে। তিনি দলের বাকি সদস্যদের থেকে তাদের সেরা খেলাটা বের করে আনতে তাদের পুরো ফ্রি করে দিতেন।
খেলাধুলার জগতে অনেক খেলোয়াড়েরই বেশ ভালোই প্রভাব রয়েছে এবং বিশ্ব তাদের কিংবদন্তি বলে অভিহিত করে। খুব কম লোকই খেলাধুলাকে চিরতরে পরিবর্তন করে এবং বেকেনবাউয়ার তাদের মধ্যে একজন।
ডার কায়জারের লিগ্যাসি-
সম্ভবত ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ারের চেয়ে জার্মান ফুটবলে অন্য কোনও খেলোয়াড়ের সেরকম প্রভাব নেই বলতে গেলে। অবশ্যই, গার্ড মুলার প্রচুর গোল করেছিলেন, এবং বেকেনবাউয়ারের সতীর্থ হিসেবে তিনিও বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলে, তবে ”ডার কায়জার” যে সাফল্যের বীজ স্থাপন করেছিলেন তার ফল পরবর্তী প্রজন্ম বেশ উপভোগ করেছিল।
বেকেনবাউয়ার যে লিগ্যাসি বহন করেছেন তার কিছু নজির কয়েকটা পয়েন্টে একটু দেখে নেওয়া যাক-
° ব্রাজিলের মারিও জাগালো এবং ফ্রান্সের দিদিয়ের দেসচ্যাম্পসের মতো তিনিও খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন।
° আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বকাপ ও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ক্লাব পর্যায়ে ইউরোপিয়ান কাপ জেতা প্রথম অধিনায়ক
° ২০০৪ সালে, তিনি বিশ্বের সেরা জীবিত খেলোয়াড়দের মধ্যে ফিফা ১০০ তালিকাভুক্ত হন।
° ১৯৯৮ সালে বিংশ শতাব্দীর বিশ্বের সেরা একাদশে মনোনীত হন।
° ২০২০ সালে ব্যালন ডি'অরের ড্রিম দলে জায়গা পান।
° প্রথম খেলোয়াড় যিনি তার ক্লাবের অধিনায়ক হিসাবে তিনটি ইউরোপীয় কাপ জিতেছেন।
° একমাত্র ডিফেন্ডার যিনি দুইবার ব্যালন ডি'অর জিতেছে।
তিনি জার্মানি এবং বায়ার্নের একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড় ছিলেন। একইসাথে বায়ার্ন ও জার্মানির একজন কিংবদন্তি ব্যবস্থাপক এবং শেষ পর্যন্ত ক্লাবের সভাপতি হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে জার্মানিতে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য বিডের স্থপতিও তিনিই ছিলেন।
কিছু খেলোয়াড় ট্রফি দিয়ে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার "সম্পূর্ণ" করে, অন্যরা ব্যক্তিগত প্রশংসা জিতে এটি করে। বেকেনবাউয়ার এর সবগুলোই জিতেছেন। হয়তবা এর থেকেও বেশি জিতেছেন.......
ফুটবল বিশ্ব আর কোনও দিন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ারকে দেখতে পাবে না, যিনি একজন ম্যানেজারের পাশাপাশি একজন পরিপূর্ণ খেলোয়াড় এবং একজন নির্বাহী হিসাবে বেশ সাবলীল ছিলেন।
ফুটবল ইতিহাসে তার চেয়ে ভাল খেলোয়াড় থাকতে পারে, ফুটবলে তার চেয়ে ভাল ম্যানেজার রয়েছে এবং অবশ্যই তার চেয়ে বেশি যোগ্য নির্বাহী থাকবে। তবে বেকেনবাউয়ার হ'ল নিখুঁত পেশাদারের মতো নিজের ক্যারিয়ার তৈরিতে এই তিনটি দক্ষতা এবং পেশার সংমিশ্রণের পরিপূরক।
ফুটবল বিশ্ব নিসন্দেহে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ারকে অনেক মিস করবে, কিন্তু সে কখনোই আমাদের মতো ফুটবল ভক্তদের হৃদয় থেকে মুছে যাবেন না। বর্তমান অথবা ভবিষ্যতে যখনই একজন ডিফেন্ডার নিজের হাফ থেকে বল নিয়ে আক্রমণ শুরু করবেন, তখনই ফুটবল বিশ্ব জানতে পারবে এর পিছনের আসল অগ্রদূতকে।
এই ক্ষুদে ফুটবল সমর্থকের ভালোবাসা গ্রহণ করবেন জার্মান সম্রাট ❤️❤️
- 0 মন্তব্য