ইউরোর ব্যবচ্ছেদঃ গ্রুপ 'এফ'
পর্তুগালঃ
অনেকের মতেই ২০০৪ সালের পর সবচেয়ে শক্তিশালী দল নিয়ে এবারের ইউরো খেলতে যাচ্ছে পর্তুগাল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তো আছেনই, তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বেশ কিছু তরুন খেলোয়াড়। বিশেষ করে মাঝমাঠে রেনেটা সানচেজ, উইলিয়াম কারভালহো থাকায় আক্রমণভাগে রোনালদোকে এবার হতাশ হতে দেখার সুযোগ কমই!
তবে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে অভিজ্ঞতা। ২৩ জনের দলের প্রায় অর্ধেক খেলোয়াড়রেই ২০ টির কম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এতেই অবশ্য আঁচ করা যায় কতোটা নতুন দল নিয়ে ইউরোতে যাচ্ছে পর্তুগাল।
তবে আক্রমণভাগে অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের ঘাটতি নেই। রোনালদো, ন্যানি, এডের এর সাথে এই দলে জায়গা হয়েছে রিকার্ডো কোরেসমারও।
রোড টু ইউরো
বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচেই ঘরের মাঠে আলবেনিয়ার কাছে হারার পর পর্তুগালের কোচের চাকরী হারান পাওলো বেন্তো। এরপর ফার্নান্দো সান্তোস দলের দায়িত্ব নেবার পর গ্রুপের শীর্ষেই থেকেই ইউরোতে জায়গা করে নেয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল।
টাচ লাইনের বস
পাওলো বেন্তোর পর দায়িত্ব নিয়ে ডুবতে বসা পর্তুগাল দলকে টেনে উঠিয়েছেন তিনিই। মাঝমাঠের সাথে আক্রমণভাগের সমন্বয়হীনতা দূর করতে পারাই আসলে ফার্নান্দো সান্তোসের বড় অবদান।
সাধারণত ৪-৩-৩ ফরমেশনেই দলকে খেলিয়ে থাকেন ফার্নান্দো সান্তোস। এতে করে আক্রমণভাগে বাকী সব খেলোয়াড়ের মতোই স্বাধীনতা পান রোনালদো। তরুন সব মিডফিল্ডার নিয়ে মাঝমাঠকে এক সুতোয় বাঁধবেন হুয়াও মোতিনহো। আর রক্ষণে অভিজ্ঞ পেপে, কারভালহো, ব্রুনো আলভেজ ত্রয়ী তো আছেনই। তবে দলে কোন উপযুক্ত ‘নাম্বার নাইন’ না থাকাটা কোচকে ভোগাতে পারে পরের রাউন্ডগুলোয়। তবে যার দলে রয়েছেন রোনালদোর মতো মহাতারকা তিনি শঙ্কামুক্ত থাকতেই পারেন!
তারকা খেলোয়াড়
পর্তুগালের তারকা খেলোয়াড়ের সাথে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই পর্তুগালের অধিনায়ক, মহাতারকা, ত্রাণকর্তা। বাছাইপর্ব সহ ইউরোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতার সামনে এবার আরও একটি রেকর্ড গড়ার হাতছানি। টানা চার ইউরোতে গোল করে ঢুকে যেতেন পারেন রেকর্ড বুকের আরও একটি পাতাতেও। ৩১ বছর বয়সী এই উইঙ্গারের শেষ ইউরো হয়ত নয় এটি, তবে দেশের হয়ে ইতিহাস গড়ার শ্রেষ্ঠ সময় তো এবারই।
হাঙ্গেরী:
১৯৭২ সালের পর আবার ইউরোতে জায়গা করে নিয়েছে হাঙ্গেরী। ব্যর্থতার লম্বা সময় পেরিয়ে বড় কোন টুর্নামেন্টে জায়গা করে নিয়ে স্বপ্নটা আরও দূরেই বিস্তৃত করছে দলটি। লক্ষ্য নকআউট পর্ব। দলের অন্যান্য দলগুলোই হয়ত সেই আশা দেখাচ্ছে হাঙ্গেরীকে।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলা মাত্র একজন খেলোয়াড় আছে দলটিতে। গোলকিপার পিটার গ্যালাস্কি খেলেন বুন্দেসলিগার দল রেডবুল লিপজিগের হয়ে। মাত্র এই মৌসুমেই যারা জায়গা করে নিয়েছে জার্মানির শীর্ষ লিগে।
রক্ষণটা গোছান হলেও, আক্রমণভাগে গোলের দেখা পেতে বেশ ভুগতে হয় হাঙ্গেরীকে। গোলের জন্য অধিনায়ক বালাসের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ৯ বার বিশ্বকাপ খেলা দলটি।
রোড টু ইউরো
ইউরোর বাছাইপর্বে রোমানিয়া ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের পেছনে থেকে তিন নম্বরে শেষ করে হাঙ্গেরী। পরে প্লে-অফে নরওয়ে হারিয়ে ৪৪ বছর পর আবারও ইউরোতে ফেরে মধ্য ইউরোপের দেশটি।
টাচলাইনের বস
কোচ বার্নড স্টর্কের পছন্দের ফরমেশন ৪-২-৩-১। হাঙ্গেরীর গোলবারের নিচে কোচের পছন্দ ৪০ বছর বয়ষ্ক গাবর কিরালিকেই। মাঝমাঠে লাসলোর ক্লেইনহেসলারের সাথে আছেন অধিনায়ক বালাস। বালাসের সেটপিসের ওপর ভর করেই বাছাইপর্বে বেশিরভাগ গোলের দেখা পেয়েছে হাঙ্গেরী। আক্রমণভাগে রয়েছেন ৩৭ বছর বয়স্ক সাবেক ফুলহ্যাম ও ওয়েস্টব্রমের স্ট্রাইকার জল্টন গেরা।
তারকা খেলোয়াড়
ওয়লফসবার্গের লাসলোর ক্লেইনহেসলারই দলের সবচেয়ে বড় তারকা। ২২ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার গোল করতে যেমন অবদান রাখেন, তেমনই গোলমুখে হামলা চালাতেও দ্বিধা করেন না।
আইসল্যান্ড:
বাছাইপর্ব শুরুর আগে নর্থ আটলান্টিক আর আর্কটিক ওশানের মাঝে অবস্থিত দেশটি যে ইউরোতে জায়গা করে নেবে তেমনটি ভাবেননি খুব বেশি মানুষ। ২০১৪ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা হয়নি অল্পের জন্য। দু’বছর পর ইউরোতে জায়গা করে নিয়ে সে দুঃখ এখন অনেকটা ম্লান। মাত্র ৩ লাখ ২৩ হাজার মানুষের দেশটি ইউরোতে জায়গা করে নিয়ে ইউরোপের অনেক নামী দামী দেশকেই রীতিমত লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।
বাছাইপর্বের দলটার সাথে খুব বেশি পার্থক্য নেই ইউরোর ২৩ জনের দলে। অধিনায়ক গানারসনের সাথে আছেন সোয়ানসি সিটির গিলফি সিগার্ডসন। আক্রমণভাগে জায়গা হয়েছে আইসল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা ৩৭ বছর বয়সী এডার গুডজনসনেরও।
রোড টু ইউরো
বাছাইপর্বের গ্রুপে নেদারল্যান্ড আর তুরষ্ককে পেছনে ফেলে দ্বিতীয়স্থানে থেকে প্রথমবারের মতো ইউরোতে জায়গা করে নিয়েছে আইসল্যান্ড। ষোল থেকে ২৪ দেশের ইউরো হওয়াতে নয়, নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই ইউরোতে খেলতে যাচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রটি।
টাচলাইনের বস
আইসল্যান্ডের সবকিছুই যেন অবাক করা! ডাগ আউটের কর্তাও এখানে একজন নয়। এই দলের কোচ দু’জন! লার্স লাগেরব্যাকও হেইমির হ্যালগ্রিমসন একসাথেই ২০১৩ সাল থেকে সামলাচ্ছেন আইসল্যান্ড। তাদের অধীনেই নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল সময়টাও পার করছে দলটি।
সাধারণত ৪-৪-২ ফরমেশনে খেলে থাকে দলটি। মিডফিল্ডে সিগার্ডসন আর গানার্সম্যানের সাথে দুই উইঙ্গার গুডমুনডসন, জ্যাম্যানসন পারদর্শী কাউন্টার অ্যাটাকেও। মাঝমাঠে ভারসাম্য থাকলেও, তবে ডিফেন্সে দূরন্ত গতির স্ট্রাইকারের বিপক্ষে ডিনফেন্ডাদের হিমিশিম খাওয়া একটা চিন্তার কারন হয়ে উঠতে পারে।
তারকা
সোয়ানসি সিটির মিডফিল্ডার গিলফি সিগার্ডসন কোনরকম কোন বিতর্ক ছাড়াই এই দলের সেরা খেলোয়াড়। আইসল্যান্ডের হয়ে গুডজনসনের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে দশ গোল করার রেকর্ডটাও আছে এই খেলোয়াড়ের। অসাধরণ কৌশল, মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তো আছেই সাথে ফ্রি-কিকেও দারুণ পারদর্শী সিগার্ডসন। নক আউট পর্বে জায়গা করে নিতে হলে সিগার্ডসনকে দিতে হবে নিজের সেরাটাই।
অস্ট্রিয়া:
২০০৮ সালে আয়োজক হওয়ার সুবাদে মিলেছিল ইউরোতে সরাসরি খেলার ছাড়পত্র। তবে এবারই প্রথম বাছাইপর্ব উতরে মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছে অস্ট্রিয়া। দলে ডেভিড আলাবা, আরনাতোভিচ, ক্রিশ্চিয়ান ফুশের মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে প্রথমবারের মতো ইউরোর নকআউট পর্বে ওঠার স্বপ্নটা দেখতেই পারে অস্ট্রিয়া।
রোড টু ইউরো
বাছাইপর্বে একমাত্র ইংল্যান্ডেরই অস্ট্রিয়ার চেয়ে ভালো রেকর্ড রয়েছে। দশ ম্যাচের ভেতর ৯ টিতে জয় ও একটিতে ড্র নিয়ে বাছাইপর্বে গ্রুপ রাশিয়ার চেয়ে ৮ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে সরাসরি গ্রুপ ‘এ’ থেকে ইউরোতে জায়গা করে নেয় অস্ট্রিয়া।
টাচলাইনের বস
২০১১ সালে মার্সেল কলার দায়িত্ব নেন অস্ট্রিয়া জাতীয় দলের। তারপর এক আবদারই করে বসেন সুইস এই কোচ! অস্ট্রিয়ার সব বয়সভিত্তিক দলকে যে কোন দুটি ফরমেশন নির্দিষ্ট করে খেলার পরামর্শ দেন তিনি। বোর্ড রাজি হয়ে যায়। কলারের সেই ‘আবদারের’ ফসলই আসলে এখন পাচ্ছে অস্ট্রিয়া। অনেকের মতে এই টুর্নামেন্টের ঘুমন্ত দৈত্যও তারাই। বাছাইপর্বে যেমন ঝলক দেখিয়েছে অস্ট্রিয়া, তাতে অবশ্য অনেকের সেই ধারণা ফেলেও দেয়া যাচ্ছে না!
তারকা খেলোয়াড়
বায়ার্নের হয়ে সাধারণত ফুলব্যাক পজেশনেই খেলে থাকেন। তবে দলের সামলান মাঝমাঠ। ২৩ বছর বয়সী ডেভিড আলাবার গোল করার সক্ষমতাও অনেক স্ট্রাইকারের জন্য ঈর্ষণীয়। গড়ে প্রতি চার ম্যাচে একটি করে গোল পান এই খেলোয়াড়। মাত্র ২৩ বছর বয়সে নিজেকে মেলে ধরার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর হয়ত পেতেন না আলাবা।