অনুপ্রেরণার দীপশিখা হানিফ মোহাম্মদ
১৯৫৮ এর পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ ক্রিকেটের সর্বকালের দুই গ্রেটের আবির্ভাবের গল্প! হানিফ মোহাম্মদ আর গ্রেটেস্ট স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের বিশ্বমঞ্চে নিজেদের জানান দেবার গল্প।
প্রথম টেস্টের কথা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে স্বাগতিকরা ৫৭৯ রান করে ডিক্লেয়ার দেয়। পাকিস্তান অল আউট হয়ে যায় ১০৬ রানে! ছয়দিনের ম্যাচে রয় গিলক্রিস্ট, অ্যাটকিনসন ভ্রাতৃদ্বয়, আলফ ভ্যালেন্টাইনদের নিয়ে গড়া বোলিংয়ের সামনে ছোটখাটো ভদ্রলোক হানিফ দাঁড়িয়ে গেলেন। তখনকার যুগে চেস্ট গার্ড, আর্ম গার্ড, হেলমেট ইত্যাদি কিছুই ছিল না। কেবল একটা প্যাড পড়ে ব্যাট হাতে নিয়ে উন্মত্ত বোলিংয়ের বিপক্ষে নামতে হতো ব্যাটসম্যানদের।
তৃতীয় দিনের শুরুতে হানিফ দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং এ নামেন। ৬ষ্ঠ দিনের শেষভাগে যখন আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন ততক্ষণে ৩৩৭ রান করে ফেলেছেন, ব্যাটিং করেছেন বিশ্বরেকর্ড ৯৭০ মিনিট! হানিফ থাই গার্ড হিসেবে দুই পায়ে তোয়ালে জড়িয়ে ব্যাটিং করছিলেন! তোয়ালে খোলার পর দেখা গেছে তার পা জুড়ে ছোপ ছোপ হলুদ দাগ!
এই এক ইনিংস নিয়ে কত গল্প, কত কিংবদন্তী! চতুর্থ দিনে মাঠের পাশে গাছে বসে এক ছেলে হানিফের ব্যাটিং দেখছিলো এক ছেলে। সে হঠাৎই গাছ থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। দুইদিন পরে যখন সে জ্ঞান ফিরে পায় তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, হানিফ কি এখনও ব্যাটিং করছেন? অবিশ্বাস্যই বটে, হানিফ তখনো ব্যাটিং করছিলেন।
ব্যাটিংয়ের শুরুর দুইদিন হানিফ শুধু বল বুঝে গিয়েছেন। রয় গিলগ্রিস্ট তখন তাঁকে বাউন্সার দিয়ে যাচ্ছে। ইনিংসের মাঝপথে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রেট ক্লাইড ওয়ালকট হানিফকে পরামর্শ দিলেন হানিফ যেন গিলক্রিস্টকে হুক না করে। (ক্রিকেট তখন এমনি ছিল! বিপক্ষ দলের খেলোয়ারেরাও পরামর্শ দিতো!") হানিফ হুক না করে বল থেকে সরিয়ে নেয়া শুরু করলেন।
পঞ্চম দিন সকাল থেকে তিনি এতোটাই সেট ছিলেন যে তার মনে হচ্ছিলো তিনি বল আসার আগেই জানতেন যে সেই বলে কোথায় আসছে এবং তিনি কি শট খেলবেন! ষষ্ঠ দিন সকালে এরিক অ্যাটকিন্সন নেটে এসে হানিফকে বল করা শুরু করলেন। ইতিহাসে বিপক্ষ দলের কেউ প্রতিপক্ষের নেটে এসে ম্যাচের দিন সকালে বল করেছেন কিনা জানা নেই। অ্যাটকিন্সন বললেন, "গত তিনদিন হানিফকে আউট করবার অনেক চেষ্টা করেছি। বুঝেছি যে ওকে আউট করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই তাকে নেটেই বল করি!" তিনি আউট হবার পরদিন পত্রিকায় শিরোনাম এসেছিলো, "হি ইজ আউট"!
৯৭০ মিনিটের এই ইনিংস আজও টেস্টে বিশ্বরেকর্ড। টেস্ট ইনিংসের এক চিরস্থায়ী রেকর্ড হিসেবেই এটি থাকবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তবে হানিফের কাছে বিবিসির যে ধারাবিবরণীর রেকর্ড আছে সেটি নাকি এটিকে ৯৯৯ মিনিটের ইনিংস বলে প্রমাণ করে। হানিফ উইজডেনের কাছে সেই প্রমাণও পাঠান। কিন্তু উইজডেন তাদের করা রেকর্ড ৯৭০ মিনিটই রেখে দেয়। তবে একটা ফুটনোট জুড়ে দেয় এই বলে যে, "হানিফ ভাবেন রেকর্ডটি ৯৯৯ মিনিটের।" ক্রিকইনফো রেকর্ডসেও একইভাবে লেখা।
বড় ইনিংস খেলা অভ্যাস ছিল তাঁর। প্রথম শ্রেণীর ম্যাচেও তার বিশ্বরেকর্ড ৪৯৯ রান টিকেছিলো ৩৫ বছর। ব্রায়ান লারা ৫০১ করে সেটি ভাঙেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ৪৯৯ রান করতে তিনি সময় নিয়েছিলেন মাত্র ৬৩৫ মিনিট! তাঁকে নিয়ে একটা সমালোচনা ছিল, তাঁর স্কোরিং রেট কম। হানিফ বলেছিলেন, "আমি যদি স্লো-ই হতাম তাহলে কি চারদিনের ম্যাচে ৪৯৯ করতে পারতাম?" ৪৯৯ করা ম্যাচটি আবার হানিফের দল জিতেছিলোও!
হানিফের আরেকটা মহাকাব্যিক ইনিংস ৩৩৭ আর ৪৯৯ এর আড়ালে চাপা পড়ে থাকে! সেটা লর্ডসের ১৮৭। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে করা ৩৬৯ এর জবাবে পাকিস্তানের ১৩৯ রানে ৭ উইকেট পড়ে গিয়েছিলো। ফলোঅন এড়াতে পারার শঙ্কা থেকে হানিফ টেল এন্ডারদের নিয়ে খেললেন ১৮৭ রানের মহাকাব্য! অস্ট্রেলিয়াতে খেলতে গিয়ে মেলবোর্নে একমাত্র টেস্টে করলেন সেঞ্চুরি।
শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে
ফার্স্ট ক্লাসে চার ইনিংসে করেছিলেন দুইটা সেঞ্চুরি আর দুইটা ছিল নার্ভাস নাইন্টিস! ভারতে গিয়ে প্রথম টেস্টেই করেছিলেন সেঞ্চুরি। সেটাও ১৬০! বড় ইনিংস খেলা আর চাপের মুখে নিয়মিত এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য 'মি রিলায়েবল' খেতাবও তারই ছিল! পাকিস্তান ক্রিকেটে তাঁর মতো করে যেকোনো কন্ডিশনে, যেকোনো পিচে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত) টানা বড় ইনিংস কেউ খেলতে পারেনি। এজন্যে এতো বছরেও পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে জাভেদ মিয়াঁদাদ, ইনজামাম, ইউসুফ, ইউনিস, সাঈদ আনোয়ারদের নাম নেবার আগে হানিফের কথাই ভাবতে হয়!
পাকিস্তানে শুধু মোহাম্মদ পরিবার থেকেই হানিফরা পাঁচ ভাই টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। টেস্ট খেলেছেন হানিফের ছেলে শোয়েব মোহাম্মদও! নাতি শেহজারও ফার্স্ট ক্লাস খেলছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথাগত টেকনিকের হানিফকে আবার 'রিভার্স সুইপের" জনক বলা হয়! প্রথম যখন তিনি রিভার্স সুইপ খেলেন তখন শটটির বৈধতা নিয়েও আলোচনা হয়েছিলো! কেভিন পিটারসেনের সুইচ হিট নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের মতো!
১৯৬০-৬১ তে পাকিস্তান যখন ভারত যায় তখন লতা মুঙ্গেশকর হানিফ এবং তার পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর সাথে গান রেকর্ড করার জন্য! লতার বড় ভক্ত হানিফের জন্য সেটি ছিল বড় পাওয়া। ডন ব্র্যাডম্যান যখন প্রথম হানিফকে দেখেন তখন তাঁর উচ্চতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন! তিনি ভেবেছিলেন হানিফ হয়তো লম্বা কেউ হবে।
৫'৫" উচ্চতার এই মানুষটিকেই সর্বপ্রথম বিবিসির ধারাভাষ্যে "লিটল মাস্টার" বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ক্রিকেটের অরিজিনাল লিটল মাস্টার আজকে বিদায় নিলেন! পরকালে ভালো থাকুন হানিফ মোহাম্মদ! আর যেকোনো পরিস্থিতিতে সাহসের সাথে বুক চিতিয়ে লড়ার অনুপ্রেরণা হয়েই থাকুন!