• দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া
  • " />

     

    বল টেম্পারিংয়ের ভিতর-বাহির

    বল টেম্পারিংয়ের ভিতর-বাহির    


    অক্টোবর ২০১৬, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

    তাঁর মন খুব খারাপ। ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় এক টেস্টে হেরে গেছেন অল্প ব্যবধানে। হাতছাড়া হয়ে গেছে টেস্ট জয়ের দুর্লভ এক সুযোগ। প্রেস কনফারেন্স শেষে বের হচ্ছেন তিনি। হতাশ, বিধ্বস্ত, ব্যথিত।

    আশাভঙ্গের বেদনায় কিংবা আক্ষেপের যন্ত্রণায় হয়তো তিনি স্বগতোক্তি করলেন, “আমার মনে হয়েছে কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না। আমি বারবার আম্পায়ারদেরও অভিযোগ জানিয়েছি। পুরনো বলও কেমন চকচক করছিল ওদের হাতে। নিশ্চয় কিছু একটা হচ্ছিল। এটা নিয়ে ক্রিকইনফোর লেখা উচিৎ।”

    ভাগ্যিস মুশফিকুর রহিম কথাগুলো অফিশিয়ালি বলেননি, বললে নিশ্চয় তুলকালাম হয়ে যেত! যে অভিযোগের তীর এতদিন ইংলিশরা অন্যদের দিকে ছুঁড়ে এসেছে, সেটাই যদি তাদের দিকেই ছুটে যায়, কীভাবে তাঁরা সহ্য করতো, বলেন?

     

    অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বর চলে এলো। তাহলে চলুন, বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দেয়া যাক তাসমান সাগর পাড়ে। 
    দক্ষিণ আফ্রিকার নিয়মিত অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্স নেই। তাই নেতৃত্বের ভার ফাফ ডু প্লেসিসের কাঁধে। পার্থে প্রথম টেস্ট জয়ের পর দারুণ ছন্দে থাকা প্রোটিয়ারা তখন দ্বিতীয় জয়ের দ্বারপ্রান্তে। হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে অজিদের ‘মরো মরো’ অবস্থা, দ্বিতীয় ইনিংসে ২৪১ রানে পিছিয়ে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়া দেড়শ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে।

     

     

    ঠিক সেই সময় প্রোটিয়া ক্যাপ্টেন ‘ফাফ’ করলেন এক কান্ড! মুখের ভেতর ‘ললি’ রেখে তারই লালার প্রলেপ দিলেন বলের উজ্জ্ব্বল অংশে। সেই ওভারেই রাবাদার বলে আউট হলেন পিটার নেভিল ও জো মেনি। প্রশ্ন উঠলো রাবাদার সক্ষমতায়। ব্যাটসম্যানদ্বয় আউট হলেন কি কারণে? রাবাদার বোলিং-গুণে? নাকি ললির লালার জন্যে?

    বিশ্বক্রিকেটে এই ঘটনা বেশ শোরগোল তুললেও, অজি-ক্রিকেট আপাতত নীরব। নিজেদের ভগ্নদশা নিয়েই যে ব্যস্ত তাঁরা, বল-এ কে কি লাগালো তা নিয়ে ভাবনার ফুরসত কই ওদের!

    অস্ট্রলিয়া ক্রিকেট না ভাবলেও, ভাবছে আইসিসি। তাই ফাফ ডু প্লেসিসকে বল টেম্পারিংয়ের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বিশ্বক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

     

    আচ্ছা, বল টেম্পারিং নিয়ে এত কথা হচ্ছে। বল টেম্পারিং আসলে কী?

    ক্রিকেটের আইন-কানুনে বল টেম্পারিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “কৃত্রিম কিছু ব্যবহার ছাড়া বলের উজ্জ্বলতা রক্ষা করা যাবে(সাধারণত থুতু বা ঘাম ব্যবহার করতে দেখা যায়)। বলে কাদা লাগলে বা বল ভিজে গেলে শুকনো তোয়ালে বা রুমাল দিয়ে তা পরিষ্কার করা যাবে। এর বাইরে অন্য যে কোন কাজই বল টেম্পারিং। নখ দিয়ে বলে খোঁচা দেয়া, পায়ের বুটের সূচালো অংশ দিয়ে বলে আঘাত করা, প্যান্টের জিপারের সাহায্য নেয়া, বোতলের ছিপি ব্যবহার, বলে ভ্যাসলিন বা ক্রিম লাগানো, মুখের মিস্টি জাতীয় পদার্থ থেকে নিঃসরিত লালার প্রলেপ মাখানো... এই ধরণের সবকিছুই অবৈধ। এরকম করলে বলা হবে, বল টেম্পারিং।”

    ক্রিকেট দর্শক মাত্রই জানেন যে, ক্রিকেট বলের ঠিক মাঝখানে সেলাই করা থাকে। সেলাই দিয়েই চর্মগোলকটির দু’ভাগ বিবেচনা করা হয়। দু’ভাবে বল বিকৃতি করা যায়। বলের উজ্জ্বল অংশটিকে আরো উজ্জ্বল করে অথবা অনুজ্জ্বল অংশটিকে আরো অমসৃণ, আরো শুকনো-খটখটে করে দিয়ে। ভ্যাসলিন, মুখের লালা, ক্রিম জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করে বলকে উজ্জ্বল করে তোলা যায়। আবার বলকে নখ দিয়ে খুঁচিয়ে, বোতলের ছিপি দিয়ে গুতিয়ে, পায়ের বুটের ধারালো অংশ দিয়ে মাড়িয়ে কিংবা প্যান্টের জিপারের সাহায্য নিয়েও বলকে অমসৃণ করা যায়।

    বলের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে লাভ বা সুবিধা কি?
     শোয়েব আকতার বলেছেন, ‘এতে বলের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। এবং বলকে নিজের(বোলারের) মতো করে ব্যবহার করা যায়। এই সময় বোলারের হাতে চলে আসে সব কর্তৃত্ব।’

    তখন বলের স্বাভাবিক প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। যেমন ধরুন, অফ স্ট্যাম্পের বাইরে একটা আউট সুইঙ্গার হলে, সেটার কি হবে? বলটি আরো ওয়াইড এ্যাংগেলে চলে যাবে। ব্যাটসম্যান স্বাভাবিকভাবেই অত বাইরের বল খেলার ঝুঁকিতে না গিয়ে ব্যাট আলগা করে ছেড়ে দিতে চাইবে। তাই তো? কিন্তু যখন বলের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট করা হয় তখন বল অস্বাভাবিক আচরণ করে। ফলে যে বল অনেকটা অফ সাইড দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা, সেটাই ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। বল তার দিক পরিবর্তন করে, হতবুদ্ধি করে দেয় ব্যাটসম্যানকে। সেজন্যেই এই ধরনের বলকে বলা হয়, উলটো সুইং বা রিভার্স সুইং!

     

    রিভার্স সুইংয়ের কথা যখন এলো, তাহলে চলে আসে আরো অনেক গল্প। যদি রিভার্স সুইং শিল্প হয়, তাহলে সেই শিল্পের সবচেয়ে সফল কারিগরদের দু’জন হচ্ছেন ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিস। এই দুজনের সুনিপুণ দক্ষতায় ১৯৯২ সালের বিলেতি গ্রীষ্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ায় পড়ে গিয়েছিল তোলপাড়। ট্যাবলয়েড, পত্রিকাগুলোজুড়ে কেবল নিন্দে আর নিন্দে। কিসের নিন্দে? বাহ রে, রিভার্স সুইংয়ের নামে বল টেম্পারিংয়ের খেলায় মেতেছে যে পাকিস্তানিরা, তার নিন্দে করতে হবে না!

    ইংলিশ মিডিয়ার সাথে যোগ দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অনেক ক্রিকেটারও। কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন জিওফ্রে বয়কট। ঠোঁটকাঁটা সমালোচক বলে জগৎজোড়া যার কুখ্যাতি। তিনি বলে বসলেন, ‘ওয়াসিম-ওয়াকার কমলা নিয়েও বল করলেও, ওদের সামলানোর সক্ষমতা নেই ইংলিশ-ব্যাটসম্যানদের।’ সুতরাং অত কথা কিসের?

    অনেক ইংলিশদেরই ধারণা, সেই সিরিজে পাকিস্তানি বোলাররা অবশ্যই বল টেম্পারিং করেছিল। যদিও প্রমাণিত হয়নি বলে, রিভার্স সুইংয়ের সফল ব্যবহার হিসেবেই দেখা হয় সিরিজটিকে।

    বডিলাইন সিরিজের পর এত আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, বিদ্বেষ-রেষারেষি আর কোন সিরিজ নিয়েই হয়নি।

    নিউজিল্যান্ডের এ্যাডাম প্যারোরেও পাকিস্তানের বিপক্ষে এনেছিলেন বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ।

    অ্যালান লাম্ব, ইয়ান বোথামরা বলে উঠলেন, বল টেম্পারিংয়ের গুরু হচ্ছে, ইমরান খান। ওকে আগে ধরো। ইমরান খান নাকি কাউন্টিতে বল টেম্পারিং করতেন। ইমরান খান থেকে চলে এলো সরফরাজ খানের নামও। তিনিই যে রিভার্স সুইংয়ের উত্তরাধিকার হিসেবে ইমরান খানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিল্পের ‘আর্মব্যান্ড’।

    ইমরান খানের আত্নজীবনীতে ১৯৮১ সালে কাউন্টিতে তাঁর বল টেম্পারিংয়ের সূত্র ধরে,  ল্যাম্ব ও বোথাম আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে। আদালতে দেখানো ভিডিও ফুটেজে স্পস্ট করে দেখানো হয়েছিলো, ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিস কিভাবে বল টেম্পারিং করেছেন। সেই মামলা চলেছিল, দুই বছর ধরে।

    রায়ে পরাজিত হয়েছিলেন বোথাম-ল্যাম্ব। ইমরান খান আদালতে নির্দোষ প্রমাণ হয়ে বলে উঠেছিলেন, এটা শুধু তাঁর জয় নয়। এটা সেই সব পাকিস্তানিদেরও জয়, যারা প্রতারণার দায়ে এতদিন ধরে সম্পূর্ণ ভুলভাবে অভিযুক্ত হচ্ছিল।

     

    আম্পায়ার, ডন অসলার। সাসেক্স বনাম ওয়ারউইকশায়ার ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন তিনি। সেসব ১৯৮৩ সালের কথা। সাসেক্সের হয়ে খেলছিলেন, ইমরান খান। সে ম্যাচে ৪.৩ ওভার বল করে, মাত্র ছয় রান দিয়ে ছয় উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তিনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে ছয়টি উইকেট নেয়ায়, ইমরানের বোলিং নিয়ে নিজের সন্দেহ জানিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলেন আম্পায়ার অসলার।

    সম্মুখ-বিতর্কে, অসলার হার মানতে বাধ্য হন ইমরান খানের কাছে। এবং তিনি নতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, জিওফ্রে বয়কটের কাছেও। বয়কট বলেছিলেন, “যদি আপনার কাছে যথাযথ প্রমাণ না থাকে, তাহলে আপনি কিছুতেই কাউকে অভিযুক্ত করতে পারেন না।”

    সেই আলোচনায় ইমরান খান তুলেছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটাও। কাউন্টিতে তাঁর সাথে আরো অনেকেই খেলতেন, অনেক গ্রেট ফাস্ট বোলারও ছিলেন। “তাহলে কেন তাঁরা একটি উইকেটও নিতে পারলেন না, এই সময়ের মধ্যে। তাঁরাও তো একই বল দিয়েই অপর প্রান্ত থেকে বল করছিলেন সে সময়।” ইমরান খানের এই বক্তব্যের উত্তর ছিল না কারও কাছে।

    যদিও ইমরান আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত করতে পারেনি কেউই। তবুও ইমরান খানকে নিয়ে প্রশ্ন উঠে এখনও। তাঁরই স্বদেশী আমির সোহেল বলেছিলেন, “ইমরান পুরো পাকিস্তান ক্রিকেটকেই ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি তরুণদের রিভার্স সুইংয়ের নামে বল টেম্পারিংয়ে উৎসাহিত করেছেন। ফলে পাকিস্তান এখন বঞ্চিত হচ্ছে সত্যিকারের ফাস্ট বোলার থেকে।”

    আরেক স্বদেশী সাদিক মোহাম্মদের তোপও ছিল পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের দিকেই। “আপনি কোনভাবেই স্বদেশকে, পাকিস্তানের ক্রিকেটকে এভাবে ধ্বংস করতে পারেন না। বিশ্বের কাছে নিজের দলটাকে কলংকিত করার কোন অধিকারই নেই আপনার।”

    ইমরানের সোজাসাপ্টা জবাব ছিল, আমি কোন অন্যায় করিনি। কেন আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, ট্যাবলয়েডের কথা বিশ্বাস করছেন?

     

    বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ আজকের নয়, বহু পুরনো। আশির দশক পর্যন্ত ব্যাপারটা ফিসফিসানির পর্যায় থাকলেও নব্বইয়ের দশকে এসে শোরগোলে চড়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীতে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ক্যামেরার বাহুল্যে তো বল টেম্পারিং আর লোকচক্ষুর অন্তরালে হওয়ার কোন উপায়ই নেই।

    শোয়েব আকতারের ধারণা এমনই। “ম্যাচ ফিক্সিং, বল টেম্পারিং ক্রিকেটে অনেক আগে থেকেই ছিল। পার্থক্য কেবল তখন এত নজরদারি ছিল না, আর এখন বেড়ে গেছে নজরদারি।” ব্যাটিং-বান্ধব পরিবেশে তিনি চান, বল টেম্পারিং যেন বৈধ করে দেয়া হয়। নখ দিয়ে একটু আঁচড়, জিপারে একটু ঘষা যদি বলে দেয়া না যায়, তাহলে বোলাররা এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকবেন কিভাবে!

    শোয়েব বেশ কয়েকবারই বল বিকৃতির দায়ে শাস্তি ভোগ করেছিলেন। এবং অকপটে স্বীকারও করেছেন, তিনি বল টেম্পারিং করতেন।

    চেতন শর্মাও অস্বীকার করেননি, বল টেম্পারিংয়ের দায়। তিনি বলেন, “আমাদের সময় তো অত নিয়ম-কানুন ছিল না। তাই আমরা বলে খোঁচাখুঁচি করতাম। জানতামও না যে, এটা বল টেম্পারিং। এটা অপরাধ। অবশ্য নখ ছিল না বলে, নখ দিয়ে হয়তো আঁচড়াতে পারতাম না। কিন্তু বোতলের ছিপি দিয়ে ঠিকই বল এর অবস্থার পরিবর্তন করতাম।”

     

    চেতন শর্মা স্বীকার করলেও, শচীন টেন্ডুলকার গত দেড় দশক ধরেই বলে আসছেন, তিনি ‘বল টেম্পারিং’ করেননি। ২০০১ সালে দক্ষিন আফ্রিকায়, বল টেম্পারিংয়ের দায়ে দন্ড পেয়েছিলেন ক্রিকেটের অন্যতম পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী। ম্যাচ রেফারী মাইক ডেনিসের সাথে বাক বিতন্ডতায় জড়িয়ে পড়েছিল, পুরো ভারতীয় ক্রিকেট মহলই। ভারতের পথে পথে জ্বলে উঠেছিল ক্ষোভের আগুন। ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিলো, শচীন বলের সিমে হাতের নখ দিয়ে আঁচড় কাঁটছেন। টনি গ্রেগ তাই বলে উঠেছিলেন, ‘এই চিত্র দেখার পরও কি কেউ বলবে তিনি বল টেম্পারিং করেননি? কেন, তিনি শচীন টেন্ডুলকার বলে?’

    সৌরভ গাঙ্গুলি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই অভিযোগ। মাস্টার ব্লাস্টার শচীন টেন্ডুলকার স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি বলের গায়ে লেগে থাকা ঘাস-কাঁদা তুলছিলেন। বলের আকৃতির পরিবর্তন করেননি।

    ক্রিকেটের চিরন্তন ভদ্রলোকদের একজন শচীনের সতীর্থ, রাহুল দ্রাবিডও শাস্তি ভোগ করেছিলেন, বল টেম্পারিংয়ের দায়ে। সেটা অবশ্য ২০০৪ সালে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওডিয়াই ম্যাচে, অস্ট্রলিয়ায়।

                                                   অভিযোগ উঠেছিল ওয়াকারের বিরুদ্ধেও 

    ওয়াকার ইউনিস ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি বল টেম্পারিংয়ের শাস্তি ভোগ করেছিলেন। সেটা ২০০০ সালের ঘটনা। তাঁর সতীর্থ আরেক পাকিস্তানি আজহার মেহমুদও অভিযুক্ত হয়েছিলেন একই অপরাধে। ফাফ ডু প্লেসিস আবার প্রথমবার বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, পাকিস্তানেরই বিপক্ষে। ২০১৩ সালে, দুবাইয়ে।

    শহীদ আফ্রিদী দন্ড পেয়েছিলেন হাস্যকর এক কান্ডে। ২০১০ সালে অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে, কোকাবুরা বল কামড়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। আফ্রিদী অবশ্য পরে ক্ষমাও চেয়েছিলেন, এই ন্যাক্কারজন কর্মকান্ডের জন্য।

     

    মাইক আথারটনের কান্ডটাও বিখ্যাত হয়ে আছে ক্রিকেটের ইতিহাসে। পকেট থেকে ধূলি বের করে বলে মাখাতে লেগেছিলেন, তখনখার ইংলিশ-ক্যাপ্টেন আথারটন। এজন্য কোন শাস্তি অবশ্য পেতে হয়নি তাকে।

    দক্ষিন আফ্রিকান প্যাট সিমকক্সের কান্ডটা ছিল বড় অদ্ভুত। বলে নখ দিয়ে ইচ্ছেমতো আঁচড় কাটার পর, পুরো বলটি তিনি জার্সির হাতা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বগলের তলায়! আম্পায়ারদের নজর এড়ায়নি তা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বলটি পরিবর্তন করে নেন। আথারটনের মতো সিমকক্সও বেঁচে গিয়েছিলেন শাস্তি থেকে।

    জিমি এন্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রডের ব্যাপারেও উঠেছিল, বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ। রুটও বাদ যাননি অভিযুক্তের তালিকা থেকে। বব উইলসও আঙ্গুল তুলেছিলেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে। শ্রীলংকার বিপক্ষে এক ওয়ানডে ম্যাচে হঠাৎ করে বল বদলে দেন, আম্পায়াররা। এই নিয়ে ইংলিশ বোলার ও ক্যাপ্টেন কুকের দিকে, বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনেছিলেন উইলস।

    একই রকম অভিযোগ এনেছিল নিউজিল্যান্ডও, ২০০৯ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে, উমর গুলের বিপক্ষে।

    এ সমস্ত অভিযোগগুলি অবশ্য অভিযোগ পর্যন্তই থেকে যায়, দোষী সাব্যস্ত হননি কেউই।

     

     

     

    বল টেম্পারিংয়ের বহুল আলোচিত ঘটনা বলা হয় ‘ওভাল-গেট’ কেলেংকারী। বলা নেই, কওয়া নেই ২০০৬ ওভাল টেস্টে ধুম করে বল বদলে দেন আম্পায়ার বিলি ডকট্রোভ ও ড্যারেল হেয়ার। সঙ্গে পাঁচ রান পেনাল্টি দেন পাকিস্তানকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার পরও, পাকিস্তান-দলনায়ক ইনজামাম উল হক খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেন।

    চতুর্থ দিনের চা-পান বিরতির পর, দুই আম্পায়ারই মধ্য মাঠে পৌছে যান, ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান কলিংঊড ও ইয়ান বেলও মাঠে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিলেন। দেখা নেই কেবল ফিল্ডিং দলের! পাকিস্তান ড্রেসিং রুমের দিকে বারবার তাকিয়ে থাকার পরও কোন সাড়া পাচ্ছিলেন না, আম্পায়াররা। কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পর তাঁরা উঠে আসেন মাঠ থেকে। পৌনে এক ঘন্টা পর পাকিস্তান মাঠে গেলেও, আম্পায়াররা আর মাঠে যাননি।

    এবং নিয়ম অনুযায়ী, ইংল্যান্ডকে জয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও পাকিস্তান পরে খেলতে আগ্রহী হয়েছিল, কিন্ত আম্পায়াররা ম্যাচ পরিচালনায় আর রাজী ছিলেন না।

    আইসিসি ম্যাচটি পরে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে। কিন্তু বছর খানেক পরে, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আবার ইংল্যান্ডকেই জয়ী হিসেবে ঘোষণা করেছিল।

    এই ঘটনা নিয়ে কিংবদন্তী জিওফ্রে বয়কট বলেছিলেন, “আপনি যখন খেলার সময় তখন খেললেন না। পরে বললেন যে খেলবেন, এটা তো আসলে হয় না। নিয়ম আছে, আইন আছে। আমি বুঝতে পারছি পাকিস্তানের অবস্থা। আপনি প্রতারক নন, তবুও আপনাকে বলা হচ্ছে প্রতারণা করেছেন। এটা আসলেই মেনে নেয়া যায় না।”

    ইনজামাম পুরো দায়টা দিয়েছিলেন আম্পায়ারদের উপর। “ওরা বল পরিবর্তন করছিল, অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কেন বল পরিবর্তন করছেন? বল-এ কি সমস্যা? ওরা আমাকে বলেছিল, বল-এ সমস্যা আছে। আমি বললাম, বল আমাকে দেখান। বল দেখাটা আমার অধিকার। ওরা আমাকে বল দেখালো, সেখানে আমি কিছুই দেখলাম না। তবুও তাঁরা বল পরিবর্তন করল। পাঁচ রান পেনাল্টি দিল। কেন? এখানে স্কাই স্পোর্টসের ২৬টি ক্যামেরা আছে। বল টেম্পারিংয়ের কোন প্রমাণ কেউ দেখাক।”

    পাকিস্তানের বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও, পাকিস্তান অভিযুক্ত হয়েছিল। দন্ড পেয়েছিল। ক্রিকেটের শতবর্ষী ইতিহাসে আর কোন ম্যাচের পরিণতি এভাবে হয়নি।

     

    ১০

    জানুয়ারী ১৯৭৭, চেন্নাই, ভারত।

    টানা তিন টেস্ট হারে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ভারত। অধিনায়ক বিষেন সিং বেদীরও মানসিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। সিরিজ হাতছাড়া হয়ে গেছে, তাও আবার দেশের মাটিতে। ন্যুনতম প্রতিরোধ দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছে তাঁর দল। সব মিলিয়ে অধিনায়কের মনোজগতে চলছে এক উথাল-পাতাল ঝড়। সেই ঝড় সামলে তিনি তুলে দিলেন আরেক ঝড়। সাংবাদিকদের কাছে জানালেন, তাঁর মনে হচ্ছে ইংল্যান্ড কিছু একটা অন্যায় করছে।

    দিল্লী টেস্টে অভিষেক ইনিংসেই ‘জন লেভার’ পেয়েছিলেন সাত উইকেট। চেন্নাইয়েও পেয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। অভিযোগ উঠেছিল, জন লেভার ভ্যাসলিন ব্যবহার করে বলের একপাশ উজ্জ্বল করে ‘বল টেম্পারিং’ করেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছিল,

    "True, with Vaseline ball keeps its shine
    Lever, bowl true, if you have spine"

    বেদী বলেছিলেন, “আম্পায়ারদের আমি বলেছি, তাঁরা যেন বিষয়টা খতিয়ে দেখেন। ওরা বলের একটা পাশ বেশ উজ্জ্বল করে তুলছে। ইংল্যান্ডের এত নীচে নেমে যাওয়টা আসলে ন্যাক্কারজনক ব্যাপার।” 

    ১১

    ১৯৭৭ থেকে ২০১৬, চেন্নাই থেকে চট্টগ্রাম। বল টেম্পারিংয়ের কত-শত ঘৃণ্য ঘটনায় কলংকিত হয়েছে ক্রিকেট। কত শুভ্র-সুমহান ক্রিকেট চরিত্রেও চাঁদের কলংকের মতো, লেগে গেছে বল টেম্পারিংয়ের কালো দাগ!

    ক্রিকেটে সিন্দাবাদের ভূতের মতো সওয়ার হয়ে আছে এই বল টেম্পারিং। কেউ বলেন, উঠিয়ে ফেলা হোক নিষেধের যত বেড়াজাল। আবার কেউ বলেন, উঁহু, ক্রিকেট ‘জেন্টেলম্যানস গেইম’, এখানে কোন অশোভন আচরণ রাখা ঠিক হবে না। কখনো কানাকানি কখনো ফিসফিসানি, কখনো হৈচৈ কখনো হট্টগোল, কখনো আড়ালে-আবডালে, কখনো প্রকাশ্য-দিবালোকে, বল টেম্পারিং চলছেই। কেউ অভিযুক্ত হচ্ছেন, কেউ শাস্তি পাচ্ছেন, কেউ বা  বেঁচে যাচ্ছেন।
    কিন্তু বল টেম্পারিংয়ের সীমা আসলে কোথায়, সেটি নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি যেমন বলছেন, টেম্পারিং কোন অপরাধই নয়। কিন্তু আইসিসি কি সেটা মানবে? এই বিতর্ক কি চলতেই থাকবে?