• ইউরো
  • " />

     

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৬

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৬    

    ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের আগের পাঁচটা আসর দেখেছে পাঁচটা ভিন্ন চ্যাম্পিয়ন দলকে। ইউরোর একুশতম বছর আর ষষ্ঠ আসরে এসে, অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন নতুন শিরোপাজয়ী দলকে। তবে নতুন চ্যাম্পিয়নের আশায় জল ঢেলে নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফিহাতে উৎসবে মেতে ওঠে পশ্চিম জার্মানি। 

    ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর চলাকালে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের ষষ্ঠ পর্বে থাকছে ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর ষষ্ঠ আসর আর পশ্চিম জার্মানির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।

    Image Source: Getty Images

    কেমন ছিল সেই ইউরো?

    ইউরোর ইতিহাসে সম্ভবত এই ষষ্ঠ আসরকে নিয়েই সবচেয়ে কম কথা হয়। এবং সেটা পুরোপুরি যৌক্তিক।

    আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, পূর্বের পাঁচ আসরই পেয়েছে পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন শিরোপাজয়ী দলকে। এই আসরটা সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। বার বছরের ব্যবধানে ইতালি দ্বিতীয়বারের মতো ইউরো আয়োজন করে, যদিও দর্শক উপস্থিতি আগেরবারের মতো ছিল না। ওদিকে আট বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফি ঘরে তোলে পশ্চিম জার্মানি। তবে ১৯৭২-এর আসরের মতো ততটা চমৎকার ফুটবলে দেখা যায়নি এবার।

    তবে ইউরোর ইতিহাসে এই আসরেই প্রথমবারের মতো আটটা দল অংশগ্রহণ করে মূল পর্বে। এর আগের প্রত্যেক আসরের শুধু সেমিফাইনাল এবং ফাইনালকেই ধরা হতো মূল পর্বের অংশ হিসেবে।

    জেনে অবাক হবেন যে…

    ইউরোর এই আসরেই প্রথমবারের মতো গ্রুপ পর্বের আয়োজন করা হয়। আটটা দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করে শুরু করা হয় টুর্নামেন্ট। দুই গ্রুপের সেরা দলই সরাসরি জায়গা করে নেয় ফাইনালে, মাঝের সেমিফাইনাল পর্বটা সরিয়ে নেওয়া হয়। সেই হিসেবে, দুই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি আর বেলজিয়াম খেলে ফাইনালে। ওদিকে দুই গ্রুপ রানার্স-আপ হিসেবে চেকোস্লোভাকিয়া এবং ইতালি খেলে তৃতীয় স্থান-নির্ধারণী ম্যাচ।

    টুর্নামেন্টের এই ফরম্যাটের ফলে দলগুলো তাদের রক্ষণাত্মক ট্যাকটিক্সে আরো বেশি মনোযোগী হয়। ম্যাচ জেতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে ম্যাচ না হারার দিকে। দলগুলো জানতো, একটা পরাজয়ই যথেষ্ট হতে পারে গ্রুপ থেকে বিদায়ের জন্য। 

    গ্রুপে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচে যথাক্রমে চেকোস্লোভাকিয়া এবং নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জিতে তৃতীয় ম্যাচের আগেই পশ্চিম জার্মানি ফাইনালের একটা জায়গা নিশ্চিত করে ফেলেছিল। তাই ফাইনালের আগে, চোট এবং সাসপেনশন এড়ানোর জন্য নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে দলের মূল খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেয় তারা। চেকোস্লোভাকিয়া এবং নেদারল্যান্ডসের মধ্যকার ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই দিনেই, পশ্চিম জার্মানি-গ্রিস ম্যাচের আগে। তাই অপর ম্যাচের ফলাফল এবং নিজেদের করণীয় সম্পর্কে জেনেই মাঠে নেমেছিল পশ্চিম জার্মানি।

    গ্রুপের শেষ দুটো ম্যাচ একই সময়ে অনুষ্ঠিত না হওয়ার সমস্যাটা আরো প্রকটভাবে ফুটে ওঠে দুই বছর পরের বিশ্বকাপে। আলজেরিয়াকে বিদায় করার জন্য গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে অস্ট্রিয়ার সাথে হাত মিলিয়েছিল পশ্চিম জার্মানি, বাজে এই উদাহরণের জন্য ম্যাচটাকে বলা হয় “দ্য ডিসগ্রেস অব গিজন।”

    ম্যানেজার

    ইয়ুপ ডেরওয়াল। জার্মানির প্রথম ইউরো জয়ের নেপথ্যনায়ক হেলমুট শোনের উত্তরসূরী। দীর্ঘদিন শোনের সহকারী হিসেবে কাজ করারও অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর।

    খেলোয়াড়ি জীবনে পশ্চিম জার্মানির হয়ে ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন ডেরওয়াল। কোচ হিসেবে ক্লাব পর্যায়ে খুব বেশি কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর, তবে ‘৮০-এর ইউরোতে শিরোপা জিতিয়েছেন জার্মানিকে, ফাইনাল খেলিয়েছেন ‘৮২-এর বিশ্বকাপে। “চিফ সিলভার কার্লস” ডাকনামের এই ভদ্রলোক কোচিংটা করাতেন নিজের মতো করেই। সেপ হারবার্গার বা হেলমুট শোন, পুরোপুরি অনুকরণ করতেন না কাউকেই। কোচ হিসেবে মূলত ফলাফল-নির্ভর ছিলেন তিনি, এভাবেই সসাজাতেন তাঁর দল।

    পশ্চিম জার্মানিকে কোচিং করিয়েছিলেন ডেরওয়াল; Image Source: Getty Images

    তবে জার্মার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে সময়ে সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে দল থেকে বাইরে রাখতে বাধ্য হতেন তিনি। ১৯৮২ সালে মাত্র উনিশজন খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপের জন্য ডেকেছিলেন তিনি, যেখানে সর্বোচ্চ বাইশজনকে রাখা যেত স্কোয়াডে। ডেরওয়ালের বিশ্বাস ছিল, অতিরিক্ত তিনজনকে দলে নিলে মাঠে দলের যতটুকু উপকার হবে, এর চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার মাধ্যমে।

    তবে ডেরওয়ালের কোচিংয়ের শেষের দিকে পশ্চিম জার্মানির পারফরম্যান্সের গ্রাফ ছিল একটু নিম্নগামী, সেজন্য নিন্দিতও হতে হয়েছিল তাঁকে। তখন পশ্চিম জার্মানির কোচিংয়ের দায়িত্ব ছেড়ে তুরস্কের গ্যালাতাসারের দায়িত্ব নেন ডেরওয়াল। এইটাই ছিল তাঁর কোচিং করানো শেষ দল। এরপর আর জাতীয় দল বা বুন্দেসলিগার কোন দলের কোচিং করাননি তিনি।

    গ্যালাতাসারের হয়ে তুরস্কের লিগ জিতেছিলেন তিনি, কোচিংয়ের জগতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তাঁর অধীনেই খেলেছিলেন ফাতিহ তেরিম, পরবর্তীতে যিনি কোচিং করিয়েছিলেন গ্যালাতাসারে এবং তুরস্ককে। নিজের কোচিংয়ের ওপর ডেরওয়ালের প্রভাব স্বীকার করে নেওয়া ফাতিহ গ্যালাতাসারেকে ২০০০ সালে উয়েফা কাপ জিতিয়েছিলেন, এরপর নিজের দেশকে তুলেছিলেন ২০০৮ ইউরোর সেমিফাইনালে।

    ট্যাকটিক্স

    টুর্নামেন্ট যত সামনের দিকে গড়িয়েছে, নিজের ট্যাকটিক্সে ততই পরিবর্তন এনেছেন ডেরওয়াল। প্রথম ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে খুবই রক্ষণাত্মক একাদশ নামিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষের ম্যাচে খেলিয়েছেন অতি-আক্রমণাত্মক একাদশ। ওই ম্যাচে ৩-২ ব্যবধানে জিতেছিল পশ্চিম জার্মানি।

    Image Source: The Athletic

    টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে কার্যত সাত ডিফেন্ডারের সাথে তিন অ্যাটাকার নামিয়েছিলেন ডেরওয়াল। তবে বার্নড শুস্টার ও হ্যান্সি মুলারকে মিডফিল্ডে খেলানোর পর থেকে “পাঁচ ডিফেন্ডার, পাঁচ অ্যাটাকার” নীতি অনুসরণ করেছেন তিনি। এই দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারই দারুণ প্লেমেকার ছিলেন, পারতেন খেলাটাকে ছড়িয়ে দিতে। শুস্টার খেলতেন মিডফিল্ডের ডান দিকে, বাঁয়ে খেলতেন মুলার। দুজনেই মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে উঠতে পারতেন

    হর্স্ট রুসবেখ খেলতেন সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে। পেনাল্টি বক্সে দুর্দান্ত এই পোচারের পেছনে সাপোর্ট স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগে। ক্লস অ্যালোফসের ভূমিকা ছিল বাঁ দিক থেকে আক্রমণে ওঠা। আপাতদৃষ্টিতে খুব বেশি আক্রমণাত্মক মনে হতে নাও পারে, কিন্তু ফরোয়ার্ডদের সাথে মিডফিল্ডাররাও আক্রমণে উঠলে পশ্চিম জার্মানি হয়ে উঠতো অপ্রতিরোধ্য।

    স্ট্রাইকার রুসবেখের সাথে ট্রফি হাতে কোচ ডেরওয়াল; Image Source: Getty Images

    রক্ষণ থেকে ওপরের দিকে উঠতেন উইংব্যাকরা। ডিফেন্ডারদের একজন মাঝমাঠে উঠে আসতেন, সেই একজন যে সুইপারকেই হতে হবে এমন কোন কথা নেই। আর সুইপারের ভূমিকায় টুর্নামেন্টের শুরুতে খেলেছিলেন বার্নহার্ড কালম্যান, পরবর্তীতে ইউলি স্টিয়েলাইক তাঁর জায়গাটা নিয়ে নেন।

    দুজন সেন্টারব্যাক ছিলেন ম্যান-মার্কিংয়ের জন্য। টুর্নামেন্টের শুরুর ম্যাচে রক্ষণে ছিলেন দুই ভাই, বার্নড এবং কার্লহেইঞ্জ ফর্স্টার। তবে টুর্নামেন্টের শেষের দিকে, ফাইনাল ম্যাচে খেলেছিলেন এই দুই ভাইয়ের একজনই, কার্লহেইঞ্জ ফর্স্টার। ওই ম্যাচে অধিনায়ক বার্নার্ড দিয়েজের পাশে দুর্দান্ত খেলেছিলেন তিনি।

    মূল খেলোয়াড়

    গোলরক্ষক হিসেবে পশ্চিম জার্মানি দলে দারুণ পারফরম্যান্স করেছিলেন হেরাল্ড শুমাখার। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তিন গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোল সংগ্রাহক হয়েছিলেন ক্লস অ্যালোফস। আর ওই বছরের ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগে।

    কিন্তু তাঁদের কেউই ওই দলের মূল খেলোয়াড় ছিলেন না। মূল খেলোয়াড় ছিলেন মিডফিল্ডার বার্নড শুস্টার। ২০ বছর বয়সী এই প্রতিভাবান খেলোয়াড় ডেরওয়ালের অধীনের খেলেছিলেন পশ্চিম জার্মানির বয়সভিত্তিক দলগুলোটেও। তাঁকে কোন পজিশনে খেলালে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেটার উত্তরও খুঁজে পেয়েছিলেন ডেরওয়াল। মাঝমাঠে খেলানোর কারণে বেশিক্ষণ বল পায়ে রেখে প্রতিপক্ষের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছেন শুস্টার, আর সেই মাথাব্যথাকে আরো বাড়িয়েছেন লং-রেঞ্জ শুটিং দিয়ে।

    তবে ক্লাব পর্যায়ে, কোলন দলে কখনো কখনো সেন্টার-ব্যাক হিসেবেও খেলেছেন তিনি, পালন করেছেন ম্যান-মার্কিংয়ের দায়িত্বও। সুইপারের ভূমিকায়ও খেলেছেন কখনো-সখনো, আর তৎকালীন জার্মান ফুটবলের প্রথা অনুসারে প্লেমেকাররা সময়ে সময়ে সুইপার হিসেবেও খেলতেন। ডেরওয়াল অবশ্য শেষোক্ত ব্যাপারটা পছন্দ করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, বেকেনবাওয়ারের মতো সুইপার ভূমিকায় খেলার আগে শুস্টারের অন্তত আরো দুই বছর মাঝমাঠে খেলা উচিত।

    বার্নড শুস্টার; Image Source: Getty Images

    তাই বেকেনবাওয়ারের মতো সর্বকালের অন্যতম সেরা বল-প্লেয়িং ডিফেন্ডার নাকি নেটজারের মতো দুর্দান্ত ‘নম্বর টেন’, কোন ভূমিকায় এগোবে শুস্টারের ভবিষ্যৎ, বিভিন্ন মহলে এই বিতর্কটা চলতেই থাকে।

    সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, কোলন যখন শুস্টারকে সুইপার এবং কালম্যানকে মাঝমাঠে খেলাচ্ছে, ডেরওয়াল তখন জাতীয় দলে করছেন তার উল্টো কাজ, শুস্টারকে সুইপার আর কালম্যানকে মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলাচ্ছেন।

    রেইনার বোনোফ আর হারবার্ট জিমারম্যানের চোটে শুস্টারের দলে ঢোকার রাস্তা আরো সহজ হয়ে যায়।যদিও প্রথম ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে একাদশে সুযোগ আসেনি তাঁর। প্রথম ম্যাচে সামনে রেখে ডেরওয়াল একটু বেশিই সাবধানী ছিলেন।

    তবে পরের ম্যাচে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে শুস্টারকে তার পছন্দের মাঝমাঠেই খেলিয়েছিলেন ডেরওয়াল। সোনালি চুল আর ইনসাইড-রাইট দিয়ে আক্রমণে ওঠা এই জার্মানকে এই যুগের কেভিন ডি ব্রুইনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ওই ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির প্রথম তিন গোলের সাথেই জড়িয়ে ছিল তাঁর নাম।

    প্রথম গোলে, দুইজন ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলে বক্সের বাইরে থেকে শট নেন তিনি, যদিও সেই শটটা গোলে পরিণত হয়নি পোস্টের বাধায়। তবে রিবাউন্ডে ভুল করেননি অ্যালোফস। দ্বিতীয় গোলটা এসেছিল ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে। এই গোলের ক্ষেত্রে, মাঝমাঠে বল পেয়ে ইনসাইড-রাইট ধরে ঝড়ের গতিতে আক্রমণে ওঠেন শুস্টার। এরপর বল বাড়িয়ে দেন মুলারের উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে অ্যালোফস। ভুল করেননি অ্যালোফস, তুলে নিয়েছেন নিজের দ্বিতীয় গোলটা।

    পরের গোলের কৃতিত্ব শুধু শুস্টারকে দিলে ভুল হবে না। মাঠের ডান দিক থেকে ড্রিবল করে বাইলাইনের কাছে পৌঁছে যান তিনি, এরপর গোলরক্ষক পিয়েত শ্রিভার্সকে বাধ্য করেন জায়গা ছেড়ে সরে আসতে। তখনই কাটব্যাক করেন শুস্টার, আর সামনে ফাঁকা পোস্ট পেয়ে ভুল করেননি অ্যালোফস। নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন, সাথে নিশ্চিত করেন দলের জয়ও।

    তবে ওই ম্যাচেই হলুদ কার্ড দেখেন শুস্টার। সাসপেনশন এড়ানোর জন্য গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে খেলানো হয়নি তাঁকে। আর ফাইনালের আগে অনুশীলনে পাওয়া হাঁটুর চোটটা তাঁর ফাইনালে মাঠে নামাই অনিশ্চিত করে দেয়।

    তবে চোটের আগ পর্যন্ত টুর্নামেন্টে তাঁর পারফরম্যান্স বড় দলগুলোর নজর কাড়ে। টুর্নামেন্ট শেষ হতে না হতেই বার্সেলোনা চুক্তি করে ফেলে তাঁর সাথে। বার্সায় আট বছর খেলেন তিনি, এরপর বিতর্কের জন্ম দিয়ে পাড়ি জমান প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদে। এর দুই বছর পর আরেকবার বিতর্ককে উসকে দেন শুস্টার, এবার রিয়াল মাদ্রিদ থেকে যান নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে। 

    তবে ম্যাচ সংখ্যার হিসেবে শুস্টারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি। ২৪ বছর বয়সে, মাত্র ২১টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পরেই তিনি অবসর নিয়ে নেন। এই ঘটনার পেছনে ডেরওয়াল আর জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে তাঁর বনিবনা না হওয়াকেও দায়ী করেন অনেকে।

    ফাইনাল ম্যাচ

    দারুণ এই ফাইনালের শুরুর মুহূর্ত থেকেই বেলজিয়ামের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে খেলছিলো পশ্চিম জার্মানি, তবে ফলাফলটা নিশ্চিত করতে পারছিলো না। 

    অবশেষে সেই মুহূর্তটা আসে ম্যাচের দশম মিনিটে, এবং এই গোলের পেছনেও ‘আর্কিটেক্ট’ ছিলেন বার্নড শুস্টার। মাঝমাঠে অ্যালোফসের সাথে ওয়ান-টু করতে করতে দ্রুত আক্রমণে উঠে যান শুস্টার। এরপর একজন ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে বলটা চিপ করে দেন স্ট্রাইকার রুসবেখের কাছে। বুক দিয়ে বল রিসিভ করেন রুসবেখ, এরপর বক্সের বাইরে থেকে তীব্র শটে এগিয়ে দেন পশ্চিম জার্মানিকে।

    ফাইনাল ম্যাচের একটি মুহূর্ত; Image Source: Getty Images

    জার্মানদের সুযোগ আসতেই থাকে। কিন্তু সুযোগগুলোকে গোলে পরিণত করতে পারছিলো না দলটি, বেলজিয়ান গোলরক্ষক জ্যঁ-মেরি পাফ আটকে দিচ্ছিলেন সুযোগগুলো। এরই মাঝে, খেলার গতির বিপরীতে, ৭৫ মিনিটে প্রতিপক্ষকে পেনাল্টিও উপহার দিয়ে ফেলে পশ্চিম জার্মানরা।  

    তবে উপস্থিত অনেকেই বলেছেন, বেলজিয়ান স্ট্রাইকার ফ্রাঙ্কোয়েস ফন ডার এলস্টকে করা স্টিয়েলিকের ওই ট্যাকেলটা ছিল বক্সের বাইরে। তবে সত্যিই পেনাল্টি হোক বা না হোক, ট্যাকেলটা যে খুবই ভয়ঙ্করদর্শন ছিল, সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। ১২ গজ দূর থেকে রেনে ভ্যানডারিকেনের গোলে ম্যাচে সমতা ফেরায় বেলজিয়াম।

    এদিকে ম্যাচ শেষ হতে বাকি মাত্র পনেরো মিনিট। গোল হজমের আকস্মিকতায় পশ্চিম জার্মানি যেন সাহস আর বিশ্বাসের সবটুকু হারিয়ে ফেললো। লেফট উইংব্যাক হ্যান্স-পিটার ব্রিগেল চোটে পড়ে উঠে গেলেন, শুস্টার বোধ করতে লাগলেন তাঁর অনুশীলনে পাওয়া চোটটার উপস্থিতি।

    ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত

    ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির পাসিং ছিল দেখার মতো। শুস্টার এবং রুমেনিগে নিজেদের মধ্যে পাসিং করে দ্রুত আক্রমণে উঠছিলেন। এমন দারুণ ফুটবলের মাঝে, শিরোপাজয়ী গোলটা কিনা এলো একটা সেটপিস থেকে! ব্যাপারটা ফুটবল-রোমান্টিকদের মন খারাপ করার মতোই।

    রুসবেখের গোলেই জয় নিশ্চিত হয় পশ্চিম জার্মানির; Image Source: Marca

    রুমেনিগের ইন-সুইঙ্গিং কর্নার আটকাতে গিয়ে গোলরক্ষক পাফ বেরিয়ে এসেছিলেন নিজের জায়গা ছেড়ে। কিন্তু বল অবধি পৌঁছাতে পারেননি তিনি, ওদিকে রুসবেখের হেডটা ঠিকই খুঁজে নেয় বেলজিয়ামের জাল। ম্যাচের নির্ধারিত সময়ে শেষ হতে তখন মাত্র দুই মিনিট বাকি।

    পশ্চিম জার্মানি কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?

    টুর্নামেন্টের অন্য দলগুলো তাদের সেরা ফর্মে ছিল না। চার বছর আগের চ্যাম্পিয়ন চেকোস্লোভাকিয়া তাদের সেরা সময় পেরিয়ে মনোযোগ দিয়েছিল রক্ষণাত্মক ফুটবলে। ডাচদের খেলাতেও 'টোটাল ফুটবল' এর ছোঁয়া ছিল না বললেই চলে। বেলজিয়ামের ফাইনালে ওঠার ব্যাপারটা একটু হলেও অবাক করে ছিল সবাইকে। তবে অফসাইড ট্র্যাপ ছাড়া তাদের খেলাতেও আকর্ষণীয় তেমন কিছু ছিল না। বেলজিয়ানদের রক্ষণাত্মক ধাঁচের ফুটবলটাও স্বাগতিক ইতালির মাটিতে তেমন দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। এর সাথে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে ইতালিকে পরাজিত করার ব্যাপারটা তো আছেই।

    সব মিলিয়ে, পশ্চিম জার্মানিই ছিল যোগ্য চ্যাম্পিয়ন। ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনও এই স্বীকৃতি দিয়েছিল।