জাকের আলি : উইকেটকিপার-বদলি থেকে রেকর্ডগড়া বদলি উইকেটকিপার
জাকের আলিকে মনে পড়ে আপনার?
উঁহু, ৩০ ডিসেম্বরের এই জাকেরকে না। এ বছরের ১৯ জানুয়ারির জাকেরকে। যে জাকেরকে ম্যাচের মাঝপথেই উইকেটকিপার হিসেবে বদলি করেছিল সিলেট সিক্সারস।
রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচে সেদিন সিলেটের ফিল্ডাররা যেন হাতে কিছু পিচ্ছিল মেখে নেমেছিলেন। এক জাকেরই রাইলি রুশোর দুটি ক্যাচ ফেললেন। প্রথমটি ছিল লোপ্পা, তাসকিন আহমেদ তো উদযাপনও শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে আগেভাগেই উদযাপন শুরুর চেষ্টা করছিলেন হয়তো জাকেরও, বারকয়েকের চেষ্টাতেও পরে ক্যাচটা রাখতে পারলেন না। সন্দিপ লামিচানের বলে রুশো কাট করতে গিয়েছিলেন, জাকের এবারও ধরতে পারলেন না ক্যাচটা। ১০ ওভার পর সিলেট বদলে ফেললো উইকেটকিপার, জাকেরের বদলে এলেন লিটন দাস। লিটন অবশ্য একাদশে ছিলেনই, ফিল্ডিংয়ে একটা ক্যাচও নিয়েছিলেন।
সে ঘটনা হয়তো আপনার মনে নেই। অথবা আপনার মনে আছে। আপনি জাকেরকে মনে রেখেছেন।
সাধারণত, মনে রাখতে বা নজরে পড়তে ক্রিকেট মাঠে আপনাকে অসাধারণ কিছু করতে হবে। অথবা ব্যতিক্রমী। অথবা সংখ্যাতত্ত্বে এমন কোনও নাম্বারে আপনি হিট করবেন, স্কোরকার্ড ছাপিয়ে আপনি চলে যাবেন রেকর্ডবইয়ে। সে রেকর্ডবই চিরায়ত, অথবা একটু ব্যতিক্রমী।
আগের বিপিএলে উইকেটকিপার হিসেবে যাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই জাকের আলি পরের বিপিএলে আরেকজনের বদলে নেমে করলেন তেমন কিছুই।
ঢাকা প্লাটুনের এর আগের ৭টি ম্যাচেই খেলেছেন তিনি। তবে উইকেটকিপিং করেননি। আলাদা করে তাকে নজরে পড়েছে আপনার? ব্যাটিংয়ে? অথবা ফিল্ডিংয়ে সহজ ক্যাচ নিয়ে অতি-উল্লাসে? নাকি কখনও মাহেদির ঝড়, কখনও সিলেটের ব্যাটিং তান্ডবে চাপা পড়েছেন তিনি। টানা ৭ ম্যাচ খেলার পর এদিন প্রথমবার জাকেরকে বাদ দিল ঢাকা। ম্যাচে ক্রিকেটারদের তালিকায় ১৪তম ব্যক্তি উইকেটকিপিং করতে নামলেন এনামুল চোট পাওয়ায়।
৩ ওভারে লিটন ও আফিফ হোসেনের ৩৯ রানের ঝড় সামলাতে একটা ব্রেকথ্রু প্রয়োজন ছিল ঢাকার। ওয়াহাব রিয়াজের ওভার দ্য উইকেট থেকে ন্যাচারাল অ্যাঙ্গেলের বলটা ড্রাইভ করতে গিয়ে এজড হলেন লিটন। জাকেরকে নজরে পড়লো আপনার? হয়তো না। ঢাকার ব্রেকথ্রুতে চাপা পড়ে গেলেন তিনি। এক বল পর অলক কাপালি শরীর থেকে দূরে খোঁচা দিলেন। ক্যাচ নেওয়ার পর জাকেরের লাফটা হয়তো নজরে এলো আপনার। শোয়েব মালিক এলেন। দুই বল খেলার পর রিয়াজের কোমরসমান বলে ফ্লিক করতে গিয়ে সফল হলেন না ঠিক। জাকের এবার আপনার নজরে পড়তে বাধ্য। ক্যাচটা নিয়ে তিনি দৌড় শুরু করে চলে গেছেন মিডউইকেটের দিকে। তবে আম্পায়ার নির্বিকার।
জাকের, রিয়াজের সঙ্গে কথা বলে মাশরাফি রিভিউ নিলেন। মালিক হাঁটা ধরলেন প্রায় এর পরপরই। তার গ্লাভস যে অপরাধী, সেটা তো তিনি জানেন। রিয়াজের এক ওভারে ৩ উইকেট হয়ে গেল। এক ওভারে ঢাকা পেল প্রথম ব্রেকথ্রু, এরপর আরও ২ উইকেট। ৩৯ রানে ০ উইকেট থেকে রাজশাহী ৩৯ রানে ৩ উইকেটে পরিণত হলো। আর হ্যাঁ, বদলি উইকেটকিপার জাকের নিলেন তার ৩ নম্বর ক্যাচ।
রিয়াজকে সহসাই আর বোলিংয়ে আনলেন না মাশরাফি। তবে জাকের থাকলেন। আলোচনায় থাকলেন। লুইস রিসকে স্লগ করতে গিয়ে টাইমিং করতে পারলেন না আফিফ, খাড়া ওপরে উঠলো ক্যাচ। জাকের ওপরের দিকে তাকিয়ে তার পজিশন বদলে নিয়ে গ্লাভস বাড়ালেন। আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে পড়ছিল তার। এ ক্যাচ মিস হওয়ার নয়। হলোও না। ৪ নম্বরটা হয়ে গেল।
বোপারা রান-আউট হলেন, নাহিদুলের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝির পর। আসিফ আলি পয়েন্ট থেকে সরাসরি থ্রোয়ে স্টাম্পে লাগালেন। আবেদন ও উল্লাস ছাড়া জাকেরের এ রান-আউটে অবদান নেই। তবে সেই ম্যাচটার সঙ্গে একটা ব্যাপার আছে।
রাইলি রুশো ও অ্যালেক্স হেলসের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল, বল গিয়েছিল পয়েন্টে। সাব্বির রহমান ধরে থ্রো করেছিলেন, তবে ক্রিজের মাঝপথ থেকে ফিরে যাওয়া রুশো বেঁচে গিয়েছিলেন সে থ্রো স্টাম্পে না লাগায়। রুশো ও হেলস যখন হ্যাঁ-না করছেন, জাকেরও তার পজিশনে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। দৌড় স্টার্টিংয়ে দেরি করে ফেললেন, সাব্বিরের থ্রো স্টাম্প মিস করে যাওয়ার পর এসে পৌঁছালেন সেখানে। সরাসরি থ্রো হলে রান-আউট হতে পারতো, হয়তো এই উপসংহারই টানলেন সবাই। জাকেরের 'ভুল'টা মিস করে গেলেন।
এবার জাকের আর অপেক্ষা করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই চলে এসেছেন স্টাম্পের কাছে, এমনকি আসিফের থ্রো স্টাম্প মিস করলেও তার গ্লাভসের পজিশন ছিল বলের গতিপথেই। হয়তো এবারও আসিফের থ্রোয়ের কারণে জাকেরের এই পজিশনিংটা মিস করে যাবেন আপনি।
অবশ্য এরপর জাকের যা করলেন, তা মিস হওয়ার নয়। হাসান মাহমুদ এ বিপিএলে আলো ছড়িয়েছেন আলাদা করে, অথবা আলাদা করে তাকে নিয়ে আশা করছেন অনেকেই। তাকে কাট করতে গিয়ে ঠিক যুত করতে পারলেন না রাসেল। এজড হলেন। তবে জাকেরের কাছে যাওয়ার ঠিক আগে যেন বলটা লাফ দিল একটা। জাকেরের রিফ্লেক্স হলো অসাধারণ, ঝাঁপিয়ে উঠলেন মুহুর্তেই। এ বল তো মিস হওয়ার নয়! জাকেরের ৫ হয়ে গেল। বিপিএলে এর আগে এক ইনিংসে ৫ ডিসমিসাল আছে আর দুজন উইকেটকিপারের- মোহাম্মদ শাহজাদ ও উমর আকমল। তবে এ দুজনই ক্যাচ নিয়েছিলেন ২টি, স্টাম্পিং করেছিলেন ৩টি।
এর আগেই হাসানের একটা বল মিস করে গেছেন জাকের। আম্পায়ারের মতে, আফিফের প্যাড ছুঁয়ে সেটি বেরিয়ে গেছে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়া জাকেরকে ফাঁকি দিয়ে। অবশ্য আফিফ বুঝাতে চাচ্ছিলেন, বল প্যাডে লাগেনি তার। আম্পায়ার ওয়াইড দেননি, দিয়েছিলেন লেগবাই। জাকেরের নাগালের মধ্যে থাকা প্রথম মিস এটি। এরপর শাদাবের একটা ফুললেংথে পড়া গুগলি মিস করে গেলেন একটু দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেখানোয়, বলে উঠলেন ‘ধ্যাৎ’। এদিন তিনি যা করেছেন, তাতে এ মিস অবশ্য ওই ‘ধ্যাৎ’-এর মতোই।
তবে এর আগেই রেকর্ডটা হয়ে গেছে তার। শাহজাদ-আকমলকে ছাপিয়ে বিপিএলে এক ইনিংসে ৬টি ডিসমিসাল পেয়েছেন তিনি রিয়াজের বলে নাহিদুলের ক্যাচটি নিয়ে। শুধু বিপিএল কেন, টি-টোয়েন্টিতেই এক ইনিংসে ৬ ডিসমিসাল আছে আর ৩ জনের- লঙ্কান ক্রিকেট ক্লাবের উপুল ফার্নান্ডো, যুক্তরাষ্ট্রের আকিম ডডসন ও মুম্বাইয়ের আদিত্য তারের। ফার্নান্ডো তার ৭ ডিসমিসালের সবকটিই ক্যাচ হিসেবে নিয়েছিলেন, তারের ৬টিই ছিল ক্যাচ, আর ডডসন ৪টি ক্যাচের সঙ্গে করেছিলেন ২টি স্টাম্পিং।
তবে এদের সবাই খেলেছিলেন স্বীকৃত উইকেটকিপার হিসেবে। তারে ছাড়া বাকি দুজনের রেকর্ডের সময় একাদশের বাইরে থেকে উইকেটকিপার বদলির নিয়মও ছিল না আইসিসির।
একাদশের বাইরে ছিলেন বলে জাকেরের অফিশিয়াল রেকর্ডে এ ম্যাচটি গণ্য হবে না। স্বীকৃত উইকেটকিপারের ডিসমিসালের রেকর্ডেও থাকবেন না তিনি। তবে বদলি উইকেটকিপার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ডের কথা আসলে জাকেরের নাম আসবে।
সেই জাকের, এ বছরের শুরুতে যাকে ১০ ওভার পর উইকেটকিপিং থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বছরের শেষে এসে যিনি বনে গেলেন উইকেটকিপারের ‘সুপার-সাব’।
জাকের আলিকে আপনি মনে রাখতে পারেন এবার।
(থাম্বনেইলের ছবি কৃতজ্ঞতা- জাকের আলির ফেসবুক প্রোফাইল)