• বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ ২০২০
  • " />

     

    ক্রিকেট ফেরার সঙ্গে যে দিনটা ডিরেক্ট থ্রো, দারুণ ক্যাচের মিশেলে ফিল্ডিংয়েরও

    ক্রিকেট ফেরার সঙ্গে যে দিনটা ডিরেক্ট থ্রো, দারুণ ক্যাচের মিশেলে ফিল্ডিংয়েরও    

    মাহমুদউল্লাহ ডাইভ দিলেন। বলটা প্রায় বাউন্ডারি ছুঁয়ে ফেলেছিল, শেষমুহুর্তে সেটিকে ভেতরে রাখতে পারলেন তিনি। ডাইভের মোমেন্টামে ওপারে বেশ খানিকটা গড়িয়ে গিয়ে থামতে হলো তাকে। তিনি ছুটেছিলেন মিড-অন থেকে, আফিফের শটটা আটকাতে। এপাশে এসে আবারও বলটা ধরে থ্রো করতে হলো না, ততক্ষণে মিড-অফ থেকে আমিনুল ইসলাম বিপ্লব ছুটে এসেছেন, যদিও একটু দেরিতেই। 

    বিপ্লবের থ্রোটা যুতসই হলো না ঠিক, ক্রিজের মাঝামাঝি থেকে বোলার এবাদত হোসেন সেটা ধরে দিলেন উইকেটকিপার নুরুল হাসান সোহানের দিকে। ততক্ষণে আফিফের সঙ্গে নাজমুল হোসেন শান্তর ক্রিজের মাঝপথে একটা ছোটখাট সংঘর্ষ হয়ে গেল, যেটি আরও বড় ধরনের কিছু হতে পারতো। দুজনই তাকিয়ে ছিলেন বলের দিকে, একজন আরেকজনের পথে এসে গেছেন, যেটি শেষমুহুর্তে আচমকা আবিষ্কার করেছেন তারা। সে সংঘর্ষ ছাপিয়ে আফিফ ক্রিজে পৌঁছালেন সোহান স্টাম্প ভাঙার আগেই। আফিফের প্রথম স্কোরিং শটে এলো চার রান। 

    মাহমুদউল্লাহর সেই ফিল্ডিং কার্যত কাজে আসলো না, বাউন্ডারি বাঁচালেও চার রান তো ঠেকাতে পারলেন না। রান-আউটটাও হলো না। তবে তার দারুণ প্রচেষ্টার প্রশংসা না করে উপায় আছে? তার এই ফিল্ডিং শেষে আফসোসটাই বাড়িয়ে দেবে হয়তো, যদি একটা প্রভাব স্কোরবোর্ডে রাখতে পারতো এটি! 

    এমনিতে বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপের এই ম্যাচের লিস্ট ‘এ’ মর্যাদা নেই, ফলে স্কোরবোর্ডে কিছু জমা হলেও রেকর্ডবুকে এটি ‘আলাদা’ ম্যচ হিসেবেই থাকবে। টুর্নামেন্ট ঘিরে বিসিবির আয়োজনের কমতি নেই, তবে দিনশেষে এমন একটা আবহে ক্রিকেটারদের ফেরানো হলেও খুব বেশি চাপ দিতে চান না তারা। এক দলে তাই ১২ জন করে খেলানো যাবে, মানে চাইলেই একজনকে বোলিং করিয়ে ব্যাটিং করানো যাবে আরেকজনকে দিয়ে। নাজমুল একাদশে আল-আমিন হোসেন যেমন বোলিং করলেন, তবে প্রয়োজন পড়লে তার বদলে আরেকজনকে ব্যাটিং করানো যেতো। তবে এসব কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীতায় প্রভাব ফেললো না প্রথমদিন। তোহিদ হৃদয়ের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহদের একটা আবেদনই বলে দিচ্ছিল, ‘সিরিয়াসনেস’-এর মাত্রাটা।
     


    হৃদয়-শুক্কুরের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে মুগ্ধতা ছিল ফিল্ডিং নিয়ে/বিসিবি


    কিন্তু সেই আবেদন ছাপিয়েও প্রথমদিন ফিল্ডিংয়ে সিরিয়াসনেসটা যোগ করলো বাড়তি মাত্রা। মুশফিকুর রহিম কীভাবে এবাদত হোসেনের অত ফুললেংথ ও অত বাইরের বলটা স্টাম্পে ডেকে আনলেন, সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ানোর আগে-পরে, তৌহিদ হৃদয়-ইরফান শুক্কুরের অপ্রত্যাশিত-কিন্তু-অসাধারণ জুটির আগে, মাহমুদউল্লাহর আরেকটি ‘নিস্ফলা’ ফিফটির আগে-পরে ফিল্ডিংয়ে এ দিনটা আলাদা করে মনে রাখার মতো। 

    শুরুটা করেছিলেন রিশাদ হোসেন। এমনিতে লেগস্পিনারদের অন্তত ৫ ওভার বোলিং করানোর অলিখিত নিয়ম তার দিকে একটু বাড়তি নজর আশা করছিল, কিন্তু লম্বা-চড়া এই বোলার ফিল্ডিংয়ে ছাপটা রাখলেন স্পষ্টতই। সার্কেলে দারুণ কিছু সেভ করলেন, আর হাইলাইটস হয়ে থাকলো নাইম শেখের রান-আউটটা। 

    লিটন দাস পয়েন্টে খেলে সিঙ্গেলের জন্য ছুটেছিলেন, নাইমও সাড়া দিয়েছিলেন। একটু ব্যাকওয়ার্ডে থাকা রিশাদের বল পিক-আপ থেকে শুরু করে তাক করে এক স্টাম্প ভাঙা পর্যন্ত ব্যাপারটা দেখার আকাঙ্খাটা আসলে একবার ক্যামেরা পজিশনিংয়ে বেশ উঁচুমানের স্ট্রিমিংয়েরও ইন্সট্যান্ট রিপ্লেতে ঠিক পোষায় না। অতি উচ্চমানের কাজ যে সেটি! বাকি দুই স্টাম্প অক্ষত রেখে এক স্টাম্প গোত্তা খেলো বারকয়েক, শুধু বোলারদের ক্ষেত্রে নয়, পয়েন্টের মতো পজিশন থেকে ফিল্ডারের এমন কর্মও তো দৃষ্টিসুখকর। 

    শান্তর থ্রোয়ের ট্র্যাজেকটরিটা অবশ্য একটা ডেলিভারির মতোই ছিল। এবার মাহমুদউল্লাহ পয়েন্টে খেলে সিঙ্গেল নিতে গিয়েও আটকে গেলেন, সোহান নন-স্ট্রাইক প্রান্তে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে থ্রোটা সেদিকে করলেন আফিফ। স্টাম্প ভাঙলো, তবে সোহান বাঁচলেন। মাহমুদউল্লাহ ওভারথ্রোয়ে রানটা নিতে গেলেন এরপর। মিসফিল্ড, ওভারথ্রো-- রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের জন্য সুযোগের সঙ্গে আনে বিপদও। সে বিপদেই পড়লেন সোহান। 

    আফিফের থ্রো স্টাম্প এলোমেলো দিক পরিবর্তন করে গেল ঠিক পেছনে, শান্ত সেটি ধরে তাক করলেন স্ট্রাইক প্রান্তে। একটা ডেলিভারি হিসেবে ভাবলে বলটা গিয়ে পড়ল লেংথে, আঘাত করলো মিডল-লেগের টপে। দুই দিকে স্টাম্প ভাঙা, শান্ত ছুটছেন, একজন লাফিয়ে এলেন একদিনের বিধ্বস্ত স্টাম টপকে সে উচ্ছ্বাসে সামিল হতে। মিরপুরে দর্শক থাকলে সে উচ্ছ্বাস নিশ্চিতভাবেই গিয়ে লাগতো তাদের কাছে। 

    মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটিটা থিতু হচ্ছিল সোহানের, শান্তর থ্রোতে স্টাম্পের মতো এলোমেলো হয়ে গেল সেটি। লিটন-নাইমের জুটি যেমন জমার আগেই ভেঙেছিল রিশাদের থ্রোতে। 

    ফিল্ডিংয়ে এরপরের মুগ্ধতা মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধকে ঘিরে। সাব্বির রহমান তার লেগস্টাম্পের প্রায় বাইরের বলে লিডিং-এজড হওয়ার সামর্থ্য দেখালেন, তবে তার ‘কুৎসিত’ শটটা ভুলে যেতে সময় লাগলো না ওই মুগ্ধর কারণেই। ফলো-থ্রুতে থাকা অবস্থায় বাঁদিকে ঝাঁপ দিলেন মুগ্ধ, সাব্বিরের অমন শটের শাস্তিটা দিলেন নির্মমভাবে। 


    প্রথম ম্যাচে সেরা ফিল্ডার হয়েছেন রিশাদ/বিসিবি


    সাব্বির পরে ফিল্ডিংয়ে দায়মোচনের চেষ্টা করলেন। মাহমুদউল্লাহকে ফ্লিক করেছিলেন আফিফ গ্যাপ দেখেই, তবে ডানদিকে ডাইভ দিয়ে সে গ্যাপ পূরণ করে দিলেন সাব্বির শর্ট মিডউইকেটে। আফিফের চোখে অবিশ্বাস, সেটির পেছনে যে সাব্বিরের অমন ফিল্ডিংয়েরও একটা প্রভাব আছে, তা তো না বললেও চলে। রানতাড়ায় আরেকবার চাপে পড়লেন তারা। 

    সে চাপটা শুরুতে আরেকটু আগেই আসতে পারতো, যদি সাইফ জীবনটা না পেতেন। কাভারে ক্যাচ তুলেছিলেন, মোটামুটি সহজ ক্যাচটা কেমন করে জানি ফেলে দিলেন লিটন দাস। সোহান কিপিং করছিলেন বলে ফিল্ডিং করছিলেন তিনি, তবে আউটফিল্ডে তিনি ভাল নন, এ কথা তো বলার উপায় নেই। লিটন সেই ক্যাচ মিসের পরও বেশ কিছুক্ষণ যেন মুষড়ে গেলেন, তার শরীরি ভাষায় বলে দিচ্ছিল সেটি। সাইফ অবশ্য আর মাত্র ৪ রান করেই ফিরেছেন, লিটনকে একরাশ স্বস্তি দিয়ে। 

    লিটনের সেই মিস বাদ দিলে পরের ইনিংসে সাব্বিরের সেই ক্যাচের আগেই দারুণ আরও কিছু করে দেখিয়েছেন রাকিবুল হাসান। অ-১৯ বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটাররা এ টুর্নামেন্টে কেমন করেন, সেটির দিকে চেয়ে আছেন হয়তো অনেকেই। হৃদয়ের ব্যাটিং প্রথমদিন আশা জোগালো, রাকিবুল নিজেও বিশাল ও তীক্ষ্ণ এক টার্নে শান্তকে বোল্ড করলেন। তবে এর আগে ছাপ রাখলেন ফিল্ডিংয়ে। 

    এবাদতের লাফিয়ে ওঠা বলটায় ব্যাট চালিয়েছিলেন সৌম্য, সে ওভারে বেশ চুপচাপই ছিলেন। ডিপের পয়েন্ট বেশ স্কয়ারে, ডিপ থার্ডম্যান মোটামুটি ফাইনে, এর মাঝে গ্যাপটা দেখেছিলেন। টাইমিংটা ভালই হলো। তবে বলের ট্র্যাজেকটরির প্রায় সমান্তরালে ছুটে এলেন রাকিবুল, শেষ মুহুর্তে ডাইভটাও দিলেন পারফেক্ট। মিরপুরের আকাশে প্রায় চিল দেখা যায়, এদিক-উড়তে থাকা তাদের কেউ রাকিবুলের ক্যাচটা দেখলে হয়তো একটু হিংসায় করে নিয়েছে। সৌম্য যাওয়ার পথেও পেছন ফিরে তাকিয়ে যেন বুঝার চেষ্টা করলেন, আদতে কী হলো ঘটনাটা। 

    ম্যাচশেষে অবশ্য সৌম্য জয়ীদের দলে, রাকিবুল-সাব্বিররা পরাজিতদের। তবে বেশ লম্বা বিরতির পর ক্রিকেটারদের ফিটনেস যখন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে থাকার কথা, হৃদয়-শুক্কুরের আগে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ে যখন দীর্ঘদিনের বিরতির ছাপ, তখন সিরিয়াস ম্যাচের আবহে ফিল্ডারদের এমন ফিল্ডিং তো স্বস্তির, সঙ্গে আশাজাগানিয়াও। 

    ম্যাচশেষে সেরা ফিল্ডারের প্রাইজমানিটা জিতলেন রিশাদ, কিন্তু এ দিনটা ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ছিল দারুণ। ২০৯ দিনের বিরতির পর হয়তো সেটা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছুই।