দীপ নেভার আগে...
বসন্তের পড়ন্ত বিকেল। দিনাজপুরের বড় ময়দানের বিস্তৃত সবুজের ওপাশে হেলে পড়ছে সূর্যটা।
শহীদ মিনারের পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় পঞ্চাশের ওপরে কিশোর, তরুণ। একটু আগে প্র্যাকটিস শেষ হয়েছে তাদের। চলছে শেষ ‘ব্রিফিং-সেশন’।
‘আমাদের একাডেমির ছেলে সব।’ সনজিত সাহা দীপ যেন ফিরে যান তাঁর এরকম দাঁড়িয়ে থাকার দিনগুলিতে। প্রচেষ্টা ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের দিনগুলিতে। পরদিন ঢাকা যাবেন। এশিয়া কাপের পর তাঁর অ্যাকশন ‘শোধরানোর’ কাজ শুরু হবে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ ‘সোহেল স্যার’ আর মোহাম্মদ সালাউদ্দীনের অধীনে শুরু হবে সনজিতের নিজেকে ফিরে পাওয়ার লড়াই।
সোহেল স্যার তাঁকে ফোন দিয়ে নাকি বলেন, ‘কিরে ফ্রি আছিস?’
সনজিত হাসেন। তাঁর স্যারের কথা শুনে। দলের সঙ্গে ছিলেন না বিশ্বকাপের ঢাকা অংশের শুরু থেকে, চলে এসেছিলেন দিনাজপুর। সেখানেই ছিলেন ৫ তারিখ থেকে। অ্যাকশন নিয়ে সমস্যা তাঁর, ‘গরজ’টা তো তাঁরই বেশী হওয়ার কথা! উল্টো স্যার কিনা তাঁকে এমন করে বলেন! সোহেল স্যারের কথা উঠলেই সনজিত বারবার মনে করিয়ে দেন, ‘আমার ক্রিকেট জীবনে স্যারের অবদান অনেক। আসলেই অনেক।’
যেমন এটাও বলেন, তিনি ক্রিকেটার হিসেবে এতদূর এসেছেন মূলত বোলিং অ্যাকশনের কারণেই! জাতীয় লিগেও শুধু নাসির হোসেন খেলবেন বলে এক ম্যাচ বসে ছিলেন, তা বাদে অভিষেকের পর খেলেছেন সব ম্যাচেই। কী ঘরোয়া, কী আন্তর্জাতিক যুব পর্যায়ের ম্যাচ, সনজিতের বোলিং পড়তে কষ্ট হয়েছে সব ব্যাটসম্যানেরই। একবার এক কোচ ‘উদ্যোগ’ নিয়েছিলেন সনজিতকে ‘অর্থোডক্স’ বানানোর। খোদ বিসিবি থেকেও আপত্তি এসেছিল। সনজিত তাই আন-অর্থোডক্সই রয়ে গেছেন! সামনে অ্যাকশন শোধরানোর যে মিশন, তাতেও শুধু হাত বাঁকানোটা যতোটা কমানো যায়, চেষ্টা করা হবে তা।
শুধু বোলিংয়ে নয়, ব্যক্তিগতভাবেও কিছুটা ‘আন-অর্থোডক্স’ সনজিত। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচের পরই অ্যাকশন ‘সন্দেহজনক’ হলো, দ্বিতীয় ম্যাচ শুরুর আগে তো বোলিং করা থেকে বিরতই রাখা হলো তাঁকে। আগে এতটা কড়াকড়ি ছিল না, তবে এবারের বিশ্বকাপ দিয়েই যেন আইসিসি একটু বেশী করে নড়েচড়ে বসেছে অ্যাকশনজনিত ব্যাপারে!
সনজিত ভেঙ্গে পড়েননি। চট্টগ্রাম থেকে দলের সঙ্গেই কক্সবাজার গিয়েছেন। সতীর্থ বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করেছেন! সতীর্থরা অবাক হতেন। কেউ কেউ তো মুখ ফুটে বলেও ফেলেছেন, ‘তোর জায়গায় আমি থাকলে তো একেবারেই ভেঙ্গে পড়তাম রে দোস্ত!’
সনজিত এটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ‘আমি আসলে ক্রিকেটকে ওইভাবে প্রফেশনালি নিইনি কখনও! এটা তো আমার কাছে খেলাই। আমি খেলতে ভালবাসি!’ তবে একটু আগে বা পরে এটাও বলেন, ‘ক্রিকেট ছাড়া তো আপাতত কিছু করার নেই! দেখি, কতদূর হয়!’
সতীর্থদের সঙ্গে যতক্ষণ থাকতেন, অসুবিধা হতো না মোটেও। দলের যারা সতীর্থ, তাদের বেশীরভাগই তো তাঁর বন্ধু। একসঙ্গে আছেন কতদিন! তবে বিপত্তিটা হতো হোটেলে ফিরে। ‘সিঙ্গেল রুম’-এ থাকতেন। ম্যানেজারের কড়া আদেশ ছিল, ফেসবুকে ঢোকা যাবে না, পত্রিকা পড়া যাবে না, টেলিভিশন দেখা যাবে না। তবুও মনের ভুলে টেলিভিশন সেট অন করলে একটু ‘বিরক্ত’ই হতেন সনজিত। বাংলাদেশী সব চ্যানেলে যে ঘুরেফিরে ওই খবরটাই আসে! অনেক সংবাদমাধ্যমে তো এটাও প্রচার করা হলো, কোনো কোনো ডেলিভারিতে নাকি সনজিতের বোলিং অ্যাকশন ৪৫ ডিগ্রির সীমাও স্পর্শ করে! অথচ আইসিসির পাঠানো ই-মেইলে শুধু ‘১৫ ডিগ্রী এর অধিক’-এর কথাই বলা আছে। অনেকেই আবার বললেন, সনজিত নাকি ‘দুসরা’ করতে গেলেই অ্যাকশনে গড়বড় হয়! সনজিত অবাক হয়েই বলেন, ‘আমি দুসরা করতে পারলে তো এখনই জাতীয় দলে খেলতাম!’
বড়মাঠের সেই সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ে কেউ এসে যখন মোবাইল সেটের ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেন, সনজিত তখনও একটু ‘অস্বস্তি’তে ভোগেন। ‘আমার ছবি তোলার কী আছে! আমি কি জাতীয় দলে খেলি? আমি তো কিছুই না!’
সনজিত জানেন, জাতীয় দলটাই মূল। নিজেই বলেন, যে রাস্তা ধরে স্বপ্নের পথে এগুচ্ছিলেন, একটু হোঁচট খেয়েছেন সে যাত্রায়। ‘ট্র্যাক থেকে পিছিয়ে যাওয়াটা সুবিধার নয়। বছরখানেক পিছিয়ে গেলাম। বেশ খানিকটা এগিয়েছিলাম। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।’ সনজিত হতাশ। সনজিত আবার জীবনের দর্শনটাও যেন বুঝে ওঠেন, 'এখন হয়ে(বোলিং অ্যাকশন নিষিদ্ধ হয়ে) ভালই হয়েছে। পরে হলে তো ফিরে আসার সুযোগ থাকতো কম!'
ব্যাটিংয়ের দিকে এই সুযোগে আরেকটু মনোযোগ দেবেন নাকি সনজিত, এমন প্রশ্ন ‘রসিকতার’ সুরে করলেও আগের মতো করেই বলেন, ‘সেটা তো করতেই হবে। শুধু একটা (বোলিং বা ব্যাটিং বিভাগ) দিয়ে তো টিকে থাকা কঠিন।’ সনজিতের সামনেই আসলে একটু কঠিন সময়। এ সময়টাতে পরিবারের সমর্থন অবশ্য পুরোদমে পাচ্ছেন। ‘আমার পরিবারে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা। আমার যা ইচ্ছা, সেটাই করতে বলা হয় আমাকে।’
নিজের ইচ্ছাতেই সনজিত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে ক্রিকেটে এসেছিলেন। নিজের ইচ্ছাতেই আবার পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে চেয়েছেন, খেলার পাশাপাশি। তবে সুবিধা হয়নি খুব একটা! বেসরকারী এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা-প্রশাসনে শেষ করতে পেরেছেন মাত্র একটা সেমিস্টার। নতুন সেমিস্টার শুরু হতেও ঢের দেরী।
ঢাকায় গিয়ে আপাতত তাই অ্যাকশন শোধরানোর মানসিক প্রস্তুতিই নেবেন হয়তো! তবে একাডেমিতে থাকবেন না। ‘ওখানে তো কেউ নেই এখন। সবাই চলে গেছে। একা একাই থাকতে পারবো না!’ সবাই বলতে তাঁর সতীর্থরা, তাঁর বন্ধুরা। যে বন্ধুদের সবার সঙ্গে সনজিতের ফোনে কথা হয়েছিল, সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের পর। তাঁদের তখনকার মানসিক অবস্থা জানতে চাইলে সনজিত একটু হাসি এনে বলার চেষ্টা করেন, ‘হতাশ তো হবেই!’ হয়তো মুখ ফুটে এটা বলতে পারলেন না, তিনিও কতখানি হতাশ ছিলেন তখন!
সনজিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। সঙ্গে থাকা বন্ধুসুলভ বড় ভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি করেন। তাঁর ‘বাপ্পী দা’কে এরই মাঝে হাত নেড়ে বিদায় জানান। ওদিক থেকে ডাক আসে। বন্ধুদের ডাক। সনজিত আড্ডায় যাবেন। ‘আসতেছি’ বলে আবার কথা শুরু করেন। লিটন দাস এখন জাতীয় লিগ খেলতে কক্সবাজারে আছেন সে কথা, ‘মিঠু ভাই’ ডিভিশনাল কোচ হয়ে চট্টগ্রামে গেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নিয়ে সে কথা, প্রতিবেশীর বিয়ের কথা।
ওদিক থেকে আবার ডাক আসে। সনজিত বিদায় নিয়ে চলে যেতে থাকেন। উল্টো ঘুরে একটু আগের করা ‘মজা’র জবাব দেন। সনজিত যান একটা ব্যানারকে পাশ কাটিয়ে। যে ব্যানারে ছবি হয়ে একপাশে লিটন দাস, আরেকপাশে আছেন তিনি।
বড়মাঠে তখন ঝুপ সন্ধ্যা নেমেছে। সনজিত আঁধারের মাঝে দিয়ে যান। ক্রিকেটীয় জীবনের এখনকার মতোই এক ‘আঁধার’-এর মাঝ দিয়ে। নাকি আঁধারকে আদতে পেছনে ফেলেন তিনি!
সনজিত, দিনাজপুরের কাছে যিনি দীপ, তাঁর সামনে হয়তো অপেক্ষা করে আছে এক অদ্ভূত আলোক-পাথার! তিন-চার মাস পর চেন্নাই বা অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাকশনের ‘টেস্ট’ দেয়ার পর হয়তো মিলবে সে আলোকছটার আভা!
বড়মাঠের ওপাশে ডুবে যাওয়া সূর্যটা যে সন্ধ্যার আঁধার এনেছে, পরদিন এপাশে ওঠা সূর্যটাও যেমন ঠিক আলো বয়ে আনবে!