• আইপিএল ২০২২
  • " />

     

    উমরান মালিক: নেট বোলার থেকে যেভাবে আইপিএলে ঝড় তুললেন কাশ্মীর এক্সপ্রেস

    উমরান মালিক: নেট বোলার থেকে যেভাবে আইপিএলে ঝড় তুললেন কাশ্মীর এক্সপ্রেস    

    ব্রেট লি, শোয়েব আখতার,শন টেইট, মিচেল জনসনদের বদৌলতে আইপিএলে গতির ঝড় তো দেখা গেছে কতই। তাদের সেই ব্যাটনটা হাত বদল হয়ে এসেছে হালের আইনরিখ নরকিয়া-লকি ফার্গুসনদের হাতে। কিন্তু মাঝে এক মোহাম্মদ সিরাজ ছাড়া কোনো ভারতীয় পেসার আসেনি, যার পরিচয়ই হবে একেকটা তুমুল গতির ডেলিভারি। সেই কমতিটা পুষিয়ে দিচ্ছেন উমরান মালিক। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের ডানহাতি এই ফাস্ট বোলারের এক্সপ্রেস গতির হাওয়া ব্যাটারদের গায়ে লাগছে প্রতি ম্যাচেই। 

    দারুণ সেই হাওয়ার রেশে উইকেটও তুলে নিচ্ছেন টপাটপ। পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে চার উইকেট পেয়েছেন উমরান। এর মধ্যে তিনটিই এসেছে ইনিংসের শেষ ওভারে। অল্পের জন্য হয়নি হ্যাটট্রিক। তবে দারুণ একটা রেকর্ড করেছেন উমরান। আইপিএল ইতিহাসের চতুর্থ বোলার হিসেবে ইনিংসের শেষ ওভারে মেইডেন নিয়েছেন তিনি। তার আগে এই কীর্তি ছুঁতে পেরেছেন তিনজন; ইরফান পাঠান, লাসিথ মালিঙ্গা ও জয়দেভ উনাদকাট। 

    সেই ম্যাচ শেষে একগাদা পুরস্কার নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন উমরান। ম্যাচসেরা হয়েছিলেন সেদিন। আর হায়দ্রাবাদের প্রতি ম্যাচের দ্রুততম ডেলিভারির পুরস্কারটা তো তার নিজস্ব সম্পত্তিই হয়ে উঠেছে। প্রতি ম্যাচেই যে তার ডেলিভারিতে স্পিডগান ছুঁয়ে ফেলছে দেড়শো কিমির ঘর। তার গতিময় ডেলিভারিতেই অস্বস্ত্বিতে পড়তে দেখা গেছে শ্রেয়াস আইয়ারকে। আর বাউন্সার তো গিয়ে লেগেছিল হার্দিক পান্ডিয়ার হেলমেটে। বল হাতে স্বপ্নালু সময় কাটাচ্ছেন উমরান, এই কথা বলাই যায়। 

    কেমন ছিল উমরানের এই যাত্রা? জম্মু-কাশ্মীর থেকে উঠে আসা এই তরুণ কীভাবে হয়ে উঠলেন আইপিএলের দ্রুততম ভারতীয় বোলার? 


    যেভাবে শুরু হলো ‘গজনী’র গতিময় পথচলা 

    জন্ম জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগরে। ছোট্ট শহরের মধ্যবিত্ত সংসারের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই ছিল উমরানের জীবন; স্কুলে যাওয়া, ফিরে এসে ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকা। শৈশব-কৈশোরের বিশাল একটা অংশ কেটেছে গলি আর স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলে। তবে তাকে যেটা বাকিদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল; সেটা ছিল তার দারুণ শারীরিক গঠন আর তা কাজে লাগিয়ে জোরে বল করার প্রকৃতিগত শক্তি। 

    উমরানের বয়স তখন ১৭। যৌবন ছুঁইছুঁই টগবগে এক হবু যুবক। পুরো জম্মুজুড়ে শুরু করলেন টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলা। ম্যাচগুলো হতো দশ ওভারের, সান্ধ্যকালীন হওয়ায় দর্শক গিজগিজ করত মাঠে। টেনিস বলের সেই ফুলহাউজ শোতে উমরানের মূল কাজ বোলিং তো ছিলই, ব্যাটিংটাও করতেন দারুণ। ছোট করে কাটা চুল আর দারুণ ফিজিক; দর্শকরা তার সাথে মিল পেতেন বলিউড সুপারস্টার আমির খানের করা ‘গজনী’ চরিত্রের। তাদের ভাষ্যানুযায়ী, ‘গজনী দারুণ বল করে, আবার বড় ছক্কাও মারে’।


    পেশাদার ক্রিকেটে হাতেখড়ি

    ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত টেনিস বলেই খেলে গেছেন উমরান। ক্রিকেট বলে তখনো খেলা হয়নি তার। বন্ধুদের পরামর্শে দ্বারস্থ হলেই স্থানীয় কোচ রনধীর সিংয়ের। এরপর মাওলানা আজাদ স্টেডিয়ামে রনধীরের অধীনে শুরু হয় উমরানের ট্রেনিং। প্রথমদিনই তাকে দেখে অবাক হয়ে যান জম্মুর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার  রাম দয়াল। কারণ অতটুকু বয়সী কাউকে এর আগে এত জোরে বল করতে দেখেননি তিনি। দেখেননি আরো অনেকেই। 

    গতির ব্যাপারটা উমরানের জন্য ‘ন্যাচারাল’, বোনাস হিসেবে দারুণ ফিটনেস তো ছিলই। সাথে যুক্ত হয়েছিল টেনিস বলে খেলার অভিজ্ঞতা। কারণ টেনিস বলের পেসাররা গতির জোরে এয়ার সুইংটা স্বভাবতই পায়। সব মিলিয়ে ক্রিকেট বলেও তখন দেখা গিয়েছিল তার গতির ঝলক। তবে রনধীর তার সমস্যা বের করেছিলেন দুই জায়গায়। ডেলিভারির আগে জাম্প ও ল্যান্ডিংয়ে। অবশ্য পরবর্তীতে ইরফান পাঠান জম্মু-কাশ্মীরের মেন্টর থাকাকালীন সেই দুর্বলতাও দূর হয়ে যায় উমরানের। 

    জম্মু-কাশ্মীরের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বাছাই চলছিল তখন। উমরানও হাজির হলেন পরীক্ষা দিতে। কিন্তু তাকে ট্রায়ালের সুযোগই দেননি নির্বাচকরা।এতে অবশ্য নির্বাচকদের দোষ দেয়া চলে না। মাত্র বছর খানেক আগেই উমরান হাতে তুলে নিয়েছেন ক্রিকেট বল, জেলা পর্যায় দূরে থাক কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচেও খেলেননি। 

    তবুও নাছোড়বান্দা উমরান বাছাইয়ের দ্বিতীয়দিন আবারও হাজির। নির্বাচকরাও তার অনভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে সুযোগ দিলেন। আর সেখানেই বাজিমাৎ উমরানের। তার করা প্রথম বলটা দেখেই এক নির্বাচক এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘তুমি দলে থাকছো। চিন্তা করো না, শুধু নিজেকে তৈরি রেখো।’

    নিজেকে তৈরি রাখার সেই প্রসেসে ভালোমতোই মেনে চলেছিলেন উমরান। হঠাৎ একদিন তার সুযোগ এলো জাতীয় নির্বাচকদের নজর কাড়ার। স্বাভাবিক আর দশটা দিনের মতোই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের নেটে বল করছিলেন উমরান। সিমেন্টের পিচে তার তোপ দাগানো বোলিং নজর কেড়েছিল জম্মুর বৈষ্ণদেবী মন্দিরে ঘুরতে যাওয়া নির্বাচকদের দলকে। 

    সিমেন্টের মরা উইকেটে অমন আগুনে বোলিং দেখে নির্বাচকরা উমরানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কে তুমি? এত জোরে বল করছো? ম্যাচ খেলছো না কেন?’

    মাত্র এক বছর আগেও টেনিস বলে খেলে বেড়াতেন শুনে, নির্বাচকদের অবাক হওয়ার পাল্লা আরো ভারী হয়ে উঠেছিল। 

     

    বন্ধু আব্দুল সামাদ ও সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ

     

    উমরান যখন জম্মুর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বাছাইপর্ব পাড়ি দিচ্ছেন, ততদিনে জম্মুর ক্রিকেট পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন আব্দুল সামাদ। তখন থেকেই গড়ে উঠে দুজনের মধ্যকার বন্ধুত্ব। দুজনই কাছ থেকে দেখেছেন একে অপরের ক্রিকেটিং স্কিল। 

    ঘটনা ২০২০ সালের। অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বাছাইপর্ব পেরোতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েন উমরান। তবে বন্ধু সামাদের কল্যাণে সেই হতাশার মেঘ উড়ে গিয়েছিল সেবারের আইপিএল গড়ানোর পর। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে সেবছরই আইপিএলে অভিষেক হয়েছিল সামাদের। তিনিই টিম ম্যানেজমেন্টকে জানান, নেট বোলার হিসেবে উমরানের কথা। 

    চালাচালি হয় বোলিংয়ের ভিডিও। দেখে পছন্দ হয় হায়দ্রাবাদের কোচিং প্যানেলের। সম্মতি পাওয়ার পর জম্মু থেকে সোজা হায়দ্রাবাদের ক্যাম্পে হাজির হন উমরান। সেখানে উমরান সুযোগ পান কেইন উইলিয়ামসন-ডেভিড ওয়ার্নারদের বল করার। তারা বেশ অবাক হয়েছিলেন বলের গতিতে। তবে সবচেয়ে বড় চমক পেয়েছিলেন জনি বেইরস্টো। উমরানকে অনুরোধ করেছিলেন, যেন আরেকটু গতি কমিয়ে বল করেন। 

    ব্রেক থ্রু এসেছিল ২০২১ আইপিএলের শেষাংশে। হায়দ্রাবাদের কোয়ালিফায়ার রাউন্ডে যাওয়ার আশা তখন মিইয়ে গেছে। বাকি ছিল তিন ম্যাচ। সেই তিন ম্যাচের আগে কোভিড পজিটিভ হন বোলার থাঙ্গারাসু নটরাজন। তার জায়গায় সেরা একাদশে ঢুকেন উমরান। সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচেই বাজিমাৎ। প্রথম ওভারের তৃতীয় বলটাই ছুঁড়েছিলেন ঠিক ১৫০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে। 

    সেবার ৩ ম্যাচে কেবল ২ উইকেট পেলেও গতির ঝড়ে নিজের আগমনী বার্তাটা ঠিকই দিতে পেরেছিলেন উমরান। সেবারের সবচেয়ে দ্রুতগতির; ১৫২.৯৫ কিমি/ঘণ্টার বলটাও বেরিয়েছিল তার গ্রিপ থেকেই। তাই এবারের আইপিএলের আগে তাঁকে রিটেইন করে হায়দ্রাবাদ। সেই প্রতিদানটাও তো প্রতি ম্যাচেই দিচ্ছেন তিনি। লেখার শুরুতেই যা পড়েছিলেন; প্রতি ম্যাচের দ্রুততম ডেলিভারি। 

    বোনাস হিসেবে পেয়েছিলেন ভারত জাতীয় দলের নেটে বল করার সুযোগ।  গত আইপিএলে তার এমন বোলিং দেখে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য তাকে নেট বোলারদের দলে যুক্ত করে নেয় বিরাট কোহলিরা। সেই কোহলিও ছিলেন উমরানের ফাস্ট বোলিংয়ে মুগ্ধ হওয়া একজন। 


    মাঠের ডেলিভারিতে ফলের দোকানে বাড়তি বিক্রি

    উমরানের বাবা আব্দুর রশিদ পেশায় ফল বিক্রেতা। হরেক রকম ফলের সাথে বাহারি সব্জিও বিক্রি করেন তিনি। ছেলে আইপিএলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই তার দোকানের বিক্রি বেড়ে গেছে অনেকগুন। কেউ এসে আগের মতো দামাদামি করছে না, দুটো সবজি কিংবা একটা ফল বাড়তিও চাইছে না। মাঠে একেকটা ডেলিভারিতে তাক লাগাচ্ছে ছেলে, এদিকে এর সাথে সাথে বেড়ে যাচ্ছে বাবার দলের দোকানের বিক্রিবাট্টা। দারুণ না?