• " />

     

    চমক জাগানো যত শিরোপা জয়ঃ 'জার্মান' লেস্টার আর ম্যান ইন ব্ল্যাক!

    চমক জাগানো যত শিরোপা জয়ঃ 'জার্মান' লেস্টার আর ম্যান ইন ব্ল্যাক!    

    গতবারের প্রিমিয়ার লিগ জয়ী চেলসির মাঠে শিরোপা উল্লাস করছেন ভার্ডি, মাহরেজরা। দৌড়ে গিয়ে কেউ হয়ত শ্যাম্পনের ঝরনায় ভিজিয়ে দিচ্ছেন ক্লদিও র‍্যানিয়েরিকে। "চ্যাম্পিয়নে, চ্যাম্পিয়নে, ওলে ওলে ওলে" গানের সুরে তাল মেলাচ্ছে গোটা দল, আর স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের এক কোণায় থাকা লেস্টার সমর্থকেরা।  লেস্টার যদি লিগ জিতেই যায়- তাহলে নিঃসন্দেহে সেটিই হবে ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর একটি! কিন্তু ফুটবলের ইতিহাসে সাড়া জাগান এমন লিগ জয়ের ঘটনা আছে আরও। সেসব নিয়েই 'চমক জাগান যত লিগ জয়' এর দ্বিতীয় পর্ব।   

     


    আরও পড়ুনঃ প্রথম পর্ব (মালিকের মোহক আর ফন গালের পুনঃজাগরণ)



    কাইজারস্লটার্ন ১৯৯৭/৯৮ঃ

    প্রায় ১৪ বছর ওয়ের্ডার ব্রেমেনে কাটিয়ে ১৯৯৫/৯৬ মৌসুমে অটো রেহাগেল যোগ দিয়েছিলেন বায়ার্নের ম্যানেজার হিসেবে। ব্রেমেনের ওই ক্লাবটিকে ততোদিনে নিজ হাতে গড়ে করে পরিণত করেছিলেন জার্মানির অন্যতম  সেরা এক দলে। বায়ার্ন মিউনিখের চাকরীটা তো তাঁর প্রাপ্যই ছিল! তবু  সেখানে টিকতে পারলেন না। মৌসুম শেষ হবার আগেই ছাঁটাই হতে হল তাঁকে। সেটা অবশ্য মাঠে দলের পারফরম্যান্সের কারনে না, মাঠের বাইরের কান্ডে। ক্লিন্সম্যান, হেরজোগদের মতো নামকরা খেলোয়াড়দের দল চালানোর যোগ্য নন, আর পুরনো ধ্যান ধারণার অধিকারী- রেহাগেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এসবই।

    বায়ার্ন থেকে যেবার ছাঁটাই হন রেহাগেল ওই মৌসুমে বুন্দেসলিগা থেকে রেলিগেটেড হওয়া দলগুলোর মধ্যে ছিল কাইজারস্লটার্ন। মাত্র ৫ বছর আগেও যারা ছিল জার্মান বুন্দেসলিগা চ্যাম্পিয়ন! দ্বিতীয় বিভাগের এই দলটির দায়িত্বই কাঁধে তুলে নেন অটো রেহাগেল। এক মৌসুম পরই আবারও জার্মানির শীর্ষ স্তরের লিগে তুলে আনেন দলকে। আর ফিরে এসে প্রথম মৌসুমেই বুন্দেসলিগা জিতিয়ে দেন তাদের।

     

    ২০০৪ সালে গ্রিক রূপকথার জন্ম দেবার আগে অটো রেহাগেল আসলে জার্মান ফুটবলের ইতিহাসটা লিখেছিলেন নতুন করে। সে দলে ছিল না কোনো তারকা। মাঠে আর মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের দিয়েছিলেন অবাধ স্বাধীনতা, এক আনকোরা দলকে নিয়ে লিগ জিতে ১৮ বছর আগে পুরো বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন রেহাগেল। কথাগুলো কোথাও আগে শুনেছেন বলে মনে হচ্ছে? কাইজারস্লটার্নের ওই রূপকথার সাথে চাইলেই আপনি মিল খুঁজতে পারেন এখনকার লেস্টার সিটির।

    র‍্যানিয়েরি লেস্টার সিটির দায়িত্ব নিয়েই বলেছিলেন ৪০ পয়েন্ট অর্জন করাই তাঁর লক্ষ্য। ৪০ পয়েন্টের মাহাত্ম্য হল ওই পরিমাণ পয়েন্টে এর আগে কেউ কখনও দ্বিতীয় স্তরে নেমে যায়নি! রেহাগেলের
    কাইজারস্লটার্নের লক্ষ্যটাও অনেকটা এমনই ছিল। পরের মৌসুমে লিগে টিকে থাকাটা দল, সমর্থক সবার জন্যই ছিল পরম আরাধ্য!
     
    বুন্দেসলিগায় উত্তীর্ন হয়েই তাদের প্রথম ম্যাচটাই ছিল বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে বায়ার্নকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল নতুন আসা ক্লাবটি। মৌসুমের শুরুতেই ‘অঘটন’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ওই জয়। অঘটন হোক আর যাই হোক, বায়ার্নকে হারিয়ে দেবার পর সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপ বাড়াটা তো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না! প্রত্যাশাটা হয়ত লিগ জয় বা চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা পাওয়া ছিল না, তবে শীর্ষ দশে যদি কোনোভাবে তুলে নেয়া যায় দলটাকে তাতে মন্দ কী, আশা করতে তো দোষ নেই! লিগে টিকে থাকা থেকে একলাফে শীর্ষ দশ- তখনকার চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে প্রত্যাশাটা মাত্র এক ম্যাচ পরই পাহাড়সমান হয়ে গিয়েছিল সমর্থকদের।

    রেহাগেল তাঁর মুন্সিয়ানাটা দেখিয়েছিলেন এখানেই। দল একের পর এক জয় পাওয়ার পরও জার্মান এই কোচ পা রাখছিলেন মাটিতেই। খেলোয়াড়দের মাঠে দিয়েছিলেন পুর্ণ স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতাটা আসলে কেমন ছিল তা আরও ভালো বোঝা যাবে  ১৯৯৭/৯৮ মৌসুমে
    কাইজারস্লটার্নের শিরোপা জয়ী দলের এক সদস্যের কথা থেকে। কয়েক বছর আগে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মারশাল বলেছিলেন “কোচ আমাদেরকে মাঠে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তিনি শুধু দল ঘোষণা করতেন। মাঠে আমরাই আমাদের কাজটা করে নিতাম। সবাই একে অন্যকে সাহায্য করত। এমনকি স্ট্রাইকারও বল হারানোর সাথে সাথে ডিফেন্সের কাজ করত, অনেকটা এখনকার দিনের ডর্টমুন্ডের মতো”।

    অথচ পুরনো ধ্যান-ধারণার জন্য এই রেহাগেলকে বিদায় নিতে হয়েছিল বায়ার্ন মিউনিখ থেকে। র‍্যানিয়েরির চেলসি থেকে বিদায় নেয়ার ঘটনাটাও মনে আছে নিশ্চয়ই? বুড়িয়ে যাওয়া মানুষরাও যে কখনও কখনও আধুনিকতার সবচেয়ে বড় পরিচায়ক হয়ে ওঠেন তা প্রথম শিখিয়েছিলেন রেহাগেল, তারপর র‍্যানিয়েরি।  

    ডিসেম্বর গড়াতে সম্ভাব্য ৪২ পয়েন্টের মধ্যে ৩৩ পয়েন্ট অর্জন করে নেয়
    কাইজারস্লটার্ন । শিরোপার কথা তখনও মাথায় আনেনি কেউই। লেস্টার সিটিকে তো মার্চ মাস পর্যন্তও অনেকেই শিরোপার দাবিদার হিসেবে মনে করতে চায়নি! ‘জার্মান’ লেস্টার সিটির ক্ষেত্রে এর উল্টোটা ঘটারও কোনো কারন ছিল না। 



    ডিসেম্বরের পরে বাকী মৌসুমে অবশ্য
    কাইজারস্লটার্নের যতো না জিতেছিল, তার চেয়ে বেশি ড্র-ই করতে হয়েছিল। সাথে বায়ার্ন মিউনিখের বাজে ফর্মও সাহায্য করেছিল। লিগে তেত্রিশ তম ম্যাচ পর্যন্তও বায়ার্নের সমীকরণ ছিল- জিততে হবে বাকী সবগুলো ম্যাচে। আর  কাইজারস্লটার্নের হারের জন্য প্রার্থনা করা! অন্যের হার চাইতে গিয়ে  উল্টো নিজেরাই পয়েন্ট খুইয়ে বসে বায়ার্ন।

     

    মৌসুমের ১ ম্যাচ বাকী থাকতে ডুইসবার্গের সাথে গোল শূন্য ড্র করে করে জার্মানির সবচেয়ে সফল ক্লাবটি। আর ওদিকে ওলফসবার্গকে ঘরের মাঠে ১-০ গোলে হারিয়ে লিগ জিতে যায় কাইজারস্লটার্ন । মাত্র আশি হাজার অধিবাসীর জার্মান শহরে উৎসব চলেছিল পরের এক সপ্তাহ ধরে! পুরো শহর ছেয়ে গিয়েছিল লাল জার্সিতে। লালের সমুদ্রে, ছাদ খোলা এক বাসে চড়ে কাইজারস্লটার্নের খেলোয়াড়রা ড্রাম পিটিয়ে বাদ্য বাজিয়ে যোগ দিয়েছিলেন সেই উৎসবে। লেস্টারশায়ারেও এমন ঘটনা দেখার জন্য প্রস্তুতিটা নিয়েই রাখতে পারেন আপনি!

    অভেদ্য ডিফেন্স, ক্ষুরধার আক্রমণ ভাগ আর পুরো দলের এক হয়ে খেলা- এই তিনটির সমণ্বয় লিগ জিতিয়েছে লেস্টারকে।
    কাইজারস্লটার্নের ব্যাপারটা অবশ্য একটু আলাদা ছিল। ওই তিনের সমন্বয় ছিল ঠিকই, কিন্তু যাথে যোগ হয়েছিল জার্মান ফুটবলের বিখ্যাত ‘সুইপার’ রোলটিও। এই লিবেরো বা সুইপার রোলটি জার্মান ডিফেন্সের বিশেষত্ব ছিল অনেকদিন ধরেই।

    অটো রেহাগেলের
    কাইজারস্লটার্নের ‘সুইপার’ ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী চেক রিপাবলিকের খেলোয়াড় কাডলেচ। অলাফ মার্শাল ২১ গোল করে কাইজারলাউট্রেনের বুন্দেসলিগা জয়ে যতোখানি অবদান রেখেছিলেন, ‘সুইপার’ কাডলেচের অবদানও ওর চেয়ে কম কিছু ছিল না। হ্যারি কোশ, আক্সেল রুস আর মাইকেল শোনবার্গের পেছনে দাঁড়াতেন কাডলেচ। মিডফিল্ডে ওয়াগ্নার আন্দ্রেয়াস বাগের সাথে  ছিলেন ওই মৌসুমে ইন্টার মিলান থেকে যোগ দেয়া স্ফোরজা। আর স্ট্রাইকার মার্শাল তো বুন্দেসলিগার সর্বোচ্চ গোলদাতাই হয়েছিলেন। অখ্যাত খেলোয়াড়দের সে দলে ছিলেন মাইকেল বালাকেও। ওই মৌসুমে কাইজারলাউট্রেনের হয়ে খেলেছিলেন ১৬ ম্যাচ।  

     

    অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ২০১৩/২০১৪ঃ

    ফাউন্টেন অফ নেপচুনের মাথায় লাল-সাদা স্ট্রাইপের পতাকা পরিয়ে দিচ্ছেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ অধিনায়ক গ্যাবি। রিয়াল মাদ্রিদের সিবেলেস ফাউন্টেনের মাথায় সাদা পতাকা ওড়ানোর ঘটনাটা মাদ্রিদবাসীর জন্য নিত্ত-নৈমিত্যিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পানি আর সমুদ্রের রোমান ঈশ্বরের মূর্তিটা নিয়ে তো সচারচর খুব বেশি মাতামাতি হয় না এই শহরে!   


    এর কয়েক ঘণ্টা আগের কথা...

    লা লিগার শেষ ম্যাচ। নিজেদের ঘরের মাঠে জয় পেলেই গত পাঁচ মৌসুমের ভেতর চতুর্থবারের মতো লা লিগা জিতবে বার্সেলোনা। আর অ্যাটলেটিকোর চাই ড্র। ২০০৩-০৪ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার পর রিয়াল-বার্সার দূর্গ ভেঙে লা লিগা জেতা হয়নি কারও। আগের ম্যাচেই হোঁচট খেয়ে ৩ দলের শিরোপা দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। ইতিহাস সৃষ্টি করতে শুধুমাত্র একটা পয়েন্ট চাই অ্যাটলেটিকোর।

    ন্যু ক্যাম্পে সানচেজের গোলের পর তখন উৎসব দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ডাগ আউটে সিমিওনে তখনও খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন, ‘তোমরাই সেরা, ছেড়ে এসো না’। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে ডিয়েগো গোডিনের সেই গোল! ম্যাচের বাকী সময় অ্যাটলেটিকোর কাছে আর কোনো পাত্তাই পেল না বার্সেলোনা। ১-১ এ শেষ হল ম্যাচ; ১৮ বছর পর লা লিগার শিরোপা পুনুরুদ্ধার করেছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। যার হাত ধরে এলো সেই শিরোপা, শেষবার খেলোয়াড় হিসেবে তিনিই লিগ জিতিয়ে গিয়েছিলেন অ্যাটলেটিকে। সিনেমার পান্ডুলিপিতেও কী এতোটা রোমাঞ্চ থাকে?

    কাতালুনিয়া থেকে লিগ জিতে মাদ্রিদে ফিরেই নীল রঙের বাসে চেপে পুরো শহর লা লিগার ট্রফিটা নিয়ে চষে বেড়িয়েছিলেন অ্যাটলেটিকো খেলোয়াড়েরা। সেই উৎসবেরই একটা সময়ে অ্যাটলেটিকোর ‘দেবতা’ নেপচুনের গলায় নিজের ক্লাবের পতাকা পরিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাবি।



    অথচ ২০১১ সালে বড়দিনের মাত্র দু’দিন বাকী থাকতে যখন এই দলটার হাল ধরেছিলেন সিমিওনে, তখন তাঁরা ছিল লিগের ১০ নম্বরে। এক সপ্তাহ আগে স্পেনের দ্বিতীয় বিভাগের এক অখ্যাত দলের কাছে হেরে বাদ পড়েছে কোপা ডেল রে থেকেও। এক কথায় ডুবতেই বসেছিল মাদ্রিদের তুলনামূলক গরীব দলটি। সেখান থেকে মৌসুম শেষে সিমিওনে দলকে লিগে পঞ্চম করলেন, জিতলেন ইউরোপা কাপ। পরের মৌসুমের শুরুতেই উয়েফা সুপার কাপে চেলসিকে হারিয়ে দিয়ে অ্যাটলেটিকো। ওই মৌসুম শেষে জায়গা করে নেয় চ্যাম্পিয়নস লিগেও। ধাপে-ধাপে বেড়ে ওঠা অ্যাটলেটিকো লিগের শুরুতেই জানান দেয় এবারের লা লিগা শিরোপাটা আর দু’দলের মাঝে কুক্ষিগত করে রাখার পক্ষপাতী নয় তারা।    

    তবে যুক্তি কিন্তু কখনোই পক্ষে ছিল না অ্যাটলেটিকোর। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের বার্ষিক বাজেটের চেয়ে ‘মাত্র’ ৪০০ মিলিয়ন ইউরো কম নিয়ে ওই মৌসুমের যাত্রা শুরু সিমিওনে আর অ্যাটলেটিকোর। আর বার্সেলোনার বিপক্ষে লিগ জয়ের দিন মাঠে নামা অ্যাটলেটিকোর একাদশের দাম ছিল মাত্র ৪০ মিলিয়ন ইউরো; এক ফ্যাব্রিগাসকে কিনতেই এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছিল বার্সা।

    আগের মৌসুমে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ফ্যালকাও ছেড়ে গেছেন ক্লাব। ফার্নান্দো তোরেস, কুন আগুয়েরো, ডিয়েগো ফোরলানরা একেক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা হবেন আর পাড়ি জমাবেন বড় ক্লাবে- এটা যেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের নিয়তিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফ্যালকাও এর বিদায়ে বার্সেলোনা থেকে অ্যাটলেটিকো দলে ভিড়িয়েছিল ডেভিড ভিয়াকে।  

    সেই দলে এমন কোন ‘সুপার স্টার’ ছিলেন না। অথচ তাদের প্রত্যেকেই এখন তারকা। নামগুলো শুনুন- ডিয়েগো কস্তা, আর্দা তুরান, গাবি, গোডিন, লুইজ, কোকে। ছোটদল থেকেও যে মহা তারকা তৈরী করা যায় সেটাই শিখিয়েছিলেন ডিয়েগো সিমিওনে। সেই দল পুরো লিগে মাত্র ৪ বার হারল, আর ৬টি মাত্র ড্র। ঘরের মাঠ ক্যালদেরনে তাঁদের শতভাগ জয়ের রেকর্ড। আর হারগুলোর একটিও রিয়াল বা বার্সার বিপক্ষে না! অথচ এই সে দল যারা আগের ২৫ বছরে রিয়ালের বিপক্ষে জয়ের মুখ দেখেনি একটিও!

    সিমিওনের কৌশলকে আপনি খোঁচা দিতে পারবেন যথেষ্টই। ডাগ আউটের ‘দ্যা ম্যান ইন ব্ল্যাককে’ ফুটবলের মাফিয়া হিসেবেও তুলনা করতে পারেন আপনি। কিন্তু তিনি এমন মাফিয়া যিনি তাঁর দায়িত্বটা পালন করে নিষ্ঠার সাথে। প্রাচুর্য্যের চেয়ে বরং সাফল্যক্ষুধাই তাঁর কাছে বেশি দামী।  অযুহাত না খুঁজে অন্য পথেও যে জেতা যায় তা তো সিমিওনেই করে দেখালেন। লা লিগার ওই দু’দলের রাজত্ব অমন শৈল্পিক কায়দায় ধুলোয় মেশাতে আর ক’জনই বা পারতেন! সত্যি বলতে পারেননি কেউই।

     

    ন্যু ক্যাম্পের ওই ম্যাচ শেষে খোদ বার্সা সমর্থকেরাও পারেননি সিমওনে আর তাঁর দলকে সম্মান না দেখিয়ে থাকতে! অমন কীর্তি তো দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের দাবি রাখে। ন্যু ক্যাম্পের এক কোণ থেকে যে ‘অ্যাটলেটি, অ্যাটলেটি’ রব ভেসে আসছিল তা মাদ্রিদ থেকে উড়ে আসা কয়েক হাজার সমর্থকের গলার আওয়াজের চাইতে বেশিই শোনাল।     

    রিয়াল-বার্সাকে হটিয়ে ন্যু ক্যাম্পে লিগ জয়ের পর প্রথম ফোনটা সিমিওনে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলেকেই। যেমনটা ক’দিন আগেই হয়ত দেখেছেন অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারিনায়। সিমিওনে যখন অ্যাটলেটিকোর দায়িত্ব নেন তখন এই ছেলেই বাবাকে প্রশ্ন করেছিল “তুমি মেসি-রোনালদোর বিপক্ষে খেলবে?”। বাবার জন্য কী মায়াই হচ্ছিল তখন সিমিওনে জুনিয়রের? সেই বাবা রোনালদো-মেসিকে হারিয়ে ছেলেকে সেদিন কী বলেছিলেন তা হয়ত জানা হবে না কোনোদিনই। তবে ততোক্ষণে তাঁর বাবা যে ফুবটল ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন তা হয়ত আলাদা করে বোঝাতে হয়নি তাঁকে।      

     

    সেবার লা লিগা জয়ের সাথে, অ্যাটলেটিকো খেলেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও। ওই মৌসুম শেষেও দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা রীতি মেনে বেছে নিয়েছিলেন অন্য এক ‘বড়’ ক্লাব। পরের বার ‘প্যাভিলিয়নে’ ফিরেছেন আর্দা তুরান আর মাঞ্জুকিচ। তাতেও আটকানো যায়নি অ্যাটলেটিকোকে।

     

    সিমিওনের দল বদলে দিয়েছে লা লিগার গোটা হিসেব-নিকেশ। লা লিগার শিরোপার জন্য এখন নিয়মিত হয় ৩ দলের লড়াই। সে লড়াইয়ে এবারও বার্সেলোনা-রিয়ালের সাথে টক্কর দিচ্ছে অ্যাটলেটিকো। সাথে বার্সা আর বায়ার্নকে বাদ করে উঠে গেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও। এখানেই সিমিওনের স্বার্থকতা। তিনি একটি দলকে দিয়ে আসলে বদলে দিয়েছেন গোটা ফুটবলটাই।  

    চমক জাগানিয়া সব লিগ জয়ের গল্পগুলোর সাফল্যের স্থায়ীত্বকাল ছিল অল্পই। অ্যাটলেটিকো এখানে সবার চেয়ে আলাদা।