কেন উইলিয়ামসন : ২২ গজে এক সন্ন্যাসী
আপনার মাথার ওপর ডেডলাইনের খড়্গ ঝুলছে, টেনশন আর দুশ্চিন্তায় ঘুমের প্রায় দফারফা। এমন অবস্থায় শেষ মুহূর্তে আপনি প্রজেক্ট জমা দিলেন, সেটার জন্য পেয়ে গেলেন প্রমোশন। নিশ্চিতভাবেই আপনি সেটা উদযাপন করবেন, ‘ইয়েস’ বলে চিৎকারও করে উঠতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক।
এবার আপনি ভাবুন প্রিয় দলের খেলা দেখছেন। শেষ বলে দরকার ৪ রান, উত্তেজনা আর স্নায়ুচাপে আপনার প্রায় দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। ওই অবস্থায় জিতে গেল দল, আপনি খুশিতে দুই এক পাক নেচে ফেললেন। মানুষ হিসেবে আপনার আবেগ, অনুভূতি থাকবেই- তাই না নাচাটাই অস্বাভাবিক।
এবার চিন্তা করুন বাদামি দাঁড়িওয়ালা লোকটার কথা। দলকে একটু একটু করে নিয়ে যাচ্ছেন জয়ের দিকে, একদিকে আবার অসহায় হয়ে দেখতে হচ্ছে সতীর্থদের আসা যাওয়া। শেষ ওভারে যখন খেলাটা নিয়ে গেছেন, জয়ের জন্য সেই লোকটার দিকেই তাকিয়ে দল। ওই সময়ই এসে ঝুঁকিটা নিলেন, একটা ছয়ে ম্যাচ শেষ করে দিলেন। সেঞ্চুরিও হয়ে গেল তার। কিন্তু হাত শুন্যে ছোঁড়া বা আনন্দে লাফ দিয়ে ওঠা দূরে থাক, তেমন কোনো উদযাপনই করলেন না। শুধু হেলমেটটা খুলে সামান্য একটু আলিঙ্গন করলেন সতীর্থকে। ব্যস, স্রেফ এটুকুই। আর কোনো আনন্দ-উচ্ছ্বাসের চিহ্নও নেই। যেন নটা পাঁচটার অফিস শেষে মাত্রই নিজের কম্পিউটার শাট ডাউন করে অফিস থেকে বের হচ্ছেন।
আচ্ছা, সেটাও না হয় মানা গেল। কিন্তু বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের কথা চিন্তা করুন। প্রতিপক্ষ ভারত নিরংকুশ ফেবারিট। বন্দে মাতরমের স্লোগানে ম্লান গড ডিফেন্ড নিউজিল্যান্ড। ম্যাচটা বের করে নিয়ে যাচ্ছেন জাদেজা আর সুপারকুল ধোনি। প্রথমে জাদেজা আউট, এরপর গাপটিলের রুলার মাপা মিসাইল থ্রোতে রান আউট ধোনি, ম্যাচ শেষ। দলকে নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে, অথচ লোকটার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। চুইংগাম চাবাতে চাবাতে একটু হাসি ফুটেছে কি ফোটেনি, ব্যস স্রেফ ওই পর্যন্তই।
কেন উইলিয়ামসন আজকের ক্রিকেটে তাই ভীষণরকম বেমানান একটা চরিত্র। আমাদের চারপাশের অন্য আরও অনেক কিছুর মতো যখন বদলে যাচ্ছে ক্রিকেট, পারফরম্যান্সের সঙ্গে ‘এক্স ফ্যাক্টর’ যখন হয়ে যাচ্ছে খ্যাতি আর সাফল্যের অনুষঙ্গ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন চলছে তুমুল খোঁচাখুঁচি, টুইট-রিটুইট আর সেলফি বিনিময়- এসব কিছু থেকে দূরে থেকে উইলিয়ামসন জেগে আছেন বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতো। এসব তুমুল কোলাহলের কিছুই স্পর্শ করে না তাকে, ২২ গজে যেন ঠিক একজন সন্ন্যাসী। এই যুগেও যার ফেসবুক-টুইটারে অ্যাকাউন্ট নেই, শোম্যানশিপের এই চোখ ধাঁধাঁনো সময়েও যাকে দেখলে মনে হয় পাশের বাড়ির ছেলেটির মতো- ক্রিকেট ম্যাচ শেষ করেই যার সঙ্গে আপনি রাস্তার পাশের দোকানে চা খেতে খেতে গল্প করতে পারবেন। বিকেলবেলা যার সঙ্গে আপনার ছেলেকে ক্রিকেট খেলতে দেখতে চাইবেন।
***
হেলমেট খুলে একটু ব্যাট নাড়ানো, সেঞ্চুরির উদযাপন এতটুকুই
টাইম মেশিনে করে একটু ২৬ বছর আগে ঘুরে আসা যাক। নিউজিল্যান্ডের তাউরাঙ্গা শহরে কাউচের ওপর শুয়ে আছেন ব্রেট উইলিয়ামসন। ছোট্ট কেনের বয়স তখন তিন। এক হাতে ব্যাট আর আরেক হাতে বল তার, উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছিল পরিষ্কার...
- বাবা আমাকে একটু বল করবে?
- আচ্ছা, ঠিক আছে। দাও আমাকে বলটা।
ব্রেট জানতেন, কাজটা তাকেই করতে হবে। কেনের আরও একটা যমজ ভাই আছে, লোগান। তবে খেলাধূলায় তার খুব একটা আগ্রহ নেই। বড় বোনও আছে তিনজন। অন্য খেলায় তাদের আগ্রহ থাকলেও ক্রিকেটে একদমই নেই। কেনকে বল করার কাজটা তাই ব্রেটকেই করতে হয়।
এমন নয়, ছোট্ট উইলিয়ামসন সেই তখন থেকেই ক্রিকেটকেই ধ্রুবতারা করেছিল। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা রাগবিতেও সমান উৎসাহ ছিল তার। স্কুলে ফ্লাই-হাফ হিসেবে দুর্দান্ত ছিল উইলিয়ামসন, এমনকি অল ব্ল্যাকদের হয়ে খেলার স্বপ্নটাও অস্ফুটে বলেছিল কাছের দুয়েকজন বন্ধুর কাছে। সত্যি বললে, যে খেলাটাই সে খেলত, সেটাতেই অল্পদিনের মধ্যে কীভাবে যেন হাত পাকিয়ে ফেলত। ডগ ব্রেসওয়েল নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন বেশ কটি ম্যাচ, উইলিয়ামসনের একদম ছোট্ট বেলার বন্ধু তিনি। ব্রেসওয়েলই বলছিলেন, উইলিয়ামসন খুব দ্রুত খেলার ভেতর ঢুকে যেতে পারত। তখন চার পাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একটা সময় যখন রাগবি ছেড়ে ক্রিকেটে পুরোপুরি মন দিলকেন, তরতর করে ওপরে উঠে যেতে তাই সময় লাগল না। যমজ ছেলে হওয়ায় জন্মের সময় বেশ ধকল গিয়েছিল কেনের মায়ের ওপর। কে জানে, লড়াই করার সেই চেষ্টা মাতৃজঠর থেকেই নিয়ে এসেছিল কেন।
তবে প্রতিভা তো অনেকই থাকে। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট সেটা হয়তো কম দেখেছে, তারপরও রিচার্ড হ্যাডলি, মার্টিন ক্রোদের মতো কেউ আসেনি তা নয়। তবে উইলিয়ামসন আলাদা ছিলেন আরেক জায়গায়। পরিণতিবোধ বলেন বা শান্ত থাকার ক্ষমতাই বলেন, এখানে শুধু ধোনির সঙ্গেই হয়তো তুলনা হতে পারে উইলিয়ামসনের। সেটা আসলে ছিল ছোটবেলা থেকেই। ওই বয়সে কেনের মধ্যে নিজের চেয়ে সতীর্থদের আনন্দকে বড় করে দেখার যে গুণটা ছিল, সেটা প্রথম টের পেয়েছিলেন বাবা ব্রেন্ট উইলিয়ামসনই।
ঘটনাটা সম্ভবত ২০০২ সালের দিকে। কেনের বয়স তখন ১২ প্রায়, স্কুলের হয়ে প্রতি ম্যাচেই রানের বন্যা বইয়ে দিত। বাবা ব্রেন্ট ছিলেন স্কুল দলের কোচ, একটা ম্যাচে ঠিক করলেন ছেলে তো অনেক রান করছেই, এবার অন্যদের সুযোগ দেওয়া যাক। কিন্তু সেই সুযোগ বাকিরা কাজে লাগাতে পারল না। কেন যখন আট নম্বরে নামল, দল বেশ বিপদেই। সেখান থেকে ১১ নম্বরের ব্যাটসম্যানকে নিয়ে দলকে জিতিয়েই ছাড়লেন মাঠ। কিন্তু নিজে আগে বের হলেন না, ১১ নম্বর সতীর্থকেই আগে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। সেই বয়সেই কেন উইলিয়ামসন বুঝতে পেরেছিলেন, ২২ গজে একা বড় হওয়ায় কোনো গৌরব নেই। যে সত্যিটা বুঝতে বুঝতে পুরো ক্যারিয়ার পার হয়ে যায় কত ক্রিকেটারের!
***
কোনোকিছুই যেন বিচলিত করতে পারে না উইলিয়ামসনকে
উইলিয়ামসন ঠিক এখানেই বাকি অনেকের চেয়ে আলাদা। ব্যাট হাতে তিনি কী করতে পারেন, ক্রিকেটের সামান্যতম খোঁজ রাখলেও সেটা জেনে যাওয়ার কথা। একদিন কিউই ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ড নিজের করে নেবেন, সেটাও স্রেফ সময়ের ব্যাপার। তবে সংখ্যা আসলে কিছুই বলতে পারে না। উইলিয়ামসন মানে ধ্রুপদী সংগীতের সেই রাগ ভৈরবী, তন্ময় হয়ে যা শোনা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। উইলিয়ামসনের ব্যাটিং মানে ব্যাটের প্রতি মোচড়ে নিয়ন্ত্রণ আর কতৃত্ব, যেন পাহাড়ের বিপজ্জনক সব বাঁক আর মৃত্যুফাঁদ পেরিয়ে মসৃণ হাতে স্টিয়ারিং হুইল চালিয়ে যাচ্ছেন একজন পোক্ত ড্রাইভার। তবে উইলিয়ামসনের ব্যাটিং নিয়ে গল্প করা যাবে আরেকদিন। আজ আপাতত মানুষ উইলিয়ামসনকে নিয়েই গল্প হোক।
উইলিয়ামসনকে দেখে আপনি আসলে ধন্দেই পড়ে যেতে পারেন অনেক সময়। এই যে ধরুন, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচের সময় যখন ক্যারি আর খাওয়াজা বের করে নিয়ে যাচ্ছেন ম্যাচটা-উইলিয়ামসনের মধ্যে যেন দৃশ্যত কোনো টেনশন নেই। বোলারদের সঙ্গে সেভাবে কথাও বলছেন না খুব একটা, যেন ঠিক করেছেন সবকিছু যেভাবে চলছে চলুক। আপনি হয়তো বলতে পারেন, অধিনায়ককে তো আরেকটু আগ্রাসী হতে হবে এ সময়, আরেকটু বেশি সরব হতে হবে। কিন্তু উইলয়ামসনের ভাবনা অন্যরকম। জেন সন্ন্যাসীর মতো পুরো দলে শান্ত থাকার যে বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেটাই এই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। মার্টিন ক্রো যেমন চার বছর আগে বলেছিলেন, উইলিয়ামসন কোথায় যেতে চান সেটা নিশ্চিত জানেন তিনি।
ক্রিকেটটা যদি অনেক দিন থেকে দেখেন, উইলিয়ামসনের বাঁধভাঙা আনন্দের কোনো ছবি কি মনে করতে পারেন? আচ্ছা, সেটাও যদি না পারেন, গুগল করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন না। খুব একটা লাভ হবে না, উইলিয়ামসনের উদযাপন মানে হেলমেট খুলে সেই স্মিত হাসি। মাঝে মাঝে হয়তো সেটা আরেকটু চওড়া হয়। ব্যস ওটুকুই, এর বাইরে আর বাড়তি কিছুই নেই।
এই শিক্ষাও আসলে পেয়েছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। তাউরাঙ্গা শহরে তার বেড়ে ওঠা, প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে তার মিতালি ছোট্ট থেকেই। ক্রিকেটের ফাঁকে সার্ফিং করা তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ, সময় পেলেই বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সার্ফ বোর্ড হাতে। ঢেউয়ের প্রতিটা উত্তাল তরঙ্গে নিজেকে সমর্পণ করেন অসীমের আশ্রয়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের অনেকটুকু বিশালতা নিয়ে নেন নিজের মধ্যে। উইলিয়ামসন নিজেই যেমন বলেছেন, ‘সার্ফিং করার ওই সময়ে কোনো মোবাইল নেই, অন্য কোনো কিছু বিরক্ত করার সুযোগ নেই। শুধুই নিজের মতো কিছু সময় কাটানো।’ পাদপ্রদীপ থেকে দূরের থাকার এই মন্ত্রের বীজটা আসলে তার পারিপার্শ্বিকতার কারণেই। রজার ফেদেরার যে এমন একজনের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হবেন, তাতে আর বিচিত্র কী!
***
সমুদ্রের বিশালতার কাছেই সার্ফবোর্ডে খোঁজেন আশ্রয়
ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কাছে বেশ কয়েক বছর আগে জানতে চাওয়া হয়েছিল, উইলিয়ামসন সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কি একটু নার্ভাস থাকেন? মাঝে মাঝে যেন কী উত্তর দেবেন সেটা খুঁজে পান না, কী বলবেন সেটা নিয়ে যেন দ্বিধায় ভোগেন একটু। ম্যাককালাম বলেছিলেন, ব্যাপারটা আসলে নার্ভাসনেস নয় মোটেই। উইলিয়ামসন বোঝে না, ওর কাছ থেকে এত কিছু জানতে চাওয়ার কী আছে। কেন ওকে নিয়েই এত কথা হবে!
উইলিয়ামসন সারাজীবন এই ছোট ছোট আনন্দেই বাঁচতে চেয়েছেন। অত তাড়াতাড়ি যেতে চাননি কোথাও, ভক্তদের বরমাল্য থেকেও থাকতে চেয়েছেন দূরে। নিউজল্যান্ডে সেটা অবশ্য কঠিন নয়, ক্রিকেট খেলেন বলে এমনিতেই আলাদা করে মাতামাতি নেই তাদের। তারপরও ভারতে বা বাংলাদেশে এলে সেই উন্মাদনা টের পান ঠিকই। মুনি-ঋষীদের মতো সেটাও প্রশান্তচিত্তে উপভোগ করেছেন। তবে এসবে তার খুব মাথাব্যথা নেই। একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, নিজের পাওয়া সবচেয়ে প্রিয় উপহার কোনটা? উইলিয়ামসন অনেকক্ষণ ভেবে বলেছিলেন, প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া একটা হেডফোন!
উইলিয়ামসন আসলে এমনই। সাফল্য বা ব্যর্থতাকে এখনকার ক্রিকেটে তার মতো ‘পার্ট অব গেম’ করে খুব কম ক্রিকেটারই নিতে পারেন। ব্যর্থতায় তাই নুয়ে পড়েন না হতাশায়, আবার সাফল্যেও উদ্বেল হন না; পাখির পালক থেকে পানি ঝেড়ে ফেলার মতো করে সব একপাশে রেখে দেন। কোহলিদের ভারতকে হারানোর পর তাই বলেন, এত এত মানুষের স্বপ্নভঙ্গ ঘটিয়ে তার খারাপই লাগছে। আবার অকপটে স্বীকার করে নেন, বিশ্বকাপ জিতে গেলেও নিউজিল্যান্ডে রাতারাতি তারকা হয়ে যাবেন না।
কেন উইলিয়ামসন এরকমই। প্রশান্ত মহাসাগরের বিশালতা ধারণ করে ২২ গজে তাই তিনি সন্ন্যাসী।