• আইসিসি মেয়েদের বিশ্বকাপ
  • " />

     

    ক্রিকেট ও মাতৃত্ব: বিসমাহ মারুফ ও আরও ওয়ান্ডার ওম্যানদের গল্প

    ক্রিকেট ও মাতৃত্ব: বিসমাহ মারুফ ও আরও ওয়ান্ডার ওম্যানদের গল্প    

    দৃশ্য এক

    চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে লড়াইয়ের মঞ্চ প্রস্তুত ছিল মাউন্ট মঙ্গানুইতে। ম্যাচের আগে বিসমাহ মারুফ টিম বাস থেকে নামলেন। তার বাম কাঁধে ছিল কন্যা সন্তান ফাতিমা, ডান কাঁধে ক্রিকেট ব্যাট। পাশেই বিসমাহর এক সতীর্থ ধরে রেখেছিলেন ফাতিমার দোলনাটা। 

    দৃশ্য দুই

    ভারতের স্মৃতি মান্দানা-শেফালি ভার্মারা ঘিরে রেখেছেন বিসমাহ মারুফকে। তার কোলে মেয়ে ছোট্ট ফাতিমা, বয়স মাত্র ৬ মাস। ফাতিমাকে ঘিরে তাদের সে কী উচ্ছ্বাস আর আনন্দ। প্রায় সকলেই মেতে উঠেছিলেন ফাতিমার সাথে আদুরে খেলায়। সেই ছোট্ট ফাতিমা মায়ের কোলে চড়ে, কাঁধে মাথা রেখে এক করেছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলকে, রাজনৈতিক কারণে বৈরি দুই দেশকে। তার স্বাক্ষী হয়ে রইল হারমানপ্রীত কউরের আইফোনটাও। তার মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরাতেই সেলফি বন্দি হয়েছে সবাই। মাঝে ছিল ফাতিমা।   

    ম্যাচটাতে পাকিস্তান হেরেছে ঠিকই। কিন্তু বিসমাহ মারুফ জিতে এসেছেন আরো বড় একটা লড়াই। যে লড়াইটা মা হওয়ার, বিরুদ্ধ পরিবেশ থেকে উঠে এসে সন্তানকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। যে লড়াইটা আরো অসংখ্য নারীর। তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করা বিসমাহ নিজের মাতৃত্বের ছোঁয়ায় সন্তান ফাতিমাকে নিয়ে জিতেছেন কোটি হৃদয়। 

    বিসমাহর মতো মা ও ক্রিকেটারের দ্বৈত ভূমিকা পালন করে যাওয়া এমন আরও সাত ক্রিকেটার আছেন এবারের বিশ্বকাপে। যাদের সবাই শুধু ২২ গজে নয়, বাস্তব জীবনেও একেকজন ওয়ান্ডার ওম্যান।


    ‘মা’ বিসমাহ মারুফের উতরে যাওয়া চ্যালেঞ্জ

    ফাতিমার মা বিসমাহ মারুফের গল্পটা আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। অনুপ্রেরণা যোগাবে বিশ্বের অসংখ্য মায়েদের। বিসমাহর কথা আলাদা করে আসছে এই কারণে, তিনিই প্রথম পাকিস্তানি ক্রিকেটার যিনি মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পেরেছেন। অথচ ছয় মাস আগেও তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ‘মাঠে ফিরতে পারব তো?’ 

    এই প্রশ্নের পেছনে আছে নারী ক্রিকেটকে ঘিরে পাকিস্তানের সামাজিক কাঠামোর দৃষ্টিভঙ্গি।। যেখানে বিয়ে করলেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় সমূলে, সেখানে সন্তান জন্ম দিয়ে আবার ক্রিকেট মাঠে ফেরা তো অবিশ্বাস্যই বলা চলে। সেই অবিশ্বাস্য কাজটাই করেছেন বিসমাহ। তিনি নিজেও ভেবেছিলেন, তার জন্য এমন কিছুই অপেক্ষা করছে। কিন্তু জীবন মোড় নিয়েছে বিসমাহর। পরিবারের অশেষ সমর্থন পেয়েছেন তিনি। বিশেষ করে নিজের স্বামীর, যিনি বিশ্বাস করেন বিসমাহ হতে পারেন পাকিস্তানি নারীদের রোল মডেল। হতে পারেন জ্বলন্ত উদাহরণ; মা হয়েও ক্রিকেট খেলা যায়। 

    ফিরে আসার দুর্দান্ত এই গল্পটাতে বিসমাহর সদিচ্ছা তো ছিলই। সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের। মা হতে যাওয়া ক্রিকেটারদের জন্য পিসিবি গত বছর প্রণয়ন করেছে নতুন নীতিমালা। যেখানে মাতৃত্বকালীন ১২ মাস বৈতনিক ছুটি পাবেন তারা। তাদের জন্য খোলা থাকবে জাতীয় দলের দরজাও। সেই ধারাবাহিকতায় পরের এক বছরের চুক্তিতেও থাকবেন তারা বিনা বাধায়। 

    এতদিন এই ছুটির সুবিধা ছিল না বিধায় ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়েছে সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার নাইন আবিদীকে। সপরিবারে এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন তিনি। সাহসী বিসমাহ সেদিক থেকে খানিকটা ভাগ্যবতীও বটে। ভাগ্যবতী হলেও মাতৃত্বের কারণে হারানো ফিটনেস ফিরে পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। সেই চ্যালেঞ্জটা কীভাবে উতরে গেলেন বিসমাহ? বিশ্বকাপ পর্যন্ত  কেমন ছিল তার লড়াইটা?

    ফাতিমা জন্ম নেয়ার ৪৫ দিন পর ফিটনেস পুনুরুদ্ধারের মিশনে নামেন বিসমাহ। লাহোরের এইচপি সেন্টারে শুরু হয় প্রতিদিনের নতুন এক লড়াই। শুরুতে ভেবেছিলেন অনেক সময় লাগবে। কিন্তু নিজের উন্নতি দেখে বিসমাহ নিজেই চমকে যান। নেপথ্যে আছে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা আর সময়ানুবর্তিতা। একদিনও দেরি করে যাননি ট্রেনিং গ্রাউন্ডে।

    একেবারেই দোটানায় পড়েননি এমনটাও নয়। সন্তানের জন্য মন কাঁদত তার। তাই কোনোদিন ট্রেনিংয়ে একটু কমতি রেখেই চলে যেতেন মেয়ের কাছে। পরেরদিন এসে অবশ্য সেটা পুষিয়ে নিতেন। এভাবেই ছয় মাসের মাথায় হারানো ফিটনেস ফিরে পেয়েছেন বিসমাহ। ফিরে পেয়েছেন মানসিক শক্তিটাও, যেটাকে কাজে লাগিয়ে ঝালিয়ে নিয়েছেন নিজের ব্যাটিং স্কিল।

    ১৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা বিসমাহ এখন ৩০ বছরের মহীয়সী এক নারী। আছে লম্বা এক ক্যারিয়ার। একটা সময় নিজেকেই বলতেন পাকিস্তান দলের ‘বেবি’। সেই বিসমাহ এখন বিশ্বকাপের মঞ্চে নেমেছেন তার নিজের ‘বেবি’ নিয়ে। 

    গত বছরের ২১ আগস্ট বিসমাহর কোল আলো করে এসেছে ফাতিমা। ফাতিমাকে পেয়ে কেবল বিসমাহর জীবনই বদলায়নি। বদলে গেছে পাকিস্তানের ড্রেসিংরুমের আবহও। পাকিস্তানের নারী ক্রিকেটাররাই জানিয়েছেন, ফাতিমাকে দেখে বিশ্বকাপ খেলার চাপ অনেকটাই কমে গেছে তাদের। বিসমাহর সতীর্থ নিদা দার ফাতিমাকে দিয়েছেন ‘বাব্বুজি’ ডাকনাম।  প্র্যাক্টিসের পর ফাতিমাকে তাদের সবার এক পলক দেখা চাই ই চাই। চোখের আড়াল হলেই সবাই খোঁজা শুরু করে ফাতিমাকে। এমনকি টিম হোটেলে বিসমাহর রুমেও আড্ডা বসে তার সতীর্থদের ফাতিমাকে ঘিরে।  আজ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফিফটি করে সেটা উৎসর্গ করেছেন মেয়েকেই। 

    এখনো কোনো সেঞ্চুরি করতে পারেননি বিসমাহ। তবুও বাঁহাতি এই ব্যাটারকে বলা হয় তর্কাতীতভাবে পাকিস্তানের সেরা। আরো অনেক কিছুই লেখা বাকি অর্জনের খাতাতে। তবে ওসব নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না বিসমাহ। কারণ মাতৃত্ব তাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে; ব্যক্তি হিসেবে, ক্রিকেটার হিসেবে। নতুন এই ভাবনার ঢেউই হয়তো তাকে পৌঁছে দিবে সফলতার তীরে। এর ওপর ব্যক্তিগত জীবনের সাথে ক্রিকেট ব্যাটের ভারসাম্যটাও তো করতে শিখে গেছেন বিসমাহ।  

     

    এমি সাদার্থওয়েটের ফিরে আসা

    সময়টা ২০১৯ সালের আগস্ট। প্রথম সন্তানের অপেক্ষায় ছিলেন নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক এমি সাদার্থওয়েট। তিনি নিলেন মাতৃত্বকালীন ছুটি। খেলতে পারেননি ২০২০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। তার জীবনসঙ্গী ও সতীর্থ লিয়া তাহুহুও তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আর ক্রিকেটে নাও ফিরতে পারো।’ 

    কারণ এমির বয়স তখন ছিল ৩৩। মাঝবয়সে শরীর এমন ঝক্কি সইতে পারলেও সেখান থেকে আগের ফিটনেস ফেরানো যাবে কিনা, সেটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্ম নেয় তাদের কন্যাসন্তান গ্রেইস। শুরু হয় এমির নতুন একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা ক্যারিয়ার আর ব্যক্তিগত জীবনের। 

    এমি মাঠে ফিরেছেন গ্রেইসের জন্মের ৯ মাস পর। ২০২০ সালের শেষাংশে অস্ট্রেলিয়া সফর দিয়ে। হোম সিরিজ খেলার পাশাপাশি গিয়েছেন ইংল্যান্ডেও। মেয়েদের বিগ ব্যাশে নেতৃত্বও দিয়েছেন মেলবোর্ন রেনেগেডসকে। লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে এমি এবার খেলছেন নিজের চতুর্থ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। করছেন নিউজিল্যান্ড দলের সহ-অধিনায়কত্ব। 

    এর আগে নিজেকে ফিট রাখতে গর্ভাবস্থাতেই চালিয়ে গেছেন নিয়মিত ট্রেনিং। প্রথম পাঁচ মাস রানিংয়ের সাথে জিমে সাইক্লিংটাও করে গেছেন। সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে অবশ্য পর্যাপ্ত বিশ্রামও নিয়েছেন। সব মিলিয়ে বিশ্রাম পেয়েছেন ৮ সপ্তাহ।

    মাঠে ফিরতে দলের স্ট্রেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচ স্কট রেনের অধীনে অনুসরন করেছিলেন আরটিপি প্ল্যান (রিটার্ন টু প্লে)। সাধারণত ইনজুরি কিংবা শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে মাঠে ফেরার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করাটাই আরটিপির মূল উদ্দেশ্য। স্কট রেনেরও চেষ্টা ছিল এমির ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে তাকে মাঠে ফেরার মতো পরিপূর্ণ করে তোলা। এজন্য অবশ্য বেশ বেগ পেতে হয়েছে দুজনকেই। এমিকে মাঠের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি করে তোলাটাই ছিল তার মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ সন্তান জন্মদানের পর শরীরের সাথে মানসিক এবং হরমোনজনিত অনেক পরিবর্তন আসে একজন নারীর। 

    এই যাত্রায় এমি আর লিয়ার হাত ধরেছিল নিউজিল্যান্ড বোর্ডও। তাদের দিয়েই মাতৃত্বকালীন ছুটির বিশেষ এক ব্যবস্থার শুরু করেছিল নিউজিল্যান্ড। উইমেন্স মাস্টার এগ্রিমেন্ট (ডব্লিউএমএ) নামের সেই নীতিমালা অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন এক বছরের ছুটি পাবেন ক্রিকেটাররা। একইসাথে নিশ্চিত করা হবে কেন্দ্রীয় চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসের বেতন। পরবর্তী এক বছরের কেন্দ্রীয় চুক্তিও থাকবে অক্ষুণ্ণ।

     

    মেগান শুট, হরমোন ও বেদনা

    জিততে কে না পছন্দ করে? অস্ট্রেলিয়ান পেসার মেগান শুট মাঠেই নামেন জেতার জন্য ইস্পাত কঠিন মানসিকতা নিয়ে। সেই মানসিকতায় অবশ্য খানিকটা চিড় ধরেছিল গত বছর। এর পেছনে অবশ্য তার সঙ্গী জেস হলিয়োকের মাতৃত্ব, গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের কিছু জটিল ব্যাপার আছে। 

    গত বছরের ২১ আগস্ট তাদের কোল জুড়ে এসেছে কন্যা সন্তান রাইলি। ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) পদ্ধতিতে  নির্দিষ্ট সময়ের ১১ সপ্তাহ আগে সি-সেকশনের মাধ্যমে জন্ম নেয় রাইলি। ওজন ছিল মাত্র ৮৫৮ গ্রাম।  ২০১৯ সালে জেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন মেগান। তখন থেকেই তার পরিকল্পনা করেন পরিবার নিয়ে। তারা শরনাপন্ন হন আইভিএফ পদ্ধতির। একই পদ্ধতিতে সন্তান নিয়েছেন তার সতীর্থ রাচেল হেইন্স। 

    সিদ্ধান্ত হয় মেগানের দান করা ডিম্বানুতে গর্ভধারণ করবেন জেস। আইভিএফ পদ্ধতিতে শরীরের হরমোনে বিশাল পরিবর্তন আসে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব আছে নারীদের রজঃচক্রের। পেশাদার ক্রিকেটার মেগানের জন্য ফাঁকা সময় খুজে বের করাটাই ছিল প্রধান কাজ। প্রথমে ভেবেছিলেন ২০২০ সালে বিগ ব্যাশ শেষ করে প্রক্রিয়া শুরু করবেন। কিন্তু রজঃচক্রের কথা মাথায় রেখে বিগ ব্যাশ চলাকালীনই হরমোনাল ইঞ্জেকশন নেওয়া শুরু করেন। 

    বোলার হিসেবে মাঠে খুব একটা সমস্যা হয়নি মেগানের। কিন্তু ইঞ্জেকশনের প্রভাবে ব্যাটিংয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। ব্যথা অনুভূত হতো, বিশেষ করে সুইপ শট খেলতে গিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজমেন্টও ট্রেনিংয়ের বিষয়টা তার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল তখন। 

    ১২ দিন ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর ডিম্বানু দানের প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয় মেগানের। ৬ দিন বিশ্রাম নিয়ে আবার ফেরেন মাঠে। তখন আগের চেয়েও বেশি ক্লান্ত বোধ করেছিলেন তিনি। পেয়ে বসেছিল অস্বস্ত্বিতে। নিয়মিত কাজগুলোতে মনোযোগ দিতেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল তাকে।  

    ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার সম্ভাবনা জেগেছিল মেগানের। ২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে মেয়েদের ওয়ানডে টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে টুর্নামেন্ট পিছিয়ে যায় পরের বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। সেই টুর্নামেন্টে মেগান খেলেছেন হরমোনজনিত শারীরিক জটিলতা কাটিয়ে পুরোপুরি ফিট হয়ে। খেলছেন চলতি বিশ্বকাপেও। দুই ম্যাচে নিয়েছেন দুই উইকেটও।  

     

    'সুপার মম' মাসাবাতা ক্লাস

    দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার মাসাবাতা ক্লাসের বয়স তখন ১১। প্রাইমারি স্কুলে টিফিন ব্রেকে ক্রিকেট খেলতে দেখতেন ছেলে সহপাঠীদের। তখনই ক্রিকেটের সাথে জুড়ে যায় তার প্রাণ। খেলতে চাইতেন তাদের সাথে, কিন্তু মেয়ে বলে সুযোগ পেতেন না খুব একটা। আর সুযোগ পেলেও জুটত না ব্যাটিং কিংবা বোলিং। দর্শক হয়েই থাকতে হতো মাঠে। 

    এভাবে বছর দুয়েক চলার পর স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষকের কাছে গিয়ে জানান, মেয়েদের ক্রিকেট দল তৈরির আর্জি। সেই শিক্ষক তাকে ফেরাননি। মাসাবাতাও আর পেছন ফিরে তাকাননি। এরপরের গল্পটা কেবলই এগিয়ে যাওয়ার। স্কুল ক্রিকেট থেকে বয়সভিত্তিক দল, সেখান থেকে রাজ্যদলের সেরা একাদশ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দল।  

    জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে ২০১০ সালে।  মা হয়েছেন ২০১৩ সালে ২২ বছর বয়সে। তখন দুটো রাস্তা খোলা ছিল তার সামনে, হয় মাতৃত্ব নয় ক্রিকেট বেছে নেওয়া। ক্রিকেটকে পাশে সরিয়ে রেখে মাসাবাতা নিজের কন্যা সন্তানের মায়ায় আটকে রইলেন ঘরে। তার পড়ে থাকা ক্যারিয়ারের সম্ভাবনার দুয়ারেও একটা প্রশ্ন ঝুলে ছিল ‘ফিরতে পারব তো” 

    মাসাবাতা পরের দুই বছরে বেশিরভাগ সময়ই দিয়েছেন নিজের মেয়েকে লালন-পালনে। তবে মনের গভীরে এই প্রত্যয়ও ছিল, আবারও জাতীয় দলে ফিরবেন। সন্তান-সংসার সামলে ফিটনেস, স্কিলের ট্রেনিং ঝালিয়ে, ফাঁকেফাঁকে খেলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও। একসাথে সবকিছু সামলানো বেশ দুরহ ব্যাপারই ছিল। সেই পথটা খানিকটা সহজ করে দেন তার মা পলিনাহ ক্লাস। মেয়ে জন্ম দেওয়ার পর নিজের মাকে মাসাবাতা বলেছিলেন, ‘আমি আবারও জাতীয় দলে খেলব।’ 

    মেয়েকে মায়ের হাতে সঁপে জাতীয় দলে ফিরতে মাসাবাতা পাখির চোখ করেছিলেন রাজ্য দলের ম্যাচগুলোকে। খেলতেন ফ্রি স্টেট দলের হয়ে। ২০১৫ সালে ওয়ানডে টুর্নামেন্টে ৩ ম্যাচে নেন ৮ উইকেট। সেই মৌসুমের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের এক ম্যাচে ৯ রানে নেন ৩ উইকেট। নির্বাচকদের নজর কাড়তে যা যথেষ্টই ছিল। প্রত্যাবর্তন হয়েছিল ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। শারজাহতে খেলা সেই ম্যাচের পর একাদশে নিয়মিতই দেখা যেত তাকে। সে বছর আফ্রিকার খেলা ২২ ওয়ানডের ১৬টিই খেলেছিলেন মাসাবাতা। ২০১৮ সালে পেয়ে যান কেন্দ্রীয় চুক্তিও। 

    দীর্ঘদিনের ত্যাগ আর পরিশ্রমের সেরা ফলটা মাসাবাতা পেয়েছিলেন ২০১৯ সালে। পচেফস্ট্রুমে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। এর আগে এই স্বাদ পেয়েছিলেন কেবল তৎকালীন অধিনায়ক ড্যান ফন নিকার্ক। 

    এখন পর্যন্ত ৫৩ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ৪৬ উইকেট। যার সর্বশেষ দুটি পেয়েছেন চলতি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ৪৩ টি-টোয়েন্টি খেলে উইকেট আছে ২২টি। অবশ্য সংখ্যাগুলোতে তার সংগ্রাম, একাগ্রতার গল্পগুলো প্রতিফলিত হবে না সেভাবে। কিন্তু মাতৃত্বকে বরণ করতে গিয়ে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে আবার যেভাবে ফিরে এসেছেন; নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা যোগাবে বিশ্বের অসংখ্য নারীদের, মায়েদের। 

    এবারের বিশ্বকাপে একই ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষার গল্প আছে র‍্যাচেল হেইন্স, লিজেল লি আর অ্যাফি ফ্লেচারেরও। ক্যারিয়ারের মাঝগগনে মাতৃত্বের অমূল্য স্বাদ পেয়েছেন এই নারীরা। বিশাল শারীরিক পরিবর্তন সত্ত্বেও যোগ্য হয়ে ফিরেছেন ক্রিকেটে। জীবন, সন্তান আর ব্যাট-বলের দাঁড়িপাল্লার দারুণ ভারসাম্য করে ফিরেছেন বিশ্বকাপের ময়দানে। 

     

    তথ্যসূত্র: The Cricket Monthly, Cricinfo, Cricbuzz