সৌম্য এলেন, দেখলেন, আর জয় করলেন
এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
শুধু খেলায় নয়, কথাটা আরও অনেক কিছুতেই অতিব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে। তবে সৌম্য সরকারের জন্য সেটি আজ একদমই বাড়িয়ে বলা হবে না। হুট করে ডাক পেয়ে দলে এসেছেন মাত্র এক দিন আগে। ম্যাচের আগের দিন অনুশীলন করেছেন, ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের’ মতো কে জানত পরের দিনই এভাবে নেমে পড়তে হবে মাঠে? সৌম্য সরকারের আসা আর দেখাটা হয়ে ছিল, শুধু বাকি ছিল জয় করাটা। সেটা এমনভাবে করলেন, এর চেয়ে রাজসিক আর হতে পারত না তা!
সৌম্যের জন্য কাজটা আরও কঠিন অন্য অর্থে। ধরতে গেলে গত এশিয়া কাপ থেকেই একরকম ক্রিকেট-পরিব্রাজক হয়ে গেছেন। খুলনা থেকে উড়ে গেছেন দুবাই, এরপর আবু ধাবিতে ম্যাচ। তার পর দেশে ফিরেই খেলতে হয়েছে জাতীয় লিগে, রাজশাহী থেকে খুলনা। এর মধ্যে বিকেএসপিতে প্রস্তুতি ম্যাচে খেলতে হলো এক দিনের নোটিশে, সেখানে পেলেন সেঞ্চুরি। আবার ছুটতে হলো খুলনায়, সেখান থেকে জানতে পারলেন সুযোগ পেয়েছেন ওয়ানডে দলে। মজা করে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ব্যাগটা কি গোছানোই থাকে তাঁর?’ সৌম্যও হাসতে হাসতে বললেন, এখান থেকে আবার যেতে হবে বরিশাল, সেখানে জাতীয় লিগের ম্যাচ।
কাজটা এই ভ্রমণক্লান্তির জন্যই আরও কঠিন হওয়ার কথা ছিল আজ। গত বেশ কিছুদিন ধরে একটু তিষ্টানোর উপায় নেই, আজ এখানে তো কাল ওখানে। এই অবস্থায় দলে ডাক পেলেন, একটা ম্যাচে হঠাৎ করে সুযোগ পাওয়ায় উঠতে পারত নানা প্রশ্ন। গত কিছুদিনে ফর্মটা ভালো যাচ্ছিল, বিকেএসপির সেঞ্চুরির আগে পরে জাতীয় লিগে তিনটি ফিফটি আর সেঞ্চুরি। কিন্তু ঘরোয়া লিগে তো কতজনই রান করেন, জাতীয় দলে এলে এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। দেশের মাটিতে তিন বছর ধরে কোনো ফিফটি নেই, সৌম্যর ওপর তো চাপ ছিল ভীষণ।
সেই কঠিনেরেই সৌম্য এমনভাবে ভালোবাসবেন, কে জানত? প্রথম বল থেকেই মনে হয়েছে, আজ দিনটা তাঁর। শুরুতে একবার স্ল্যাশ করতে গিয়ে একটুর জন্য ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন, আর একবার কানায় লেগে চার হলো। তা ছাড়া সৌম্যের প্রতিটি শটে যেন টাইম মেশিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিন বছর আগের সেই দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচে। এই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেই সেদিন সৌম্য দেখিয়েছিলেন, ফর্মে থাকলে তাঁর ব্যাটিংয়ের চেয়ে দৃষ্টিসুখকর কিছু কমই আছে। সেবার ৯০ রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন, এবার আর সেই ভুল করেননি। ৫০ থেকে ১০০ পর্যন্ত করতে খেলেছেন মাত্র ২৭ বল, বোঝাই যাচ্ছিল সৌম্য কতটা ভয়ডরহীন ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে পরে নিজেও বলেছেন, ‘আজ আসলেই আমার কোন কিছু ছিল না। আমি চিন্তা করেছি, আজ যদি খারাপ খেলি হয়তো খারাপই হবে। খারাপই যাচ্ছিলো, আজও যেতে পারত। ওই জিনিস নিয়ে ভাবি নি, খারাপ যাচ্ছে, আরেকটা ম্যাচ যাবে, এইতো, সমস্যা নেই। আরও কিছু কথা বাড়বে, সমস্যা কী আর হবে। চিন্তা করেছি নিজে নিজের খেলাটা খেলব, ভাল হলে বাহবা দিবে, খারাপ হলে সবাই খারাপ বলবে। ’
সেই নিজের মতো খেলাটা এর চেয়ে ভালো কমই হতে পারত। ডাউন দ্য উইকেটে এসে যে শটটা খেলতে পছন্দ করেন, সেটা খেলতে গিয়েই গত দুই বছরে আউট হয়েছেন বেশ কয়েকবার। সেই শটগুলো আজ কী অনায়াসেই না খেললেন! প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে বলে হয়তো অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু ২০১৫ সালে এই জিম্বাবুয়ের সঙ্গেই রান পাননি। দেশের মাটিতে আরও অনেক ম্যাচ খেলেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। আজ জবাব দিলেন সবকিছুর।
তারপরও কি একটু আক্ষেপ নেই, আগের দুই ম্যাচে সুযোগ পেলে আরও ভালো কিছু করতে পারতেন? সৌম্যও স্বীকার করলেন, ‘এটা মনে হয়েছে যেদিন আমি অনুশীলন ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলাম। দিন শেষ খেলার পর যখন খুলনা ফিরছিলাম, তখন এই চিন্তা এসেছিল। তিনটা ম্যাচ যদি খেলার সুযোগ পেতাম, তাহলে নিজেকে মেলে ধরার, প্রমাণ করার একটা ভাল সুযোগ পেতাম। এমন একটু মনে হয়েছিল। তবে শেষ ম্যাচ যখন ডাক পড়ল, তখন খুশি হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, না, একটা সুযোগ এসেছে, দেখি কাজে লাগাতে পারি কিনা।’
সেই সুযোগ এমনভাবেই কাজে লাগালেন, সৌম্যর সামনে খুলে গেল আরও অনেক সুযোগের স্বপ্নদুয়ার।