• " />

     

    আটলান্টিকের অন্যপারে ক্রিকেট বিপ্লব!

    আটলান্টিকের অন্যপারে ক্রিকেট বিপ্লব!    


    একটি দৃশ্য কল্পনা করুন। ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের রাস্তায় শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম অথবা সাকিব আল হাসান হেঁটে যাচ্ছেন! তারা কখনোই হয়তো সেই কাজটা নিজেদের দেশে করতে পারেন না, পারেননি! কিন্তু আমেরিকার রাস্তায় টেন্ডুলকার, ওয়ার্ন, আকরামরা যদি কখনো হেঁটে যান তাহলে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ হয়তো তাদের দেখে চিনবেও না, কিন্তু বাকি ৫ ভাগ মানুষ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে আকাশের তারা দেখবার মতো চমকে উঠবে! বলাই বাহুল্য, সেই ৫ ভাগ মানুষই উপমহাদেশীয় অথবা ক্রিকেট পাগল জাতির মানুষ।



    আমেরিকানরা কিভাবে ক্রিকেটকে দেখে তার একটা চমৎকার বর্ণনা ওয়ার্ন দিয়েছেন। তাঁর মতে, “আমেরিকানদের ধারণা ক্রিকেট হচ্ছে পাঁচদিনের একটি খেলা যেটা শেষ পর্যন্ত ড্র হয়! ভাবতেই ঘুম চলে আসে”। ওয়ার্ন তা-ই বলেন, “ফাস্ট আমেরিকানদের ফাস্ট আকর্ষণ করতে আমরা ক্রিকেটের আরেক ভার্শন টি-টুয়েন্টিকে বেছে নিয়েছি। এখানে প্রতি মুহূর্তই উত্তেজনা, প্রতি বলই মহামূল্যবান”।



    মজার ব্যাপার, ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম যে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ম্যাচটির খোঁজ পাওয়া যায় সেটি কিন্তু ১৮৪৪ সালে নিউ ইয়র্কে হয়েছিল। আমেরিকানদের প্রিয় খেলা যে বেসবল, এটাকেও কিন্তু ক্রিকেটেরই একটা মিনি ভার্সন বলা চলে। বেসবলের ইতিহাসেও লেখা আছে যে, এই খেলাটির ব্যুৎপত্তি ক্রিকেট থেকেই। আর বিশ্বের সেরা তিনটি বেসবল মাঠের একটি হচ্ছে নিউ ইয়র্কের সিটি ফিল্ড! এবং মাত্রই গত সপ্তাহে “নিউ ইয়র্ক মেটস” বেসবলের ওয়ার্ল্ড সিরিজে রানার্স আপ হয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদ-ম্যানইউর কাছে বার্নাব্যু-ওল্ড ট্র্যাফোর্ড যা, মেটসের কাছে সিটিফিল্ড ঠিক তা-ই!

     

    ঠিক গত সপ্তাহের রবিবারই ওয়ার্ন আর টেন্ডুলকার মেটসের ম্যাচ দেখতে সিটিফিল্ডে উপস্থিত ছিলেন। “ক্রিকেট অল স্টারস” এর ম্যাচের প্রচারণা করতে, ক্রিকেটকে ঠিকভাবে বোঝাতে তারা সেখানে বক্তব্যও দিয়েছেন। মানুষকে ক্রিকেট খেলাটা কিছুটা বোঝানোরও চেষ্টা করেছেন। ওয়ার্ন “নিউ ইয়র্ক মেটস”-কে তার প্রিয় বেসবল দল বলে ঘোষণা করেছেন। নিজেরা আমেরিকায় জন্মালে যে তারাও বেসবলের সেরা তারকা হতেন সেটাও ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, “টেন্ডুলকার বেসবল খেলোয়াড় হলে ঠিক তা-ই অর্জন করতেন যা তিনি ক্রিকেটার হিসেবে অর্জন করেছেন। আর আমি ‘পিচার’ হিসেবে ঠিকঠাক-ই করতাম!” (বেসবলে যে বল ছুঁড়ে তাকে পিচার বলা হয়।)


    প্রচারণার জন্য ওয়ার্ন আর টেন্ডুলকারের চেষ্টা ঠিকই লক্ষ্যণীয়। কিন্তু মানুষের কাছে এই খেলাটি পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে বড় কাজটি করতে হয় মিডিয়াকে। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে এখন পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক পত্রিকা অথবা টিভিগুলো ঠিক সেভাবে এই মহাতারকাদের ম্যাচটিকে প্রচার করছে না। নিউ ইয়র্ক টাইমসে চারদিন আগে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এছাড়া ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ অথবা অন্যান্য পত্রিকাগুলোতে সেরকম কোন রিপোর্টই আসেনি।

     

    টিভি চ্যানেলগুলোও আশ্চর্যজনকভাবে উদাসীন। 'নিউইয়র্ক ওয়ান'-এর নিউজে ছোট করে একবার বলা হয়েছে কেবল ম্যাচটির কথা! ব্যস এতটুকুই! মূলত ‘আমেরিকানদের’ আকর্ষণ করার জন্য যে তুমুল প্রচারণার দরকার, সেটি আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। এমনকি ‘টিম ড্র’ এর পরে যে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন হলো সেখানে যেসব সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন তারা প্রায় সবাই ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সাংবাদিক। অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক যেসব বাংলা, হিন্দী, উর্দু পত্রিকা-টিভি চ্যানেল আছে সেসব চ্যানেলের সাংবাদিকেরাই মূলত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করেছেন। হয়তো প্রথমবার বলে আয়োজকেরা ক্রিকেটের সাথে পরিচিতদেরই আকর্ষণ করতে চাইছেন। সে জায়গাটাতে তারা খুব ভালোভাবেই সফল।

     

    নিউইয়র্কে যারা নিয়মিত ক্রিকেট দেখে, স্থানীয়ভাবে ক্রিকেট খেলে তারা সবাই গত একমাস ধরে এই ম্যাচটির জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। মূলত উপমহাদেশীয় মানুষ আর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরাই এই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। সবাই খুব আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্তও স্টেডিয়ামের অর্ধেক টিকেট বিক্রি বাকি!

     

    আবার এখানে একটা বড় সমস্যা টিকেটের দাম। ন্যূনতম ৫০ ডলার থেকে ১৭৫ ডলার পর্যন্ত টিকেটের দাম আছে। কয়েকজনের সাথেই কথা বলে জেনেছি যে তারা খেলা দেখতে যেতে চায়, কিন্তু ৬০ ডলারের যে টিকেট সেটা অনেক দূরের; তাই সেটা না কিনে টিভিতে দেখা একই কথা । আর মাঠের কাছের দিকের টিকেটগুলো ন্যূনতম ১৬০ ডলার থেকে শুরু হচ্ছে, যেটা শুধু উইকএন্ডে কাজ করা ছাত্রদের কাছে আর শ্রমজীবী মানুষদের কাছে বেশি মনে হচ্ছে। তবু ক্রিকেটের ক্রেজ কি থামানো যায়? শেষ দুইদিন ধরে বিশেষ করে “দেশী কমিউনিটিতে”- জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকাতে যেকোন আড্ডায় এই ম্যাচটির গল্পই সবচেয়ে হটকেক হওয়ায় টিকেট বিক্রি বাড়ছে! কে জানে, ক্রিকেটের অদ্ভুত মাদকতা হয়তো ম্যাচটিকে শেষ পর্যন্ত গ্যালারি ভরা জমজমাট ম্যাচে পরিণত করবে!

    'ক্রিকেট অল-স্টারস' ম্যাচের টিকেট

     

    এবারে দেখা যাক, বেসবলের “সিটি ফিল্ডকে” কিভাবে ক্রিকেট মাঠে পরিণত করা হচ্ছে। মাঠের আকৃতি ছোট, যেটা টি-টুয়েন্টির জন্য মানানসই। ওয়াসিম আকরাম হাসতে হাসতে বলেছেন যে, এতো ছোট মাঠে খেলাটা তিনি পছন্দ করেন না। তবে মাঠের মাঝে ক্রিকেট পিচ বসানোর জন্য ইন্ডিয়ানা রাজ্য থেকে ২২ গজ লম্বা আর ১০ গজ চওড়া পলিমাটির পিচ তৈরি করে আনা হয়েছে। যেটি মাঠের মাঝখানে আট ইঞ্চি গভীর গর্ত করে সরাসরি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পিচের চারপাশে শক্ত প্রলেপও দেয়া হয়েছে যেন ফিল্ডারদের সমস্যা না হয়। মোটকথা একটি আদর্শ ক্রিকেট পিচ তৈরির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করা হচ্ছে।

     

    সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, আশি আর নব্বইয়ের দশক থেকে আসা এতোজন মহাতারকাকে একসাথে করবার চ্যালেঞ্জটা ওয়ার্ন আর টেন্ডুলকার কিভাবে নিলেন। জবাবে টেন্ডুলকার বলেছেন, “ওটাই সবচেয়ে সহজ কাজ ছিল! তিনি যখন খেলাটিকে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিতে চান বলে বন্ধুদের ফোন করেন। তখন সবাই একবাক্যে তাতে রাজি হয়ে যান। উলটো এটা বলেন যে, এমন একটি আইডিয়া আসতে এতো দেরি হলো কেন?” খেলাটি এখানে আয়োজন করার অন্যান্য দিকগুলো তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

     

    এবারে আসা যাক দল কিভাবে নির্বাচন হলো সে ব্যাপারে। ওয়ার্ন আর টেন্ডুলকার প্রতি দুইজন থেকে লটারির মধ্যে একজন করে বেছে নিয়েছেন। যেমন, লারা আর পন্টিং এই দুজনের মধ্যে একজনকে ওয়ার্ন পাবেন; আরেকজন টেন্ডুলকার। লটারিতে লারা টেন্ডুলকারের দলে পড়েছেন, আর পন্টিং পড়েছেন ওয়ার্নের দলে। আবার ওয়ালশ-অ্যামব্রোস একসাথে এসেছেন। এই দুইজনের মধ্যে অ্যামব্রোস পড়েছেন টেন্ডুলকারের দলে, ওয়ার্ন পেয়েছেন ওয়ালশকে। সাকলাইন আর মুরালি এসেছেন একসাথে। মুরালি পড়েছেন টেন্ডুলকারের দলে আর ওয়ার্ন পেয়েছেন সাকলাইনকে। এভাবে জোড়ায় জোড়ায় ত্রিশজন খেলোয়াড় পনেরো-পনেরো করে দুই দলে ভাগ হয়েছেন।

     

    দল নির্বাচন শেষ, সবাই প্রস্তুত খেলা শুরু করবার জন্যে। গত পঁচিশ বছরে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরারা সবাই খেলছেন এই এক ম্যাচে। টেন্ডুলকার বলেছেন, “আমরা মাঠে এখনো একে অপরের শত্রু। কিন্তু মাঠের বাইরে সবাই বন্ধু! এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই সিরিজ”। খেলাধুলার সবচেয়ে বড় মেসেজটাও এটা। দেশে দেশে ভ্রাতৃত্ব আর বন্ধুত্ব গড়ে তোলার কাজটা খেলোয়াড়েরা করেন। এতো বছর পরেও সব খেলোয়ারদের এই ধরনের বন্ধুত্ববোধ সেটিই মনে করাচ্ছে। ওয়ার্ন যেমন বলেছেন, “মনে হচ্ছে অনেকদিন পরে ভাঙা একটি ব্যান্ড জোড়া লাগছে! সবাই মিলে আবার ব্যান্ড বাজাতে মুখিয়ে আছি!”

     

    হ্যাঁ, আমরা দর্শকেরাও মুখিয়ে আছি। ইতিহাস সেরা ক্রিকেটারদের আবার দেখবার যে তুমুল উত্তেজনা সেটি সব রসের আস্বাদন নিয়ে হাজির হবে আমাদের সামনে। জমজমাট এক ম্যাচের প্রত্যাশায় আমরা সবাই। আর ক্রিকেটের বিশ্বায়ন? ফুটবল আমেরিকায় আস্তানা গড়বার চেষ্টা করেছে অনেক বছর ধরেই। ফিফা যখনই আমেরিকার অর্থকরী আর মিডিয়ার গুরুত্ব ধরতে পেরেছে তখন থেকেই চেষ্টা করে আসছে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ তারা আয়োজন করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রে। ডেভিড বেকহ্যাম মেজর সকার লীগে যোগ দিয়েছিলেন আমেরিকায় তাঁর 'স্টারডম'-এর মাধ্যমে ফুটবলকে ছড়িয়ে দিবেন বলে। খুব বেশি পর্যায়ে না হলেও আমেরিকায় ফুটবলের একটা চল তো শুরু করা গেছে। আমেরিকা প্রতিবারই ফুটবল বিশ্বকাপ খেলে। ওয়ার্ন বলেছেন, তারা যদি ঠিকভাবে ক্রিকেটটাকে ছড়িয়ে দিতে পারেন তাহলে স্বপ্নটা ক্রিকেট বিশ্বকাপে আমেরিকার অন্তর্ভুক্তির। সেটা করতে পারলে ক্রিকেটটা অনেকটাই এগুবে।

     

    টেন্ডুলকার আর আকরাম সাক্ষাৎকারে বারবার বলেছেন, ক্রিকেটের অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। সেটি করতে পারলে আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ পাবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়ামঞ্চে নিজের দেশের জন্য পদক জয়ের বাসনা যদি সৃষ্টি করা যায় তাহলে আমেরিকানরা নিজ থেকেই এই খেলায় আকর্ষিত হবে! মোটকথা ক্রিকেটকে কিভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় আটলান্টিকের অন্য পাড়ে সেটা নিয়ে ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ দূতদের নানামুখী পরিকল্পনা আছে। সেটা কতটুকু সফল হবে তার উত্তরটা সময়ের কাছেই তোলা থাকুক। আইসিসির সহযোগিতা আর এই মহাতারকাদের সমন্বয়ের আলোচনাটাও আরেকদিনের জন্য তোলা থাকুক। আপাতত কিছু স্বপ্নদৃশ্যের বাস্তবে আসার অপেক্ষাতেই আমরা রোমাঞ্চিত হই।

     

    লারা আর টেন্ডুলকার কোনদিন একসাথে ব্যাটিং করেননি। এবার সেটি দেখবার অপেক্ষাতে থাকি। ম্যাকগ্রা আর অ্যামব্রোস যখন একদিকে বোলিং ওপেন করবেন তখন অন্যদিকে থাকবেন আকরাম আর ওয়ালশ। আকরাম বনাম টেন্ডুলকার, লারা বনাম ডোনাল্ডের দ্বৈরথ আবার দেখা যাবে। দেখা যাবে, কখনোই না পাওয়া কিছু দ্বৈরথ যেখানে ওয়ালশ বল করবেন লারাকে, ম্যাকগ্রাথ বল করবেন পন্টিংকে! আপাতত স্বপ্নের, স্বর্গের সেই দ্বৈরথ দেখবার রোমাঞ্চ আর অপেক্ষা!