• ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ
  • " />

     

    বদলে যাওয়া পৃথিবীতেও পৃথ্বীর 'উপভোগের মন্ত্র'

    বদলে যাওয়া পৃথিবীতেও পৃথ্বীর 'উপভোগের মন্ত্র'    


    পাঁচ বছর আগেও পৃথ্বী শ কথা বলছিলেন টেলিভিশনের বুমের সামনে। পায়ে ঠেস দিয়ে রাখা এসজি ব্যাট, কানে ইয়ারফোন, সামনে টেলিভিশন বুম। আর কারও দীর্ঘ ছায়া।

    স্কুল ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন, মুম্বাইয়ের হ্যারিস শিল্ডে। একই টুর্নামেন্টে শচীন টেন্ডুলকার রেকর্ড গড়েছিলেন, বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে ৬৬৪ রানের জুটিতে। আজাদ ময়দানে সেদিন শুধু স্থানীয় সংবাদমাধ্যম না, হাজির হয়েছিল ভারতের জাতীয় মিডিয়াও। পৃথ্বীর দুইদিনব্যাপি চলা রেকর্ড ইনিংসের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল তার আগেই। ভারত তারকা পছন্দ করে, মহাতারকা খুঁজে ফিরে। পৃথ্বীর মাঝেও টেন্ডুলকারকে খুঁজে ফিরছে তখন সংবাদমাধ্যম। তেমনই কেউ প্রশ্নটা তুললেন। 

    “এটা অনেক দূরের ব্যাপার। এখন শুধু এই পর্যায়ে খেলে রান করতে পেরেই আমি খুশি।” 

    পৃথ্বীর বয়স তখন ১৪ বছর হয়েছে মাত্র। 

    **** 

    পৃথ্বী শর গল্পটা বোধহয় খুব বেশি নতুন নয়। এই ১৯ না ছোঁয়া বয়সে সে গল্পের পুরোটা জুড়েই আছে ক্রিকেট। ক্রিকেটের কারণেই তার বাবা তাকে নিয়ে থিতু হয়েছেন মুম্বাইয়ে, বিহার থেকে পৌনে দুই ঘন্টার ভ্রমণ থেকে মুক্তি মিলেছিল তার।  

    স্কুল ক্রিকেট, মুম্বাইয়ের বয়সভিত্তিক দল। ভারতের বয়সভিত্তিক দল। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা অধিনায়ক, তার আগেই রঞ্জিতে অভিষেকের দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি। সেমিফাইনালে তামিলনাড়ুর বিপক্ষে দলে নেওয়া হয়েছিল তাকে, প্রথম ইনিংসে ৪ রানে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ১২০ রান। সে ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল আরেক ওপেনারের, তামিলনাড়ুর গঙ্গা শ্রীধর রাজুর। রাজু এখন পর্যন্ত ওই একটি ম্যাচই খেলেছেন। তার বয়স ২৫ পেরোয়নি এখনও, সামনে সুযোগ পেতেও পারেন। 

    রাজু যদি আর সুযোগ না পান, আর পৃথ্বী যদি হয়ে ওঠেন ভারতের পরের মহাতারকা, তবে নিশ্চিতভাবেই রাজু থাকবেন। হয়তো কোনো কুইজের প্রশ্ন হয়ে। গল্প সবারই থাকে, সব গল্প বলা হয় না। 

    তবে পৃথ্বীর মতো গল্পগুলো উপভোগ্য হয়। পরিশ্রম, নিবেদনে ভরপুর থাকে সেসব। থাকে কাছের কারও আত্মত্যাগ। 

    পৃথ্বী নিশ্চয়ই রঞ্জি অভিষেকেও ভেবেছিলেন, সেই আজাদ ময়দানের ওই ইনিংসের মতোই। মুহুর্ত। উপভোগ। 

    **** 

    ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ দুই টেস্টের দলে নেওয়া হয়েছিল পৃথ্বীকে। শেষ পর্যন্ত খেলা হয়নি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠের সিরিজে শিখর ধাওয়ানের বাদ পড়ার পর এসেছেন দলে। ২০১৬ সালের পর ছয়জনের সমন্বয়ে আটটি ভিন্ন ভিন্ন ওপেনিং জুটি খেলিয়েছে ভারত, ১৮ পেরুনো কোনও ওপেনারের কাছে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা কোনোভাবেই সহজ নয়। তা তিনি যতোই বয়সভিত্তিক দলে শিরোপা জেতেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফুলঝুড়ি ছুটান, আইপিএলে আলো ছড়ান। 

    তবে পৃথ্বী এটাকে সহজ বানিয়ে ফেললেন। অন্তত দেখালো সেরকমই। প্রথম টেস্টের প্রথম দিনই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণকে যেন তাদের দুর্বলতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন পৃথ্বী। পৃথ্বী- যার অভিষেক হয়েছে মাত্র। 

    টেকনিকে তার বেশ কিছু খুঁত ধরা পড়বে, খোলা চোখেই। 

    অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল। জ্যাক এভান্সের বলে বারদুয়েক ব্যাট ছুঁড়েছিলেন, পা না নড়িয়েই। উইল সাদারল্যান্ডের ভেতরের দিকে ঢোকা বলেও করলেন সেটাই। যদি টাইমিং করতে পারতেন, আরেকটা দৃষ্টিনন্দন শট হতো। তবে টাইমিংটা হলো না বলে, আউটের ধরনটা চোখের জন্য শান্তিদায়ক হলো না মোটেও। 

    এখন পর্যন্ত পৃথ্বীর খেলাটা তেমনই। এমন একজন, যিনি নিজের খেলাটা জানেন। বয়স অল্প হতে পারে, তবে খুব অল্পদিন ধরে তো আর ক্রিকেট খেলছেন না তিনি! শচীন টেন্ডুলকার বা রাহুল দ্রাবিড়ের কাছ থেকেও পৃথ্বী পরামর্শ পেয়েছিলেন এমনই। যতক্ষণ রান করতে পারছেন, টেকনিকের দিকে তাকানোর দরকার নেই। 

    সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরি করার আগ-পর্যন্ত পৃথ্বী আক্রমণাত্মক শটই খেলেছিলেন ৫৪ শতাংশ। মাইলফলকের পর সেটা নেমে এলো ৪৩ শতাংশে, খেলে আসতে চেয়েছিলেন আরও কিছুক্ষণ। আউট হওয়ার পর হতাশ হয়েছিলেন তাই স্বাভাবিকভাবেই। 

    রাজকোট থেকে হায়দরাবাদ। ব্যাটিংয়ের ধরনটা থাকলো একই। 

    সেঞ্চুরি দিয়ে আগমণী বার্তা দিয়েছিলেন, পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসে শুরু করলেন সেখান থেকেই। সেই আক্রমণ, সেই আগ্রাসন। এমন একজন ব্যাটসম্যান, যিনি নিজের খেলাটা জানেন। যেন টেস্ট ক্রিকেটে তিনি নতুন নন, যেন মঞ্চটা পরিচিত তার। 

    ফল- অভিষেকেই সিরিজসেরা। ক্রিকেট ইতিহাসেই কুড়ি বছরের আগে সিরিজসেরা হয়েছিলেন চারজন। ওয়াকার ইউনুস, এনামুল হক জুনিয়র, মোহাম্মদ আমির ও মেহেদি হাসান মিরাজ। 

    **** 

    আজাদ ময়দানের সেই ইনিংসের পাঁচ বছর পর আবার টেলিভিশন বুমের সামনে পৃথ্বী। এই পাঁচ বছরে কথা বলেছেন অসংখ্যবার। টেস্ট অভিষেকের পরও কথা বলেছেন বেশ কয়েকবার, সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের ভাষায়, ছয়-সাতবার। 

    তবে এবার টেস্টের প্রথম দানেই বাজিমাত করার পর কথা বলতে এলেন। 

    “এটা আমার জন্য দারুণ একটা মুহুর্ত, ভারতের জন্য ম্যাচ শেষ করতে পারাটা। এটা গর্বের…..

    …..আমি জানি না, এরপর কী হবে। আমি শুধু এই মুহুর্তটা উপভোগ করছি।”

    রবি শাস্ত্রী এরপর এসে বললেন, পৃথ্বী কখনও শচীনের মতো, ব্যাটিংয়ে কিছুটা বীরেন্দর শেওয়াগের মতো। আবার চলন-বলনে ব্রায়ান লারার মতো। শাস্ত্রী কিছুটা বাড়িয়ে বলতে পারেন, অথবা দৃঢ় বিশ্বাস থেকে বলতে পারেন। শাস্ত্রী যেটাই বলুন, পৃথ্বীর সামনে এখনও অনেকটা পথ। 

    তবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে পৃথ্বীর পৃথিবীটা বদলে গেছে অনেকভাবেই। সামনে অপেক্ষা করছে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ। সিমিং কন্ডিশন, সুইংয়ের বিষ, স্পিনের জাল- চ্যালেঞ্জের তো অভাব নেই। শচীনরা শচীন হয়ে ওঠেন এমন সব চ্যালেঞ্জ সামলে নিয়েই। পৃথ্বীরও শর্টকার্ট নেই। 

    অবশ্য এখনকার মতো যদি উপভোগ করে যেতে পারেন, তবে নিশ্চিতভাবেই, পৃথ্বীর পৃথিবীটা বদলাবে আরও।