• পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ
  • " />

     

    অস্ট্রেলিয়ার পাকিস্তান সফর: খাওয়াজার বাড়ি ফেরা

    অস্ট্রেলিয়ার পাকিস্তান সফর: খাওয়াজার বাড়ি ফেরা    

    পরিবারের সাথে পাকিস্তান ছেড়েছিলেন ৫ বছর বয়সে। উসমান খাওয়াজা এরপর বেড়ে উঠেছেন অস্ট্রেলিয়ার আলো বাতাসে। সেখানে জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়ে আবারও জন্মভূমি পাকিস্তানে ফিরেছেন তিনি। উপলক্ষ ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়া দলের পাকিস্তান সফর। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, পাকিস্তানিদের আনন্দও যে আর ধরে না। এই আনন্দঘন পরিবেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনটাও ব্যাট হাতে রাঙিয়েছেন খাওয়াজা। 

    তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টটা ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে। এই রাওয়ালপিন্ডির আউটার মাঠেই জীবনের প্রথম বলটা খেলেছিলেন খাওয়াজা। বড় প্যাডে ৫ বছর বয়সী ছোট্ট খাওয়াজার পা দুটো আটকায়নি তখন। তাই বাধ্য হয়ে থাই প্যাডেই আশ্রয় খুঁজতে হয়েছিল। শৈশবের স্মৃতিজড়িত সেই রাওয়ালপিন্ডিতেই দারুণ ব্যাটিং করেছেন খাওয়াজা। যদিও ৩ রানের আক্ষেপে পুড়েছেন। স্কোরিং শট রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে ৯৭ রানে শর্ট লেগে ক্যাচ দেন তিনি। 

    ৯৭ রানের সেই ইনিংসে তিনবার জীবন পেয়েছেন খাওয়াজা। ২২ রানে গালিতে তার ক্যাচ মিস করেন ফাওয়াদ আলম। ৬৬ রানে খাওয়াজার রিভার্স সুইপে ক্যাচ উঠলেও ধরতে পারেননি মোহাম্মদ রিজওয়ান। প্রথম স্লিপ আর উইকেটকিপারের মাঝ দিয়ে এজ হয়ে বল ছুটে যায় বাউন্ডারিতে, খাওয়াজা তখন ৭৩-এ। 

    তবুও পুরো ইনিংসজুড়েই সাহসী ব্যাটিং করেছেন। যেন তার ব্যক্তিত্বেরই  প্রতিফলন। কথায় আছে, ভাগ্য সাহসীদের পক্ষেই থাকে। প্রথম টেস্টে ভাগ্য শেষদিকে সঙ্গ না দিলেও করাচির ন্যাশনাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দ্বিতীয় টেস্টে সেঞ্চুরির পর খাওয়াজা ঠিকই ব্যাটটা তুলে ধরেছেন। ভাগ্যের ছোঁয়া তো ছিলই, এরচেয়ে বেশি ছিল খাওয়াজার আদর্শ টেস্ট টেম্পারমেন্ট। 

    সেই সেঞ্চুরির গল্পের আগে ছোট্ট একটু পারিবারিক ইতিহাস; খাওয়াজা পরিবারের আদি নিবাস করাচিতে। একমাত্র উসমান খাওয়াজাই জন্মেছিলেন করাচির বাইরে, ইসলামাবাদে। তবে করাচিতেও তার শৈশব স্মৃতি আছে। করাচির রাস্তায় ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন বন্ধুদের সাথে। যে শহরে পরিবারের শেকড় গেঁথে আছে, যেখানে পরিবারের সদস্যরা আছেন,  সেখানে সেঞ্চুরি করা তো নিঃসন্দেহে বিশেষ কিছুই। 

    করাচির তপ্ত রোদে ১১তম টেস্ট সেঞ্চুরিটা করেছেন খাওয়াজা। প্রথমদিন মাঠ ছেড়েছিলেন ১২৭ রানে অপরাজিত থেকে। দ্বিতীয়দিন পার হয়েছেন দেড়শো রানের মাইলফলকও। ইনিংসজুড়ে পাকিস্তানের স্পিনারদের দারুণ সামলেছেন ঠিকই। কিন্তু খাওয়াজার ১৬০ রানের দারুণ ইনিংসটা থেমেছে স্পিনার সাজিদ খানের বলেই। যখন মাঠ ছাড়ছিলেন তখন গোটা গ্যালারিই করতালি দিয়েছে তার জন্য। 

    এর আগে ঘরের ছেলেকে দুহাতে বরণ করে নিয়েছে পাকিস্তান। খাওয়াজা যখন ব্যাটিং করেছেন, গ্যালারিতে তার নাম ধরে চ্যান্ট করেছেন দর্শকরা। কেউ কেউ প্ল্যাকার্ডও এনেছিলেন ‘নিজের ঘরই মনে করো খাওয়াজা’ লিখে। এমন সমর্থন পেয়ে আপ্লুত খাওয়াজা বলেছেন, এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না। পাকিস্তানের দর্শকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান।

    এই সফরের আগে ২০১০ সালে খাওয়াজা পাকিস্তানে ঘুরতে গিয়েছিলেন পরিবারের সাথে।সময়ের হিসেবে এক যুগের পার্থক্য, অনেক কিছুই বদলে গেছে পাকিস্তানে। রাস্তাঘাটেও উন্নতির ছোঁয়া। খাওয়াজাও সেটা অনুভব করতে পারছেন। এই অনুভূতির নেপথ্যের গল্পটায় আছে খাওয়াজার পরিবারের উন্নত জীবনের আশা। 

    বাবা তারিক খাওয়াজা ও মা ফোজিয়া খাওয়াজা ১৯৯২ পাড়ি জমিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। আইটি আর্কিটেক্ট হিসেবে চাকুরিতে যোগদানের পর পরিবার নিয়ে সিডনিতে থিতু হন তারিক। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন তার দুই সন্তান আরসালান ও উসমান। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশেই এক পার্কে ক্রিকেট খেলতেন দুজন। যদিও অস্ট্রেলিয়ার আদি নাগরিক না হওয়ায় দুজনকেই নানান কটুক্তি হজম করতে হয়েছিল। ঠিক এ কারণেই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথিউ হেইডেনদের মতো তারকা থাকা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার কাউকে আদর্শ মানেননি খাওয়াজা।  

    হাইস্কুলের পাট খাওয়াজা চুকিয়েছেন ওয়েস্টফিল্ড স্পোর্টস স্কূল থেকে। সেখানে স্কুল ক্রিকেটেও ছিলেন উজ্জ্বল। উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে অ্যাভিয়েশনের ওপর। সনদপ্রাপ্ত কমার্শিয়াল লাইসেন্সড পাইলটও তিনি। কিন্তু পেশা হিসেবে ক্রিকেটকেই বেছে নিয়েছেন। এর আগেই অবশ্য প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পা পড়েছিল তার। 

    সেখানে আলো ছড়িয়ে ডাক পান জাতীয় দলে। ২০১১ অ্যাশেজে হয়েছিল টেস্ট অভিষেক। ইনজুরিতে পড়া রিকি পন্টিংয়ের জায়গায় ডাক পেয়েছিলেন। এরপর ক্যারিয়ার এগিয়েছে তার মৃদুমন্দ তালে। এসেছে অনেক উত্থান পতনও। দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন একটা সময়। তবে শেষবারের ফেরাটা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। 

    দেড় বছর পর টেস্ট দলে ডাক পেয়েছিলেন গত অ্যাশেজে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ছিলেন খাওয়াজা। নির্বাচকরাও আর নজর ফেরাননি। সুযোগ আসে অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্টে, ট্রাভিস হেড করোনাক্রান্ত হওয়ায়। ঘরের মাঠ সিডনিতে দুহাতে সেই সুযোগটা লুফে নেন খাওয়াজা। দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি হাঁকান। 

    এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। অ্যাশেজের সিডনি টেস্টে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করলেও শেষ টেস্টে ফিরে পেয়েছিলেন নিজের পছন্দের ওপেনিং পজিশন। পাকিস্তান সফরেও ওপেনিংয়ে দারুণ সফল তিনি। শেষ ৬ টেস্টের আছে ৩ সেঞ্চুরি।  আপাতত খাওয়াজার ক্যারিয়ারের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফের সারমর্ম, সিডনিতে ক্যারিয়ারের পুনর্জন্ম আর নিজের জন্মভূমি পাকিস্তানে তার পূর্ণতা দানে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। বাড়ি ফিরে এই সময়টা দারুণ উপভোগ করছেন খাওয়াজা।