• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    উন্নতির আছে অনেক কিছুই

    উন্নতির আছে অনেক কিছুই    

     এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে অনেকভাবেই। দল হিসেবে একাট্টা হয়েই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খেলছে কোয়ার্টার ফাইনালে। তারপরও দলে এখনও উন্নতির অনেক সুযোগ আছে। ওপেনিং নিয়ে অস্বস্তি, ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে দোলাচল, স্পিনারদের খানিকটা বিবর্ণ রূপ... বাংলাদেশ দলের "একিলিস হিলের" জায়গাগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন আমিন শিমুল। 

     

     

    বিশ্বকাপ নতুন যাত্রা শুরু করে করেছিলো অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডেই সেই তেইশ বছর আগে। রঙিন জার্সি, দিবারাত্রি ম্যাচ আর ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সূচনাও সেই বিশ্বকাপের হাত ধরে। সেই অভিনবত্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন একজন উদ্ভাবনী মার্টিন ক্রো। স্পিন দিয়ে ওপেন করে বিপক্ষে চমকে দেয়া, কিংবা গ্রেটব্যাচকে ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে পিঞ্চ হিটিং করে বিপক্ষকে শুরুতেই চাপে ফেলে দেয়াটা ওয়ানডে ক্রিকেটকে নতুন করে দেখিয়েছিলেন ক্রো।

     

     

    আজ তেইশ বছর পরে যখন সেই উৎসমুখে ফিরল রঙিন জার্সির বিশ্বকাপ, তখন অবশ্য বিশ্ব ক্রিকেট রঙে রূপে অনেক খানিই বদলে গেছে। সেই বদলে দেয়াকে আরো বদলে দিলো কিনা বিশ্বকাপ সেটা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। তবে, সত্যিকার অর্থে, অস্ট্রেলিয়ার রূপ বৈচিত্রে ভরা পিচ গুলো মোটামুটি উধাও এই বিশ্বকাপে। ব্যাটসম্যানের বুকে কাঁপন ধরিয়ে পার্থের ওয়াকা পিচে সাপের মত ছোবল দেয়া বাউন্স, গ্যাবার চিরায়ত স্পোর্টিং রূপ, সিডনীর স্পিন ধরা উইকেট, অ্যাডিলেডের স্লো লো ন্যাচার, কিংবা এমসিজির কোমর উচ্চতার ট্রু বাউন্স খুব বেশি খুঁজে পাওয়া গেলো না। বরং যা পাওয়া গেলো সেটা আসলে বোলারদের খুন করবার নাট্যমঞ্চ। যেখানে মোটামুটি নিয়মিতভাবেই বোলাররা বেধড়ক পিটুনি খেয়ে বড় জোর বাংলা সিনেমার টেলি-সামাদের ভূমিকা নিতে পারলেন। নিউজিল্যান্ডের পিচ গুলো বরং তুলনামূলক প্রাণময় ছিলো। সুইং বাউন্সের খেলাও কিছুটা দেখা গেলো সেখানে। তবে সেটাও মোটামুটি বেশিরভাগ খেলায় অর্ধেক ইনিংস হবার আগেই উধাও। সেই সাথে ছোট মাঠ যোগ করলে বোলারদের জন্য এখন পর্যন্ত দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ।

     

     

    এই বিশ্বকাপটি বড় হয়ে থাকবে মূলত তথাকথিত ছোট দলগুলোর দৃঢ় লড়াই আর ক্রিকেট মোড়ল ইংল্যান্ডের পিছু হটার জন্যও। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এই বিশ্বকাপ আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে বিশেষ হয়ে থাকবে তাদের দলের আগমনী বার্তাতে।

     

     

    বাংলাদেশ মোটামুটি দল হয়ে উঠতে শুরু করেছে গত তিন চার বছরেই। তবে সেই উন্নতি বিশ্বের কাছে প্রকাশের ঘোষণা এল যেন এই বিশ্বকাপের হাত ধরে। বিশ্বকাপে আমাদের পদচারণা ১৬ বছর হলেও এদিক ওদিক কিছু জয় ছাড়া বলবার মত কিছু ছিলো না। তাছাড়া খেলা প্রতিকূল কন্ডিশনে হবে বলে কিছুটা আশঙ্কাও যে ছিলো না এমন না। তবে সেই সকল আশঙ্কার মেঘকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের দল হয়ে উঠার ঘটনা এলো গ্রুপ পর্বের মাধ্যমে। আমাদের পা কোয়ার্টারে, হয়তো অনেক রোমান্টিকদের কাছে স্বপ্ন ডানা মেলটে শুরু করেছে আরও দূরে। আর মাত্র দুটি ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে অসম্ভব এক স্বপ্ন। তবে বাস্তবতা হলো, ধারে এবং ভারে হয়তো অন্য সব গুলো দলের চাইতে বেশ একটু পিছিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, অন্য দলগুলোর সাথে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো, অন্যদলের যে কোন খেলোয়াড় যে কোন দিন ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে। তুলনামূলক আমাদের খেলা নির্ভর করে পুরো দলের একটি ইউনিট হয়ে পারফর্ম করবার উপর। তবে পারফর্মের সাথে দলের সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে নেওয়াটাও টিম ম্যানেজম্যান্টের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।

     

     

    এই বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সম্ভবত আমাদের পেস ট্রায়োর একসাথে পারফর্ম করা। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের ম্যাচে তাদের পারফরম্যান্স ছিলো এক কথায় দারুণ। আমরা সম্ভবত ডেথ ওভারে আল আমিনের সার্ভিস মিস করছি। তবে আপাতত বাকিরা পারফর্ম করে সেই শূন্যতা পূরণ করবে এমন প্রত্যাশা করাই যায়। মাশরাফি বোলিংয়ে সবসময়ই দারুণ। লাইন লেংথ নিশানা, উইকেট সবই ছিলো তার বোলিংয়ে। রুবেল আর তাসকিনকেও সময়ে সময়ে উইকেট নিয়ে জ্বলে উঠতে দেখেছি আমরা। তবে তারা দুজনেই একটু খরুচে। উইকেটে নেয়ার পাশাপাশি জায়গায় বল ফেলে প্রেশার ধরে রাখার কাজটায় তারা আরো মনযোগ দিতে পারলে আমরা আরো ধারলো হব একথা বলা যায়। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের সাথে মিডল ওভারে আমাদের বোলাররা কখনোই বিপক্ষের উপর চাপ তৈরি করতে পারে নি। উইকেট নিতে না পারলেও বেসিক ঠিক রেখে বিপক্ষের উপর চাপ দেয়ার শিক্ষা আয়ত্ব করাটাও জরুরি।

     

     

    মিডল ওভার বোলিংয়ের কথা আসলে স্পিনারদের কথা অবধারিতভাবেই আসবে। আমাদের সাকিব এখনও পুরোপুরি মেলে ধরতে পারে নি। তবে সাকিবের মূল ব্যাপার হলো তার খারাপ দিনেও সে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেয়। এই আত্মনিবেদনটুকুও দলের বাকিদের জন্য খুব অনুপ্রেরণামূলক। এক ম্যাচ দেখে তাইজুলকে খুব সাদামাটা মনে হয়েছে। সানি বরং জায়গায় বল ফেলে যাওয়ার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করেছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবেই নাসির দারুণ ফল বয়ে এনেছেন বল হাতে। স্কটল্যান্ডের সাথে তার ড্যামেজ কন্ট্রোল বোলিং ছিলো খুবই ফলপ্রসূ। আর নিউজিল্যান্ডের সাথে তো  হেরে যাওয়া ম্যাচে দলকে ফিরিয়ে এনেছিলেন খেলায়। তবে রিয়াদকে কিছুটা আন্ডার-বোওলড মনে হয়েছে। খুব সম্ভবত ব্যাটিংয়ে নেট বেশি সময় দেয়ার কারণে বোলিংয়ে সময় দিতে পারেন নি।

     

     

    রিয়াদের ব্যাটিং বাংলাদেশের দলকে একটা বড় সমস্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মাঝের ওভারে স্থিতি দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে একটা সমালোচনা সব সময়ে হয়। সেটা হলো ব্যাটসম্যানেরা বেশি চালিয়ে খেলেন। এই জায়গাতে রিয়াদ চমৎকার একটা ভারসাম্য এনে দিয়েছেন। তুলনামূলক স্ট্রোকসমৃদ্ধ সৌম্য,মুশফিক,সাকিবরা তার সাথে থাকলে স্ট্রোক খেলতে পারেন স্বাধীনভাবে। এই জায়গাতে কোচের পরিকল্পনার প্রশংসা করতে হয়। সেই সাথে প্রশংসা করতে হয় সৌম্য ও সাব্বিরের। দুই তরুণ বিশ্বকাপের মত বড় আসরে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় পারফর্ম করেছেন তা আসলেই দারুণ। এই দুজন বরং দলের জন্য গোপন অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছেন। তবে ব্যাটিং অর্ডারে সাকিব/মুশফিক জায়গা বদলের ব্যাপারটা টিম ম্যানেজম্যান্ট চিন্তা করতে পারেন। টি২০ খেলে সাকিবের খেলার ধরন আসলে শেষের দিকে বিপদজনক। তাই শেষ ১৫-২০ ওভারে ফিনিশ করতে সাকিবকে নামালে তিনি বেশ ফলপ্রসু হবেন এমনটাই মনে হয়।

     

     

    তবে এত কথার পরেও আরও কিছু কথা রয়ে যায়। প্রথমত তামিমের ফর্মহীনতা। তামিম ইনজুরি থেকে ফিরে এসেছেন। তাই তার একটু সময় লাগবে নিজেকে ফিরে পেতে। আমাদের সমস্যা হলো তার সেটেলড পার্টনার বিজয় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছিটকে গেছেন। তার জায়গায় কায়েসকে নিয়ে যাওয়াটা হয়তো ভুল নেই, তবে মাত্র দুই নেট সেশনের পরে অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশনে ওপেন করতে নামানোটা খুব বেশি সুবিবেচনাপ্রসু কাজ হয় নি এমন বলা যায়। মূল কথা হলো, তামিম এনামুলের পরে তৃতীয় ওপেনার হিসাবে গেছেন সৌম্য। তিনি তিনে সেটেলড হয়ে যাওয়ায় হয়তো তাকে সরানো হচ্ছে না। অন্যদিকে মমিনুলের মত চমৎকার একজন খেলোয়াড় বাইরে বসে আছে, খুব সম্ভবত নিউজিল্যান্ডের সাথে কায়েসের পরিবর্তে সৌম্যকে ওপেন করিয়ে মমিনুলকে তিনে খেলিয়ে দেখা যেত।

     

     

    কোয়ার্টার ফাইনালের আগে দাঁড়িয়ে তাই দল নিয়ে একটা ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। দেড় সপ্তাহ থেকে কায়েস নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন এমন ভাবনায় তাকে আরেকবার সুযোগ দেয়া, নাকি সৌম্যকে ওপেনে পাঠিয়ে মমিনুলকে খেলানো নাকি কায়েসকে বাদ দিয়ে নাসির-সানি দুজনকে খেলানো? এই জায়গাতে সঠিক কোন উত্তর নেই। তবে টিম ম্যানেজমেন্টের থট প্রসেস দেখে আপাতত আমার মনে হয় নিউজিল্যান্ড একাদশ থেকে তাইজুলের জায়গায় মাশরাফি আসবেন শুধু। কায়েসের সামনে আরেকটি সুযোগ থাকবে বটে। তবে বাজে ফর্মের চাপে বাজে খেলে তার বাংলাদেশ বাদ হলে তার ক্যারিয়ারও হয়তো ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। পরিশেষে তামিমের ব্যাপারে বলি। তামিমের ফর্ম ফিরে পাবার মাধ্যমেই হয়তো বাংলাদেশ টিমের শক্তি মত্তার পূর্ণতা পাবে। চার বছর অনেকটা সময় পথ। আর তখনকার সময়ে কী হবে কেই-বা বলতে পারে। ২০০৭ এর বিশ্বকাপের কুড়ি হয়ে আসা তামিমের ফুল হয়ে ফোটার সবচেয়ে দারুণ জায়গা হয়তো কোয়ার্টার ফাইনালেই হবে।

     

     

    বাংলাদেশ দলটির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন তাদের শরীরী ভাষায় আর মানসিকতায়। হেরে যাবার আগে না হারার এই মানসিকতাই দলটিকে এতদূর এনেছে। কোচিং স্টাফের সবাই এজন্য অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন। তবে সবচেয়ে বড় হাততালি মাশরাফির জন্য। তার নিজের সহজাত আক্রমনাত্মক ভঙ্গিটা তিনি দলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এভাবেই একজন দারুণ ক্যাপ্টেনের ব্যাক্তিত্বের প্রতিফলন দলের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়। হয়তো এই বিশ্বকাপের হাত ধরে আমাদের রানাতুঙ্গাকে খুঁজে পাওয়াটাই দিন শেষে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বাস্তবতার নিরিখে বিপক্ষ দল নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের সেরা খেলাটা খেলে আসার চেষ্টা করাই উচিত। আর আমি নিশ্চিত মাশরাফির বাংলাদেশ সেই চেষ্টার প্রতিফলন ঘটাবে সামনের ম্যাচ গুলোতেও।

     

     

    শুভকামনা বাংলাদেশি টাইগার্স।

    শুভকামনা মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিপ রকিং উইথ ইউর গুড ওয়ার্কস।