ক্রিকেটের সাদা হাতিদের গল্প
ক্রিকেটে লেগ স্পিনারদের এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা গত এক-দেড় বছর ধরেই অনুমান করছি। বেশ কিছু খুব ভালো লেগ স্পিনার এসেছে সব দলেই। ডোপপাপী ইয়াসির শাহ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিলেন। তাঁর র্যাংকিংও সে-ই কথাই বলে। ওয়ার্নের কাছে দীক্ষা নেয়া ইয়াসিরের হাতে লেগ স্পিনের সব তূণই আছে। আরব আমিরাতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে গত বছরের সিরিজেই দেখিয়েছিলেন, কেন তাঁকে এই সময়ের সেরা লেগ স্পিনারদের একজন বলা হয়।
এই তালিকায় আছেন ভারতের অমিত মিশ্র-ও। অসাধারণ ফ্লিপার দেন। সাথে বোলিংয়েও থাকে পরিকল্পনার ছাপ। টেস্টে একজন লেগ স্পিনারের কাজই হলো ব্যাটসম্যানকে খেলানো। একটা উদাহরণ দিই, গতবছর নভেম্বরে ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজের তৃতীয় টেস্টের এক ইনিংসে ফাফ ডু প্লেসিসকে তিনি খেলিয়ে খেলিয়ে বোল্ড করেছিলেন। ঘটনা ছিল, মিশ্র'র প্রত্যেকটা বল ফ্রন্টফুটে এসে ব্লক করে যাচ্ছিলেন ফাফ। তখন মিশ্র ইচ্ছে করেই দুইটা হাফ ভলি, শর্টপিচ বল দিলেন, যেন ফাফ ব্যাকফুটে যায় এবং আক্রমণাত্মক মানসিকতা আনে। ফাফও ব্যাকফুটে গিয়ে দুইটা ড্রাইভ করে চার মারলেন। এরপরের বলে মিশ্র আবার বলকে সামনে পিচ করালেন। এবারে আক্রমণাত্মক মানসিকতার ফাফ ফ্রন্টফুটে এসে ড্রাইভ করতে গিয়ে বলের ফ্লাইট মিস করে বোল্ড! লেগ স্পিন বোলিংয়ের কী অসাধারণ প্রদর্শনী!
এই কাজটা সবচেয়ে ভালো করতেন শেন ওয়ার্ন। তাঁর পরিকল্পনাই থাকতো যে, ১০ বল পরে সে ব্যাটসম্যানকে কিভাবে আউট করবে। সেইমতো ব্যাটসম্যানকে তিনি ১০ বল ধরে সেট আপ করতেন! বোলিং রোমান্টিকদের জন্য লেগ স্পিনারদের চেয়ে আনন্দদায়ী কেউ নেই। এমনিতেই তো স্যার ডন ব্র্যাডম্যান বলে যাননি যে, ক্রিকেটের সবচেয়ে ক্ল্যাসিক লড়াই হলো একজন ভালো লেগ স্পিনারের সাথে টেকনিক্যালি শুদ্ধ একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যানের লড়াই! এজন্যেই হয়তো টেন্ডুলকার-ওয়ার্নের লড়াই এতোটা রোমান্টিক ছিল!
যাই হোক, আরেকজন আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দেবেন্দ্র বিশু। বল টেনে দেন, সাথে দুর্দান্ত কন্ট্রোল। ফ্লাইটগুলো বোঝা যেকোন ক্ল্যাসিক ব্যাটসম্যানের পক্ষেও কষ্টকর। ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই স্যামুয়েল বদ্রি আরেকজন কন্ট্রোল্ড লেগি! একজন লেগ স্পিনার টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ে এক নাম্বার স্থান অধিকার করে আছে, এটা বাংলাদেশি নির্বাচক-টিম ম্যানেজম্যান্টকে র্যাংকিং তালিকা খুলে দেখিয়ে না দিলে হয়তো বিশ্বাসই করবেন না।
ইংল্যান্ডের আদিল রশিদও ভালোই করছেন, সামনে অবশ্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁকে। দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির-ও অনেকদিন ধরেই দলের এক নাম্বার স্পিনারের দায়িত্ব পালন করছে। তাহিরের সবচেয়ে বড় গুণ ব্যাটসম্যান পড়তে পারা। ব্যাটসম্যানের পায়ের 'মুভমেন্ট' দেখে শেষ মুহূর্তে বলের কারিকুরি পরিবর্তন করতে পারেন তাহির।
আজকে অসি-কিউই শেষ ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়া নতুন একজন লেগ স্পিনার নিয়ে খেলতে নেমেছে। নাম অ্যাডাম জাম্পা। গুগলি মাস্টার। ক্রিকইনফো'র ওয়েবসাইটে জাম্পার প্রোফাইলে তাঁর বোলিং স্টাইলকে "লেগ ব্রেক" না বলে "লেগ ব্রেক গুগলি" বলছে! আজ নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ১০ ওভার বোলিং করে ৪৫ রান দিয়ে ১ উইকেট নিয়েছেন জাম্পা। সমস্যা একটাই, অতিরিক্ত গুগলি দেবার চেষ্টা করেন তিনি। খুব যে কাজ হয়েছে তাও কিন্তু না। গুগলি হবে 'সারপ্রাইজড' জিনিস। তবে মাত্রই প্রথম ম্যাচ খেলতে নামলেন জাম্পা। দেখা যাক, সামনের দিনগুলোতে কি হয়!
সময়ের সাথে শাণিত হবার কথা বলতে গিয়ে তাঁর কথা বলি, যার জন্য আসলে লেখাটায় হাত দেয়া। তিনি হলেন ইশ সোধি! অনেকদিন ধরেই শুনছিলাম যে, কিউই দলে বোলিংয়ে ভেট্টোরির অভাব পূরণ করবেন সোধি। আজকের বোলিং ফিগার দেখতে খুব আহামরিও নয়। ৮ ওভারে ৩১ রানে ২ উইকেট। তাতেই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ। কিন্তু একটা কথা বলতে চাই, ওয়ানডেতে এমন অসাধারণ লেগ স্পিনের প্রদর্শনী অনেকদিন দেখিনি আমি! ফ্লাইট, টার্ন, বলকে লাফিয়ে ওঠানো- আজকে সোধির বোলিংয়ে সব ছিল। মাঝখানে এক ওভারে বেইলিকে নাচিয়ে ছেড়েছেন। ধারাভাষ্যকার পর্যন্ত বলছিলেন যে, ম্যাককালাম কেন 'সিলি মিড অন' রাখছেন না? চিন্তা করে দেখেন, বোলিং কী পর্যায়ের হলে একজন অভিজ্ঞ ধারাভাষ্যকার মাত্র ২৪৬ রান চেজ করা দলের বিপক্ষে সিলি মিড অন, স্লিপ ফিল্ডার দিয়ে অ্যাটাক করার কথা বলে; যখন চেজ করা দলটির অবস্থা খুব একটা খারাপ না!
সবার কথা বলেছি। একজনের নাম নিইনি। লেগ স্পিনারদেড় বলা হয় 'সাদা হাতি'। জুবায়ের হোসেন লিখন আমাদের সাদা হাতি। সব দল টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টুয়েন্টিতে তাদের সাদা হাতিদের পূর্ণোদ্যমে ব্যবহার করছে। আর আমাদের হাতি বসে আছেন। জাতীয় দলে তো না-ই, আমাদের ঘরোয়া লীগেও তাকে আমরা সুযোগ দিতে পারি না। ইয়াসির শাহ বিপিএল-এ ৮ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, বদ্রি সারা বিশ্বে সব লীগ দাপিয়ে বেড়ান। আমাদের লিখন কোথাও সুযোগ পাননা। অথচ আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, অ্যাডাম জাম্পা-র চেয়ে লিখন ভালো গুগলি পারেন। তাঁর ফ্লাইটগুলো সোধির চেয়েও ভালো। কিন্তু ও-ই প্রথমেই বলেছি যে, লেগ স্পিনারদের পরিকল্পনা করে বল করতে হয়। সেই পরিকল্পনার অনুশীলনটা হয় লীগের খেলায়। খেলার সুযোগ না পেলে প্ল্যান করা শিখবেন কোথায় তিনি? কন্ট্রোল আনবেন কিভাবে? লিখন আপাতত আমার কাছে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ! নিদেনপক্ষে, তাঁকে কাউন্টিতে সেকেন্ড ডিভিশনে হলেও পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায় না?
যাই হোক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সাদা হাতিদের সম্ভাবনায় ভরে উঠছে। অন্তত আগামী দশ বছর যেনো এদেরকে ক্রিকেটে উদ্ভাসিত হতে দেখি, ক্রিকেটকে রাঙাতে দেখি। সাদা হাতিদের জন্য শুভকামনা।