• অ্যাশেজ ২০১৯
  • " />

     

    হেডিংলি, ১৯৮১ ও ইয়ান বোথাম

    হেডিংলি, ১৯৮১ ও ইয়ান বোথাম    

    লর্ডস যেন মৃত্যুপুরী। মহাশশ্মানের স্তব্ধতা জেঁকে বসেছে সেখানে। সে স্তব্ধতা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে যেন একটা জীবন্ত লাশ। 

    ১৯৮১ অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্ট। রে ব্রাইটের বলে অ্যারাউন্ড দ্য লেগে বোল্ড হয়ে, গোল্ডেন ডাক মেরে, ম্যাচে ‘পেয়ার’ নিশ্চিত করে, নিজের ও ইংল্যান্ড ক্রিকেটের অনিশ্চিত ভবিষ্যত মৃতপ্রায় ব্যাটটায় সঙ্গে করে নিয়ে ফিরছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়ান টেরেন্স বোথাম। লর্ডসের উইকেট থেকে মেম্বারস স্ট্যান্ড পেরিয়ে লং-রুম, এরপর হোম ড্রেসিংরুম- বোথামের কাছে এ পথটা এতো লম্বা মনে হয়নি কখনও এর আগে পরে। 

    যাওয়ার পথে মেম্বারস স্ট্যান্ডের কেউ চোখ সরিয়ে নিয়েছেন তার দিক থেকে,কেউ নিজের ব্যাগের দিকে মনযোগী, কেউ স্কোরকার্ড বা ডায়েরিতে কিছু একটা লিখছেন। বোথামের ওপর থেকে তাদের বিশ্বাস উঠে গেছে। ইংল্যান্ড ক্রিকেট থেকে তাদের বিশ্বাস উঠে গেছে। সেদিন কেউ ইংল্যান্ড অধিনায়কের ফেরার সময় ভদ্রতা করেও বললেন না, ‘হার্ড লাক’, উঠে দাঁড়ানো বা তালি দেওয়া তো দূরের কথা! 

    অথচ কদিন আগেই তিনি ছিলেন হিরো। অভিষেকের আগে থেকেই বোথাম ছিলেন ইংল্যান্ডের গোল্ডেন বয়। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে বোথাম এমন কারিশমা দেখালেন, যেটা এতদিন ইংলিশরা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ান কারও কাছে দেখে বিস্ময়ে করতালিতে মেতেছে। 

    মাইক ব্রিয়ারলি অবসরে যাবেন, ইংল্যান্ড নেতৃত্বের ভার দিল বোথামের ওপর। সামনে পড়লো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ঘরে-বাইরে তাদের সঙ্গে সিরিজ ইংল্যান্ডের। 

    নেতৃত্ব পাওয়ার আগে বোথামের ব্যাটিং গড় ছিল ৪০.৪৮, বোলিং গড় ছিল ১৮.৫২; ৬টি সেঞ্চুরি, ১৪ বার ইনিংসে ৫ উইকেট, দ্রুততম সময়ে ১০০০ রান ও ৫ উইকেটের ডাবলের রেকর্ড। বোথাম ব্যাটিংয়ে নামলেই কিছু হয়, বোলিংয়ে এলে কিছু ঘটে। সেই বোথামের ব্যাটিং গড় অধিনায়ক হওয়ার পর নেমে এলো ১৩.১৪-তে, বোলিং গড় উঠে গেল ৩৩.০৮-এ। নির্বাচনী পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়া ছাত্র যেন বোর্ড পরীক্ষায় ফেইল করেছেন সব বিষয়ে। সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন তার আশেপাশের সবাই। 
     


    লর্ডসে পেয়ার, ফিরছেন বোথাম


    তবে এরপরই যদি সব শেষ হয়ে যায়, তাহলে আর কীভাবে তৈরি হয় কিংবদন্তী! চরম দুঃসময়ে যদি কেউ দেবদূতের মতো হাজির না হন রক্তমাংসের শরীরে- এক্ষেত্রে একটা উইলো কাঠের খন্ড আর চর্মগোলক হাতে- তবে তিনি আর কীসের নায়ক!  

    বোথাম তাই হেডিংলিতে হয়ে গেলেন ইংল্যান্ড-রূপকথার অনিবার্য নায়ক, ১৯৯ রান আর ৭ উইকেটের আদলে ২০৬টি ইট দিয়ে গড়লেন ইংলিশ ক্রিকেটের নতুন জেরুজালেম। 

    আজও ইংলিশরা হয়তো মনে করতে পারেন, হেডিংলির সেই টেস্টের সময় কোথায় ছিলেন তারা। 

    ****

    সত্তর ও আশির দশকের ইংল্যান্ডে সবকিছু গড়বড় হয়ে যাচ্ছিল যেন। অর্থনৈতিক দুর্দশা জেঁকে বসেছে। চারদিকে অস্থিরতা, চাপা ক্ষোভ। সেসব রূপ নিয়েছে দাঙ্গায়। গোত্রে গোত্রে সংঘর্ষে। সে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে লন্ডন, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, লিডস থেকে বার্মিংহাম পর্যন্ত। রাস্তায় বের হলে সংঘর্ষের ছাপ স্পষ্ট, পুড়ছে গাড়ি-বাড়ি, উড়ছে কালো ধোঁয়া। 

    একাশির শেষ দিকে আবার নামলো শীত। সে বছরের ডিসেম্বর থেকে পরের বছর জানুয়ারিতে রেকর্ড হওয়া তাপমাত্রা ও বাতাসের বেগ ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ। দাঙ্গায় উত্তপ্ত ইংল্যান্ড শীতে হয়ে পড়লো বিষণ্ন। 

    নগর পুড়লে দেবালয় কি আর রক্ষা পায়! ইংলিশ ক্রিকেটের অবস্থাও তাই তেমন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে নাকানিচুবানি খেয়ে এসেছে তারা, অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টের পর তৃতীয় টেস্টের প্রথম তিন দিনের অবস্থাও একই। 

    ট্রেন্টব্রিজে প্রথমটি হারার পর লর্ডসের দ্বিতীয় টেস্টটা ড্র করেছিল ইংল্যান্ড। বোথামের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড ১২ টেস্টের মধ্যে জেতেনি একটিও, আর তার ফর্মের অবস্থা তো বিভীষিকাময়। তার ওপর তখন তার মাথায় ঝুলছে এক নাইটক্লাবের বাইরে এক লোককে লাঞ্ছনার মামলা, যদিও পরে সেটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল। বোথাম স্বস্তিতে ছিলেন না। ক্রিস্টোফার মার্টিন-জেনকিনসের ভাষায়, অধিনায়কত্ব বোথামের কাছে হয়ে গিয়েছিল ফ্রোডোর সেই রিংয়ের মতো ভারী। স্বস্তিতে ছিল না বোথামের পরিবার, তার পারফরম্যান্সের কারণে হেনস্তার শিকার হচ্ছিলেন তারা। স্বস্তিতে ছিল না ইংল্যান্ডের ক্রিকেট। 
     


    মাইক ব্রিয়ারলির (বাঁয়ে) মানুষের ওপর একটা ডিগ্রি ছিল


    লর্ডস টেস্ট শেষ হওয়ার আগেই নেতৃত্ব ছাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বোথাম। নির্বাচকরাও তাকে মুক্তি দিতে চাচ্ছিলেন। এমনিতেই সে অ্যাশেজে ম্যাচ-বাই-ম্যাচ নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল বোথামকে। সিরিজ শুরুর আগে বলেছিলেন, এবার অ্যাশেজ দেখে লোকে দারুণ উপভোগ করবে। প্রথম টেস্টের পরও আশাবাদী হয়ে হাসছিলেন তিনি, লর্ডসের পর সে হাসিটা মিলিয়ে গেল তার। উপভোগ করছিল শুধু অস্ট্রেলিয়ানরা, ইংলিশরা নয়। 

    ইংল্যান্ড ফিরে গেল পুরোনো পদ্ধতিতে। অধিনায়কত্বের জন্য ফেরানো হলো ক্যামব্রিজ গ্র্যাজুয়েট মাইক ব্রিয়ারলিকে, এক সময় যা প্রচলিত পদ্ধতি ছিল ইংল্যান্ডের। 

    ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্রিয়ারলইর রেকর্ডটা জোর হলে গড়পড়তা বলা যায়। ১৯৮২ সালে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বাইরের সফরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বয়স ৩৯ পেরিয়ে গেছে। বয়সের ভার পায়ে গিয়ে পড়েছে, স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা আর ব্যাটিংয়ে এতদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যা কিছু করতে পারেন।

    অধিনায়কত্বে তো আর বয়স বাধা নয়, অন্তত ব্রিয়ারলির ক্ষেত্রে তাই ছিল। অধিনায়ক হিসেবে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার উপায়টা জানা ছিল তার। তিনি বোথামের প্রথম অধিনায়ক, বোথামের চোখে দেশের সেরা অধিনায়ক। ক্যামব্রিজে মোরাল সায়েন্স পড়েছিলেন, যে কোনও শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে অসুবিধা হতো না তার। অস্ট্রেলিয়ান পেসার রডনি হগের মতে, ব্রিয়ারলির একটা ডিগ্রি আছে মানুষের ওপর। 
     


    ইংল্যান্ডের দাঙ্গা, ১৯৮১


    হেডিংলির আগে ব্রিয়ারলি একটা মাইন্ডগেম খেললেন বোথামের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি এ ম্যাচে খেলতে চান কিনা। আদতে সেসব বলে একটু তাতিয়ে দিলেন তাকে। বোথাম বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন প্রথম ইনিংসেই। ব্রিয়ারলি তাকে দিয়ে করিয়ে নিলেন দীর্ঘ স্পেল, হয়তো বোথাম নিজেও নিজেকে এতক্ষণ বোলিংয়ে রাখতেন না। প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট বোথামের। শেষবার ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ব্রিয়ারলির অধিনায়কত্বেই। তবে সে ৬ উইকেট খুব একটা পার্থক্য গড়লো না। 

    হেডিংলির অসম বাউন্সের উইকেটে টসে জেতার পর সিদ্ধান্ত জানানোর আগে ডেনিস লিলি ও রড মার্শকে ডেকে প্রায় ১০ মিনিট কথা বলেছিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক কিম হিউজ। ওদিকে প্যাড-আপ শুরু করে দিয়েছিলেন বয়কট-গুচরা, মেঘলা কন্ডিশনে বোলিং ছাড়া আর কিইবা নেবেন হিউজ! তবে হিউজ নিলেন ব্যাটিং। উইকেটের প্রকৃতি অনুযায়ী বোলিং করতে ব্যর্থ হলেন ইংল্যান্ড বোলাররা। জন ডাইসনের মেইডেন সেঞ্চুরি, অধিনায়ক কিম হিউজের ৮৯ ও গ্রায়াম ইয়ালোপের ৫৮ রানে বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম দুই দিন মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া তুললো ৪০১ রান। ১ উইকেট বাকি থাকতে ইনিংস ঘোষণা করে দিলেন হিউজ, দুই প্রান্ত থেকে ডেনিস লিলি ও টেরি অল্ডারম্যানকে এক ওভার করে বোলিংয়ের সুযোগ দিতে। 

    ইংল্যান্ড তৃতীয় দিন গুবলেট পাকিয়ে ফেললো ব্যাটিংয়ে, বরাবরের মতোই। লিলি, অল্ডারম্যান, জিওফ লসন পিচের অসম বাউন্সের সুবিধা তুললেন, ইংল্যান্ড গুটিয়ে গেল ১৭৪ রানেই। একমাত্র উজ্জ্বল দিক ইয়ান বোথামের ৫৪ বলে ৮ চারে ৫০। শেষ ফিফটি করেছিলেন তিনি অধিনায়কত্ব পাওয়ার প্রথম ম্যাচে। হয়তো বোলিংয়ের সাফল্য তাকে তার সহজাত প্রবৃত্তি অনুসরণ করার সাহস জুগিয়েছিল।

    ইংল্যান্ডকে ফলো-অন করালেন হিউজ, পরদিন এমনিতেও রেস্ট-ডে বলে বিশ্রাম পাবেন তার বোলাররা। সেদিন গ্রাহাম গুচের উইকেট পেয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। 

    সেদিনের শেষদিকে অফিশিয়াল স্কোরকার্ডে ভেসে ওঠা তখনকার বাজির দরগুলি ইংল্যান্ডের সে টেস্টের অবস্থা বুঝাতে যথেষ্ট। ১-৪ অস্ট্রেলিয়া, ৫-২ ড্র, ৫০০-১ ইংল্যান্ড। ডেনিস লিলি লোভনীয় অফারটা নিতে চাইলেন। তবে সতীর্থদের বুঝাতে ব্যর্থ হলেন প্লেয়ারস পুলে বাজি ধরতে। এরপর কোচ ড্রাইভার পিটার ট্রাইবকে দিয়ে ১০ পাউন্ড লাগিয়েছিলেন লিলি, মার্শ লাগালেন ৫ পাউন্ড। 

    চতুর্থ দিন অস্ট্রেলিয়া প্রস্তুত জয়ের উল্লাসে মাততে। ড্রাগোনারা হোটেল থেকে সকাল নয়টার দিকে চেক-আউট করে ফেলেছেন ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সদস্যরা। বাড়তি একদিন হোটেলে পড়ে থাকার মানে নেই।  

    ****

    সোমবার সবকিছু ‘ঠিকঠাক’ই চলছিল, ইংল্যান্ডের পরাজয় সময়ের অপেক্ষা। লিলি-মার্শের টাকা জলের দিকে এগুচ্ছে। ৪১ রানে ৪ উইকেটের পর জিওফ বয়কটের সঙ্গে পিটার উইলির ৬৪ রানের জুটি ভাঙলো পরেরজন লিলির বলে আউট হওয়ায়। লিলির সেটি ১৪২তম উইকেট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ছাড়িয়ে গেলেন হিউ ট্রাম্বলকে। লাউডস্পিকারে সে ঘোষণার পর করতালিতে মাতল হেডিংলি। এক হাতের ব্যাট আরেক হাতে ঠুকে লিলিকে অভিনন্দন জানাতে জানাতে নামলেন বোথাম। অস্ট্রেলিয়াকে আবার ব্যাটিং করাতে তখনও ১২২ রান দরকার ইংল্যান্ডের। 

    প্রথম ইনিংসে হাফ-সুয়েটার পরেছিলেন, এবার নামলেন ফুলস্লিভ পরে। মাথায় হ্যাট বা হেলমেট কিছু নেই। যত্ন করে ট্রিম করা দাড়ি, উড়ছে সোনালী চুল। বোথাম, এই কদিন আগেও যিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের হিরো। এরপর পতন হয়েছে যার। ফটোগ্রাফাররা আশায়, বোথাম শুরুর দিকেই আউট হলেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবি হবে। বিবিসির ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, বোথাম যদি এদিন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ব্যাটিং করতে পারেন, তবে সেটাই হবে তার জন্য বিজয়। বোথাম নিশ্চিতভাবেই তার কথা শুনতে পাননি। তবে বোথাম জয়ের চেয়েও বেশি কিছু অর্জন করলেন। 

    বয়কট এলবিডব্লিউ হলেন। বব টেইলর ১ রানে ক্যাচ দিলেন। বোথামকে সঙ্গ দিতে এলেন গ্রায়াম ডিলি। ইংল্যান্ড তখনও পিছিয়ে ৯২ রানে, বাকি ৩ উইকেট। এর আগে ১৮ ইনিংস মিলিয়ে ডিলি করেছিলেন ১৭৪ রান। ডিলি জানতেন, পরের ম্যাচে তার খেলা হবে না। তার হারানোর কিছু নেই। তবে শুরুর দিকে ডিলির ব্যাটিং শুধু ডুবন্ত নৌকা থেকে হাত দিয়ে পানি সরানোর মতোই বিফলা মনে হচ্ছিল। 

    একসময় বোথামের স্কোরকেও ছাড়িয়ে গেলেন তিনি। অফস্টাম্পের বাইরের আলগা কোনও বলকেই ছাড়ছিলেন না। শীঘ্রই আক্রমণের ভাইরাস সংক্রমিত হলো বোথামের ব্যাটে। ৩৯ থেকে ১০৩- এই ৬৪ রান বোথাম করলেন ১৪টি চার, একটি ছয় ও একটি সিঙ্গেলে। এর মাঝে ছয়টি মারলেন অল্ডারম্যানকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মাথার ওপর দিয়ে। সে ছয়ের পর রিচি বেনোর বলা কথাটা ঢুকে গেছে ক্রিকেট-ধারাভাষ্যের লোকগাঁথায়, “ডোন্ট বদার লুকিং ফর দ্যাট, লেট অ্যালোন চেজিং ইট। ইটস গন স্ট্রেইট ইনটু দ্য কনফেকশনারি স্টল, অ্যান্ড আউট এগেইন!” 

    বোথাম অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের কনফেকশনারি স্টলেই পাঠাচ্ছিলেন। 
     


    “ডোন্ট বদার লুকিং ফর দ্যাট, লেট অ্যালোন চেজিং ইট। ইটস গন স্ট্রেইট ইনটু দ্য কনফেকশনারি স্টল, অ্যান্ড আউট এগেইন!”


    শুরুতে ভাগ্যের সহায়তা পেলেন। এরপর ভাগ্যকে নিজেদের দিকে টেনে আনলেন। বোথাম মিড-উইকেটে মারতে গিয়ে স্লিপের ওপর দিয়ে খেলছিলেন, তবে শীঘ্রই সেসব দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের কাছে। তারা এমনকি বোথামকে দুটি বিমারও করে বসলেন। তাদেরকে দেখাচ্ছিল ক্লান্ত। অথচ এদিন তাদের জয়োৎসব করার কথা! স্লিপের ওপর দিয়ে চার মেরে সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন বোথাম, দুহাত ওপরে তুলে উল্লাস করলেন। ঠিক ভেসে গেলেন না। তার ক্রিকেট খেলার একটা সরল নীতি ছিল। তিনি যেমন উপভোগ করেন, তার খেলা দেখে পয়সা খরচ করে আসা লোকেরাও যেন উপভোগ করে। বোথাম সেদিন হাসছিলেন। বোথাম ব্যাটিংটা আবার উপভোগ করছিলেন। হেডিংলির দর্শকরা, বিবিসির সামনে বসে থাকা দর্শকরা সেটি উপভোগ করছিল। 

    ৭৫ বলে ৯ চারে ৫৬ রান করার পর, বোথামের সঙ্গে ১১৭ রানের জুটি গড়ার পর ডিলি বোল্ড হলেন অল্ডারম্যানের বলে। ইংল্যান্ডের রান তখন কার্যত ৮ উইকেটে ২৫। ক্রিস ওল্ড এলেন, ডিলির কাজটা চালিয়ে গেলেন তিনি। ৬ চারে তিনি করলেন ৩১ বলে ২৯। বোথামের সঙ্গে ৬৭ রানের জুটি। এলেন বব উইলিস। 

    তবে বোথাম তখন অন্য মুডে চলে গেছেন। শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক নিজের কাছে রাখছেন, উইলিসকে সঙ্গে নিয়ে একাই তুললেন ৩২ রান। চা-বিরতির পর ইংল্যান্ডের ১৭৫ রানের ১০৬ রানই করলেন বোথাম, মাত্র ২৭ ওভারে। দিন শেষে বোথাম ব্যাট হাতে ছুটছিলেন ড্রেসিংরুমে, দর্শকদের কবল থেকে রক্ষা পেতে। লর্ডসের স্তব্ধতা পেছনে ফেললেন তিনি। তার জাতীয় ‘হিরো’র মর্যাদা ফিরে এলো আবার। 

    পরদিন উইলিস ক্যাচ দিলেন, বোথামকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ রইল না আর। 

    ১২৯ রানের লিড ইংল্যান্ডের। এ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিং করানোই ‘মোরাল ভিক্টোরি’ হতো ইংল্যান্ডের, সেখানে লিড তো আরও বড় কিছু। তবে হেডিংলির আবহ বদলে গেছে ততক্ষণে। সেটা তখন বনে গেছে রবার্ট জর্জ ডিলান উইলিসের ফিনিক্স হয়ে ওঠার ছাইভস্ম।  
     


    হেডিংলির সে ইনিংসের পর


    **** 

    হেডিংলিতে খেলার কথা ছিল না বব উইলিসের। ফর্মের যাচ্ছেতাই অবস্থা। ভাইরাসে আক্রান্ত বলে তাকে ফিট মনে করেননি নির্বাচকরা। তার নো-বল করার প্রবণতা ইংল্যান্ডের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। লর্ডস টেস্টের পর ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে খেলতে পারেননি। টেস্টের জন্য ১২ জনের স্কোয়াডে ছিলেন না তিনি। 

    তবে নির্বাচকরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে নিজের ফিটনেসের ব্যাপারে জোরালো দাবি জানালেন উইলিস। নিজেকে প্রমাণের জন্য ওয়ারউইকশায়ারের দ্বিতীয় একাদশের হয়ে একটা একদিনের ম্যাচও খেললেন। উইলিস ফুঁসছিলেন। ইংল্যান্ডের স্ট্রাইক বোলারের মর্যাদা চলে গেছে তার, জায়গাও হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রায়। তবে হেডিংলিতে শীঘ্রই নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেন না তিনি, প্রথম ইনিংসে থাকলেন উইকেটশূন্য। 

    দ্বিতীয় ইনিংসে উইলিসকে প্রথমে করানো হলো ফুটবল গ্রাউন্ড প্রান্ত থেকে। যেদিক থেকে হেডিংলির ঢালে নিচু থেকে উঁচুতে উঠতে হয়। বাতাসের বাধা পেরুতে হয়। উইলিসকে এমন করানোর অর্থ, যদি এসব বাধায় নো-বলের প্রবণতা কমে তার। তবে তাতে কাজ হচ্ছিল না। হিংস্র পশুকে পায়ে বাঁধন দিয়ে আটকে রাখার মানে নেই। 

    বোথামের সঙ্গে পরামর্শ করে উইলিসকে কার্কস্টল লেন থেকে আনলেন ব্রিয়ারলি। বাতাস এখন পক্ষে তার। উঁচু থেকে নিচুতে নামছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া, প্রস্তুত? 
     


    বব উইলিস যেন বল নয়, দলা পাকিয়ে তার চাপা রাগটা ছুঁড়ছেন।


    গ্রায়েম উডের উইকেট দিয়ে শুরুতে ব্রেকথ্রু দিয়েছিলেন বোথাম। ট্রেভর চ্যাপেলকে নিয়ে প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান ডাইসন ইংল্যান্ডকে ছিটকে দিচ্ছিলেন এরপর। ১৩০ রানের লক্ষ্যে ৫৬ রানে ১ উইকেট তাদের। এলেন উইলিস। যেন বল নয়, দলা পাকিয়ে তার চাপা রাগটা ছুঁড়ছেন। যেন বোলিংয়ের জন্য ছুটে আসছেন না, আসছেন একটা মিশনে। 

    চ্যাপেল তার বাউন্সারে ছিটকে গেলেন। উইলিস ঘুরে আম্পায়ারের কাছ থেকে বাড়তি সুয়েটারটা নিয়ে গায়ে চাপালেন। কারও সঙ্গে হাই-ফাইভ নেই। কিছু নেই। প্রথম ইনিংসে লেংথ নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছিলেন বলে বলেছিলেন অধিনায়ককে। এবার ফাস্ট আর স্ট্রেইট করতে চান। ব্রিয়ারলি তাকে চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। 

    তেমনই এক ডেলিভারিতে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক হিউজ ফিরলেন শূন্যতে। বাঁদিকে ঝুঁকে দারুণ ক্যাচ নিলেন স্লিপে বোথাম। প্রথমে বোথামের বোলিংয়ের কারিশমা ফিরেছিল। এরপর ব্যাটিং। এবার ফিরল ফিল্ডিংয়ে। তিনি ও বাকিরা উল্লাস করলেন। তবে উইলিস ফিরে গেলেন আবার। তার রাগটা কমেনি তখনও। তার মিশন শেষ হয়নি তখনও। 

    লাঞ্চের আগে শেষ বলে ইয়ালোপ আবার শিকার বাউন্সারের। এবার শর্ট লেগে দারুণ ক্যাচ গ্যাটিংয়ের।  বিরতির পর অ্যালান বোর্ডারকে বোল্ড করলেন ওল্ড। ডাইসন এরপর উইলিসের বলে গ্লাভড, মার্শ হুক করতে গিয়ে সীমানার ওপর ধরা পড়লেন ব্যাকগিয়ারে যাওয়া ডিলির হাতে। এরপর লসন নেই। ৮ উইকেটে ৭৫, অস্ট্রেলিয়া। 

    রে ব্রাইট ও ডেনিস লিলি পরের ৪ ওভারে তুললেন ৩৫ রান। এরপর উইলিসের হাফ-ভলি পড়তে ভুল হলো লিলির, মিড-অনে সামনে এসে ডাইভ দিয়ে ক্যাচ নিলেন গ্যাটিং। ২০ রান দরকার, ওল্ডের জায়গায় এলেন বোথাম। ওল্ড গেলেন স্লিপে বোথামের জায়গায়। এক রান এলো। তিন বলের ব্যবধানে দুইটি সুযোগ ছাড়লেন ওল্ড। 

    তবে উইলিস সেদিন কারও ওপর নির্ভর করতে চান না। ব্রাইটকে দিলেন ইয়র্কার। এবার উল্লাসে মাতলেন তিনি। কাভারের দিকে হয়ে আম্পায়ারের পেছন দিকে একটা চক্কর মারলেন। ততক্ষনে মাঠে ঢুকে পড়েছে দর্শক।

    লিলি-মার্শ হয়তো তাদের বাজিতে বেশ কিছু পাউন্ড জিতেছিলেন। তবে বোথাম ও উইলিস সেদিন জিতেছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। 


    **** 


    হেডিংলি এক ম্যাচের বিস্ময় হয়ে থাকলো না। বোথাম থামলেন না। এজবাস্টনে ১৫১ রানের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া ৫ উইকেটে তুলে ফেলেছিল ১১৪ রান। বোথাম এলেন। সে স্পেলে ৫ উইকেট নিলেন ১ রান দিয়ে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৪ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর নেমে ১০২ বলে ১৩ চার ও ৬ ছয়ে করলেন ১১৮ রান। যেটিকে অনেকেই মনে করেন বোথামের ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। প্রথম দুই টেস্ট শেষে ১-০ তে পিছিয়ে থাকা ইংল্যান্ড ৫ টেস্ট শেষে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে নিশ্চিত করলো অ্যাশেজ জয়। ওভালে শেষ ও ড্র হওয়া টেস্টে বোথাম নিলেন ১০ উইকেট। 

    একাশি ইংল্যান্ডের জন্য সহজ সময় ছিল না। একাশির অ্যাশেজ ইংলিশদের ভুলিয়ে দিল তাদের দুঃসময়। 

    ইয়ান টেরেন্স বোথামের নায়ক মর্যাদা ফিরে এলো, তিনি হয়ে গেলেন রূপকথার নায়ক। হেডিংলি ঢুকে গেল ক্রিকেট-রূপকথায়। আজও হয়ত ইংলিশরা স্মরণ করতে পারেন, সেদিন ঠিক কোথায় ছিলেন তারা।