• উইমেনস টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২০
  • " />

     

    জাহানারা আলম : বড় প্লাটফর্মে আমরা ভয় পাই না, স্বপ্ন বাংলাদেশকে শীর্ষ চারে দেখা

    জাহানারা আলম : বড় প্লাটফর্মে আমরা ভয় পাই না, স্বপ্ন বাংলাদেশকে শীর্ষ চারে দেখা    

    জাহানারা আলম, বাংলাদেশের ইতিহাসের সফলতম পেসার। ২০১১ সালে বাংলাদেশ উইমেনসের প্রথম ওয়ানডেতে খেলেছেন, ক্যারিয়ারে পেরিয়ে এসেছেন অনেকখানি পথ। প্যাভিলিয়নকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি কথা বলেছেন ২০১৮ এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, মেয়েদের ক্রিকেটের উত্থান, কভিড-১৯ মহামারি- সবকিছু নিয়েই...


    কোথায় আছেন, ঢাকায় নাকি ঢাকার বাইরে? 

    ঢাকাতেই আছি। পরিস্থিতি তো খারাপ হচ্ছে, সংক্রমণ বাড়ছে (করোনাভাইরাসের)। আমার এতো সাহস হয় নাই বের হওয়ার।

    ১০ জুন এশিয়া কাপ জয়ের দুই বছর হলো। ফাইনালে ১ বলে অপরাজিত ২ রানের ইনিংস, আপনার ক্যারিয়ারের সেরা? 

    আমার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। সেরা মুহুর্ত। সেরা জয়। সেরা অর্জন। একদম, সেরার মধ্যে সেরা ওই জায়গাটা। ওই মুহুর্তটা। ওই অর্জনটা। ওই ট্রফিটা।

    টেকনিক্যালি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অর্জন বলা যায় সেটিকে...

    আমার কাছে মনে হয়, আন্তর্জাতিক ট্রফি আমরা এনেছি, ছেলেরাও খুশি হয়েছে, বিসিবি খুশি হয়েছে, কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি- যেটা আকরাম স্যার, (নাইমুর রহমান) দুর্জয় স্যাররা এনেছিলেন। তারপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে প্রথম জয়, সেটা আলাদা। তারপর নাহয় আমাদের এই জায়গাটা দিতে পারি। আমি কখনোই বলব না, আমাদেরটা সবচেয়ে বড়। টেকনিক্যালি হতে পারে, তবে অতীত তো ভুলে যাওয়া যাবে না। আইসিসি ট্রফি কিন্তু আমাদের প্লাটফর্ম, সেটার কারণেই আমরা ক্রিকেট খেলতে পারছি। আবার অ-১৯-এর বিশ্বকাপটা যদিও তরুণদের হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, কিন্তু বিশ্বকাপ তো বিশ্বকাপই। দেখেন অ-১৯-এর এশিয়া কাপটা কিন্তু আমরা জিততে পারিনি, কতো অল্প লক্ষ্য (১০৭) ছিল ৫০ ওভারে। কিন্তু জিততে পারিনি ((ভারতের বিপক্ষে ৫ রানে হেরেছিল পরবর্তীতে বিশ্বকাপজয়ী আকবর আলির দল)। তারপর ছেলেদের কথা ধরেন, বেশ কয়েকবার অল্প রানের ব্যবধানে জেতা হয়নি। ভাগ্যের সহায়তা লাগে আসলে।

    পরপর দুইবার বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে গেছে বাংলাদেশ। তবে জেতা হয়নি একটি ম্যাচও। সমস্যাটা আসলে কোথায় বলে মনে হয়, মানসিক, নাকি অভিজ্ঞতার ব্যাপার? নাকি আপনার কথা অনুযায়ী স্রেফ ভাগ্য?

    আমাদের হেড কোচ, যিনি এখন নেই আমাদের, একটা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেখলাম বলেছেন, বড় জায়গায় আমরা টেম্পারমেন্ট ধরে রাখতে পারি না। সেটাই হলে আমরা কিন্তু এশিয়া কাপ জিততাম না। সেই মন্তব্য আমি প্রত্যাখ্যান করছি। এরকম মন্তব্য আশা করিনি উনার কাছ থেকে। আপনি যেটা বললেন, বড় জায়গায় কিন্তু আমরা প্রথমবার খেলছি না। এই বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা খেললাম ৪ বার। ৪ বার খেললেও আমরা যথেষ্ট অভিজ্ঞ। আমি আইপিএলে (টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জ) খেলে এসেছি। সেটাও বড় প্লাটফর্ম। ৫টা দেশ থেকে ক্রিকেটার করে একটা ক্লাব বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ঠিক করা হয়, যেখানে প্রতিনিধিত্ব করা হয়। সেখানে কিন্তু আরও কঠিন পারফর্ম করা, দ্রুত সবকিছু মেনে নেওয়া, দলের সবার সাথে বন্ডিং তৈরি করে খেলতে হয়। এখানে তো আমাদের দল ১০-১২ বছর একসাথে খেলছি, কিছু যাওয়া-আসা বাদ দিলে, কিছু শাফলিং হয়েছে। আমি এটার (কোচের মন্তব্যের) সাথে কঠোরভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। বড় প্লাটফর্মে আমরা ভয় পাই, এটা ঠিক না। এরকম করে ক্রিকেটারদের ওপর একটা দোষ চাপানো বা চাপ তৈরি করা ঠিক না, চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। সেটা কোচ দ্বারা হোক বা পাবলিক দ্বারা হোক।
     


    "বড় প্লাটফর্মে আমরা ভয় পাই, এটা ঠিক না।"


    আপনারা সাংবাদিক, আপনারা বুঝবেন। একটা প্লেয়ারের অ্যাটিটিউড কী। মনের কথা বুঝতে পারবেন না, কিন্তু সে আক্রমণাত্মক অবস্থায় আছে, নাকি চাপে আছে—এটা কিন্তু বুঝতে পারবেন। এবার বিশ্বকাপ আলাদা ছিল। হারমানের (হারমানপ্রিত কৌর) মতো প্লেয়ার; যে প্রতিবার কাঁপিয়ে দেয়, বিগব্যাশে কাঁপিয়ে দেয়—জেমিমা (রদ্রিগেজ), স্মৃতি মান্ধানা—ইন্ডিয়ার তিনটা স্টার প্লেয়ার কিন্তু পারফর্ম করতে পারে নাই (কৌর ৫ ম্যাচে করেছেন ৩০ রান, জেমিমা ৫ ম্যাচে ৮৫, স্মৃতি ৪ ম্যাচে ৪৯)। তারা ভয় পেয়েছে? না, এটা পার্ট অফ দ্য গেম। 

    আপনি শেফালি ভার্মাকে দেখেন, জীবনে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কাপ খেলেছে, আন্তর্জাতিক খেলছে, তাকে দেখে মনে হয়নি সে ভয় পেয়েছে। সে দারুণ খেলেছে (৫ ইনিংসে ৩২.৬০ গড়ে শেফালি করেছেন ১৬৩, ভারতের হয়ে টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। এটা আসলে যার যার ব্যাপার। আপনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থা দেখেন, ২০১৬ এর চ্যাম্পিয়ন, তারা গতবার কী করছে, এবার কী করছে, পাকিস্তানের কাছে হেরেছে। তার মধ্য থেকে শিমাইন (ক্যাম্পবেল) এবং (স্টেফানি) টেইলর- মারাত্মক ভাল ব্যাটসম্যান- তারা রান করতে পারে নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে তাকান, (মিগনন ডু) প্রিজ (৪ ম্যাচে ৩৫)- পারফর্ম করতে পারেনি। তারা ভয় পায়? না, এটা ‘পার্ট অফ গেম’। আপনি বিরাট কোহলিকে দেখেন। লকডাউনের আগে টানা ভাল করতে পারেনি (নিউজিল্যান্ড সফরে)। তার মানে ও ভয় পাচ্ছে? না। আমাদের খারাপ সময় গিয়েছে। আমাদের ওপর প্রত্যাশা ছিল সবার, আমরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিলাম, আমরা ভারত-পাকিস্তানকে হারিয়েছিলাম। আমরা বিশ্বকাপেও দুই-একটা ভাল দলকে হারাতে পারব, এমন প্রত্যাশা ছিল।

    সেটা পূরণ হয়নি… 

    তার মধ্যেও কথা রয়ে যায়। আমরা এশিয়া কাপ খেলার পর কোয়ালাইফাইয়ার খেলেছি। এরপর ২০১৯ চলে গেছে। ইন দ্য মিনটাইম, ভারত-অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে পাকিস্তান, এমনকি থাইল্যান্ড পর্যন্ত অনেক খেলেছে। তারা অস্ট্রেলিয়া গিয়ে দুই মাস কন্ডিশনিং ক্যাম্প করেছে, বিগব্যাশের দলগুলির সাথে ম্যাচ খেলেছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারত ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলেছে। সবকিছু কিন্তু আসলে এমনি এমনি হয় না। ওরা কিন্তু বসে ছিল না। আর আমরা কী করেছি? একটা ট্রায়াঙ্গুলার খেলেছি, যেখানে ভারতের ‘এ’ দলকে দুইটা ভাগ করা হয়েছে, সেখানে মূল ভারত দলের কেউই ছিল না। তারপর আমরা এশিয়ান গেমস খেলেছি। যেখানে গোল্ড পেয়েছি, শ্রীলঙ্কা অ-২৩ দলের সাথে, যেখান থেকে দুইটা খেলোয়াড় পরে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে। এটা কিন্তু যথেষ্ট না। তবে আমাদের হাতে কোনও উপায় ছিল না। এশিয়া কাপের আগে কিন্তু আমি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরকে কৃতিত্ব দিব। বোর্ডকে অনেক ধন্যবাদ জানাই, তারা অনেক কষ্টে ওই সিরিজ ব্যবস্থা করেছিলেন।

    ২০১৮ বিশ্বকাপের আগেও কিন্তু আমরা পাকিস্তানের সাথে খেলেছি। সেবার বিশ্বকাপে গিয়ে হারলেও আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে কিন্তু অনেক ভাল খেলেছিলাম।
     


    "২০১৮ বিশ্বকাপের আগেও কিন্তু আমরা পাকিস্তানের সাথে খেলেছি। সেবার বিশ্বকাপে গিয়ে হারলেও আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে কিন্তু অনেক ভাল খেলেছিলাম।"


    ২০২০ যাওয়ার আগে পাকিস্তানের যাওয়ার আগে একটা সিরিজ খেলেছিলাম, প্রায় মাস তিনেক আগে। তিনটা টি-টোয়েন্টি হারলেও একটা ওয়ানডে জিতে যাই। প্রতিটা ম্যাচ কম্পিটিটিভ ছিল। এর প্রতিফলন পেয়েছি বিশ্বকাপে। প্র্যাকটিস ম্যাচে কিন্তু পাকিস্তানকে হারিয়েছিলাম, আমি ৪ উইকেট পেয়েছিলাম। কারণ আমরা ওদের খেলার ধরন জানি।

    সব দলের সঙ্গে কিন্তু শুধু ভিডিও অ্যানালাইসিসে হবে না। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ওরা একে অপরকে জানে। ওরা ম্যাচ পায়। আমরা যেহেতু র‍্যাঙ্কিং ৮-এর বাইরে। আমরা তেমন পাই না। ঘন্টার পর ঘন্টা ভিডিও অ্যানালাইসিস আর মিটিং করে কিন্তু লাভ নাই। শুধু আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, কোথায় বোলিং করবেন আর কোথায় শট খেলবেন। তারপর আপনার কোচ আপনাকে পরিকল্পনা যেটা দেবে সেটা এক্সিকিউশন করতেই হবে। এগুলাই আমাদের ঘাটতি, দূর্বলতা। আমি এগুলাকেই বলব। এর সঙ্গে কন্ডিশনের একটা ব্যাপার আছে।


    আরও পড়ুন- এশিয়া কাপ ২০১৮ : স্বপ্নের সীমানা পেরিয়ে


    আমাদেরকে বিসিবি প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে বিশ্বকাপের আগে পাঠিয়েছিল ১০ দিনের একটা ক্যাম্প করানোর জন্য, কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। তবে মাত্র ৩ দিন অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। একদিন একটা সেন্টার উইকেটে ম্যাচ খেলেছি, তবুও উইকেট ভেজা ছিল। বাকি ২ দিন সাইড উইকেটে নেট করার সুযোগ পেয়েছি।

    বাকি দিনগুলিতে কী হয়েছিল?

    বাকি দিনগুলিতে বৃষ্টি। প্রচন্ড বৃষ্টি ছিল। সেখানে বাড়তি ইনডোর ফ্যাসিলিটিস নিতে হয়েছে বাড়তি খরচ করে, সময় নিয়ে। কিন্তু ইনডোর তো আমাদের এখানে আর ওখানে একই কথা। মূল কন্ডিশন, উইকেটের সঙ্গে তো মানিয়ে নেওয়া হলো না। কিন্তু এটা তো আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার, এই পরিস্থিতি তো আমাদের আওতার বাইরে। আমরা ৪টা খেলেছি, বলতে পারেন, প্র্যাকটিসসহ ৫টা, এর মাঝে একটা হয়নি, খেলেছি ৪টা ভেন্যুতে। একটা ম্যাচ খেলে উইকেট নিয়ে একটু ধারণা পাবেন, পরের ম্যাচে কাজে লাগাবেন, সে সুযোগও ছিল না। এরকম হয় আসলে। সবকিছু মিলিয়ে, সবকিছু তো আমাদের ব্যর্থতা এটা বলব না। কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তবে সবকিছু আমাদের ওপরই পড়বে। পরবর্তীতে সুযোগ পেলে ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার বাউন্স ব্যাক করার, এটাই আমাদের লক্ষ্য।
     


    "আমি অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্ট করেছি বোলিং নিয়ে সবগুলি কোচের মাধ্যমে। তবে আমার কাছে মনে হয়, শুরুতে যেটা শিখেছি, সেটাই করা উচিত। ‘বেসিকে স্টিক’ থাকা। সেটির ওপরই মনযোগ দেওয়া উচিত।"


    এ সময় আপনাদের খেলার মাঝে থাকার কথা ছিল। ঘরোয়া লিগ, এরপর বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। তবে কভিড-১৯ এ সবকিছু থমকে গেল। নিজেকে কীভাবে ফিট রাখছেন এ সময়ে, বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?

    আমার আসলে সরল ভাবনা সবকিছু নিয়ে। ইতিবাচক থাকতে পছন্দ করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে তো পুরো পৃথিবীই একটা সময়ে থমকে আছে। এরকম মহামারি তো ১০০ বছর পরপর আসে। আমরা এর মাঝে পড়ে গিয়েছি। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। সব দেশ খেলা শুরু করবে। আমি সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি, সময়ের সঙ্গে চলব। ফিট থাকা একটু কঠিন, যার বাসায় জিম ফ্যাসিলিটিস নেই। আমাদের জাতীয় দলের অনেক ভাইয়াদের বাসায় আছে, তারা ট্রেডমিলে রানিং করে ফিটনেস ধরে রাখছে, জিম করে বিল্ড আপ করছে বা ফিটনেসটা ধরে রাখতে পারছে। কিন্তু আমার মতো যারা- আমাদের কোনও মেয়ের বাসায় জিম ফ্যাসিলিটিস নাই। এজন্য ধরে রাখা মুশকিল। তবে যাতে খুব বেশি নষ্ট না হয়ে যায়, একটা ‘র লেভেলে’ থাকে, ‘মিনিমাম লেভেলে’ থাকে, সেটাই চেষ্টা করছি। কিছু ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে, সিঁড়ি আছে আমার বাসায়, সেটাই আপ-ডাউন করে, কিছু কাজ আছে- হাই ইনটেনসিটি। তারপর একমাস রোজা গেল, একটু কঠিন হয়ে গেছে। দুই-তিনদিন পরপর করেছি। এখনও করছি। কিছু কাজ আছে, তবে কঠিন। খেলা শুরু হলে একটু সময় লাগবে স্ট্রেংথ ও ফিটনেস আগের জায়গায় নিয়ে আসতে। তারপরও আমার মনে হয় এটা ১৫-২০ দিনের ব্যাপার। আমার নিজেকে নিয়ে যেটা মনে হয়। ফিটনেস নিয়ে আমি কনসার্ন। আমি পরিশ্রম করতে ভালবাসি। 

    একটা পেসার ১১-১২ বছর একই জায়গায় থাকা, দিনদিন উন্নতি করা— “নট এ মেটার অফ জোক”। ফিটনেস আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আলহামদুলিল্লাহ আমার শরীর ঠিক আছে। আমি খুব বেশি বিচলিত নই।

    বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেরই ৮ বছর হয়ে যাচ্ছে। পেসার হিসেবে এই পর্যায়ে এসে কীসের দিকে বেশি জোর দিচ্ছেন। আপনার আসলে মূল শক্তি কী মনে করেন, পেস নাকি ভ্যারিয়েশন?

    ৮ বছর হলেও, আন-অফিশিয়ালি আমরা শুরু করেছি ’০৭-এ, আমি শুরু করেছি ’০৮-এ। সে হিসেবে এক যুগ।

    এটা আসলে ‘সেনসিটিভ কোয়েশ্চেন’। ভ্যারিয়েশন নিয়ে চিন্তা করা… যতদিন যাচ্ছে, সব বদলে ফেলা হয়, উন্নত হয়। আমরাও করছি। আপনারা দেখলেও বুঝবেন, হয়তো আমরা সফল হই না, তবে ভ্যারিয়েশন আনার চেষ্টা করছি। আমি ভ্যারিয়েশন আনার চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সেসব অ্যাপ্লাই করেছি, সফলও হয়েছি। পাকিস্তানে মাশাআল্লাহ প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছিলাম দল হারার পরও। সাফল্য পেয়েছি তাই। স্ট্রেংথ বোলিং- এভাবেই করে যেতে চাই।
     


    "বাবা-মা চায় যে মেয়ে ভাল পড়াশুনা করবে, চাকরি করবে, ব্যবসা করবে। কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠিত মেয়ে যদি ভাল আয় করে এখান থেকে, তাহলে কিন্তু বাবা-মায়ের অভিযোগ থাকবে না। আর দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর কই বলুন!"


    তবে যেটা হয়, কোচ একেকজনের একেক রকম ভাবনা থাকে। কঠিন হয়ে যায় পেসারদের, স্পিনারদেরও হয়, সবারই হয়, ব্যাটসম্যানেরও হয়। কারও ব্যাকলিফট পয়েন্টের দিকে থাকবে, কারও গ্রাউন্ডের দিকে। কিন্তু কোচ চাইবেন যাতে তার স্টাইলেই সবাই খেলেন। এটা মুশকিল হয়ে যায়। এর থেকে যে বেরিয়ে আসবে, সেই ‘গেইনার’।

    আমি অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্ট করেছি বোলিং নিয়ে সবগুলি কোচের মাধ্যমে। তবে আমার কাছে মনে হয়, শুরুতে যেটা শিখেছি, সেটাই করা উচিত। ‘বেসিকে স্টিক’ থাকা। সেটির ওপরই মনযোগ দেওয়া উচিত। সব কোচ যে একই রকম এক্সপেরিমেন্ট করে তা না। অনেকেই বলে যে প্লেয়ার যা করছে, সেটা দিয়ে পারফর্ম করলেই হবে। আলাদা আলাদা থাকে। তার মধ্য থেকে ভাল করে পারফর্ম করে হার্ডওয়ার্ক করে বের হয়ে আসতে হবে।

    কোচের প্রসঙ্গ যখন আসলই, কোচ চলে গেছেন আপনাদের। তার সময়ে এশিয়া কাপে আপনারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, বিশ্বকাপে ভাল পারফর্ম করতে পারেননি। চুক্তি শেষের পর একরকম যোগাযোগের ঘাটতির মাঝেই চলে গেছেন তিনি...

    কোচ বিষয়ে আমার বলার কিছু নাই। বোর্ডের ব্যাপার। বোর্ড ভাল জানবে। বোর্ড আমাদের গার্ডিয়ান। আমাদের জন্য কোন কোচ রাখবেন, কাকে রাখবেন না। দেখুন, এশিয়া কাপে উনি আমাদের অনুশীলন করান নাই। একটা নতুন কোচ একদিনেই সবার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, সেটা নয়।

    এর মাঝে জিতেছি। এর মাঝে হাবুডুওবু খেয়েছি। এর মাঝে ক্লোজ ম্যাচ জিতেছি, আমি ভাল বোলিং করেছি। আমাদেরকেও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো দলের এতো খারাপ অবস্থা কেন হবে? ভাল খেললেই কোচদের প্রশংসা, খারাপ খেললেই আমাদের বিপক্ষে যাবে, তা নয়। আমি কোচের ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না, নিজের টুর্নামেন্টে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা ব্যাখ্যা করতে পারব।

    আপনি এশিয়া কাপের গল্প বলতে গিয়ে বলছিলেন, ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির কোনও তুলনা হয়না, সেটিই প্লাটফর্ম গড়ে দিয়েছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে আপনারা খেলতে পারছেন। মেয়েদের ক্রিকেটের কথা ভাবলে এদেশে কিন্তু আপনাদের দলটিও সেরকমই। অনেকদূর এগিয়েছে দল, তবে ক্যারিয়ারশেষে বাংলাদেশকে কোথায় দেখে যেতে চান? 

    আমি বরাবর চাই- আমাদের দল শীর্ষ চারের মধ্যে আছে এটা দেখতে। এর মধ্যে থাকলে টি-টোয়েন্টিতে (বিশ্বকাপে) তো কোয়ালিফাই (বাছাইপর্ব খেলার) করার দরকার পড়েই না, ওয়ানডেতেও পড়ে না। আমার স্বপ্ন, দল শীর্ষ চারে থাকুক। আর সারা বছর খুব ব্যস্ত থাকুক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে বছরজুড়েই। যতো ম্যাচ খেলবে, ততো অভিজ্ঞতা বাড়বে। ততো জয়ের সংখ্যা থাকবে। হারজিতের তুলনা করতে পারবে। উইমেনস টিম এখন যথেষ্ট পেশাদার। আমি নিজেকে পেশাদার ক্রিকেটারই দাবি করি, বা বলব। এজন্য যে, যে আয় করি, তাতে আমার নিজের ভালভাবে চলে যায়। আমার যেহেতু চলে যায়, সেহেতু আমি যথেষ্ট আয় করি। 
     


    করোনাভাইরাস মহামারিতে দুঃস্থদের সহায়তায় জাহানারা/ জাহানারার ফেসবুক পেইজ


    আমার মনে হয়, যদি বছরজুড়ে এভাবে খেলতে থাকে, উইমেনস টিমকে তো পেছনে ফিরে তাকাতে হবেই না, এর ওপর বাবা-মারা বাধ্য হবে মেয়েদের ক্রিকেট খেলতে দিতে। বাবা-মা চায় যে মেয়ে ভাল পড়াশুনা করবে, চাকরি করবে, ব্যবসা করবে। কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠিত মেয়ে যদি ভাল আয় করে এখান থেকে, তাহলে কিন্তু বাবা-মায়ের অভিযোগ থাকবে না। আর দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর কই বলুন! সহজ রাস্তা এটি সেদিক থেকে, এর থেকে বড় সম্মান আর হয় না। স্বদেশপ্রেম, আমাদের ধর্মেও তো আছে। সম্মান বয়ে নিচ্ছি, পতাকা বয়ে বেড়াচ্ছি। হারলে মন খারাপ করে সবাই, “ইশ বাংলাদেশ হারছে”। আর জিতলে যে কখনও খেলাই দেখেনি, তার মুখেও একটা হাসি ফোটে। এটাই কিন্তু সবকিছুর পেছনের কারণ। 

    একজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, যার দাবি তিনি ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি দেখেছিলেন মালয়েশিয়ায় বসে। আপনারা যখন এশিয়া কাপ জেতেন, সেদিনও তিনি কাজ করেননি, বাংলাদেশের খেলা থাকলেই সেটি করেন। আপনারা জেতার পর মিষ্টি বিলিয়েছিলেন...

    এগুলাই পাওয়া। দেশের জন্য খেলি অবশ্যই। এরপর কিন্তু জনগণের মুখে হাসি ফোটানো। খারাপ খেললে তারা কটু কথা বলবে এটা স্বাভাবিক। তাদের প্রত্যাশা আছে। এটা নিয়ে আমি মন খারাপ করি নাই। সামনে করবোও না ইনশাল্লাহ। এটা আমার অনুপ্রেরণা।
     


    "প্রশ্ন হলো, আমরা কি বোর্ডকে ঠিকমতো ফিরিয়ে দিতে পারছি? আমরা কি শুধু নিয়েই যাব? বিনিময়ে কিছু দেব না? শুধু একটা এশিয়া কাপই হয়ে যাবে সম্মান? আমাদের তো আর বড় জয় নেই। এতো বছরের ক্যারিয়ারে আমাদেরও তো কিছু দেওয়া উচিত।"


    শেষ একটি প্রসঙ্গ। গত বছর যখন ছেলে ক্রিকেটাররা আন্দোলনে গেলেন, পরে মেয়েদের বেতন-ভাতা নিয়েও একটি দাবি ছিল। সেসব কতোখানি পূরণ হলো, আর সম-অধিকারের দিক দিয়ে কতোখানি এগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের ক্ষেত্রে?

    বোর্ড অবশ্যই সহায়তা করেছে, প্রতিদিন উন্নতি হচ্ছে এসবের। আমরা যা দিচ্ছি, বোর্ড এর চেয়ে বেশি দিচ্ছে। আমরা না চাইতেই সব এসে যাচ্ছে। আমরা খুশি। আগেও বলেছি, বোর্ড আমাদের অভিভাবক। আমাদের ভাল-মন্দ দেখবেন, দেখছেন। ছেলেদের মতো স্ট্রাইক করারও প্রয়োজন পড়ে না। এটা আমার মত, দলের সবাই একমত হবে আমার সঙ্গে আমার মনে হয়।

    আমি সন্তুষ্ট। লকডাউনের মধ্যেই দেখেন। খেলাধুলা বন্ধ, দরকার ছিল না, কিন্তু বোর্ড দিয়েছে। ছেলেদের ৩০ হাজার টাকা করে দিয়েছে, মেয়েদের ২০ হাজার করে দিয়েছে। খুব বেশি পার্থক্য কিন্তু না। কিন্তু দিয়েছে। ছেলেরা অনেক পায়, মেয়েরা ক্লাব থেকে এতো পায় না। সেখানে মেয়েদেরও টাকা দিয়েছে, আমার এটা প্রত্যাশার বাইরে ছিল। তারপর ঈদের উপহার হিসেবে একটা পরিমাণ দিয়েছে প্রত্যেককে। এটা কিন্তু কোচদেরও উপহার দিয়েছে। বোর্ড তাদের জায়গা থেকে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি বোর্ডকে ঠিকমতো ফিরিয়ে দিতে পারছি? আমরা কি শুধু নিয়েই যাব? বিনিময়ে কিছু দেব না? শুধু একটা এশিয়া কাপই হয়ে যাবে সম্মান? আমাদের তো আর বড় জয় নেই। এতো বছরের ক্যারিয়ারে আমাদেরও তো কিছু দেওয়া উচিত।

    দুই দুইবার এশিয়ান গেমস খেললাম, রৌপ্য পেয়েছি। গোল্ড পাই নাই। চোখের পানিতেই কি হয়ে যাবে সবকিছু? না হবে না। আর এবার এসএ গেমসে গোল্ড জিতেছি। শুধুমাত্র একটা অঞ্চলে। নেপালের সঙ্গে দুজন সেঞ্চুরি করলাম, আর ৪-৫টা করে উইকেট পেলাম, এগুলো কিন্তু তেমন অর্থ বহন করে না। আমাদের লক্ষ্য কি, সেটা ঠিক করতে হবে। বিশ্বকাপে আগে যাই, সেমিফাইনাল-ফাইনাল খেলি, তখন কিছু চাওয়ার চিন্তা করবো। তার আগে আমার মনে হয় না, আমাদের চাওয়ার কিছু থাকবে। আমরা কিন্তু চাই নাই, না চাইতেই এশিয়া কাপে ২ কোটি টাকা পেয়েছি। ছেলেরাও না চাইতেই পায়, আমরাও পাই। এটাই আসলে আমার কাছে ‘মেটার’ করে। 

    কভিড-১৯ মহামারিতে মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন আপনি। সে কারণে আলাদা একটা ধন্যবাদ... 

    ধন্যবাদ। আপনারাও যতোখানি পারবেন, করবেন।