বাংলাদেশের 'অন্যরকম' ফেরা
কাল যখন ওভালে টস করতে নামবেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, রোমাঞ্চ-শিহরণের অন্যরকম একটা ঝাপটা কি বাংলাদেশ অধিনায়কের চোখেমুখে খেলা করবে? ইংল্যান্ডে তো এর আগেও টস করেছেন, নতুন কিছু নয় তাঁর কাছে। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেই সৌভাগ্য তো এখনো হয়নি মাশরাফির। তার ওপর সেটা করতে যাচ্ছেন অনেক প্রথমের সাক্ষী ওভালে। মাশরাফির জন্য দিনটা অন্যরকমই হওয়ার কথা।
হয়তো বলতে পারেন, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তো আর বিশ্বকাপ নয়। এটা নিয়ে আলাদা উত্তাপ-রোমাঞ্চেরই বা কী আছে? এমন নয়, এই ট্রফিতে বাংলাদেশ এবারই প্রথম। ১৯৯৮ সালে দেশের মাটিতে সেই মিনি বিশ্বকাপের পর তো চার বার খেলা হয়েছে এই প্রতিযোগিতায়। এরপর অবশ্য ১১ বছর দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছে, মাশরাফি নিজেই তো চোটের জন্য দুই বার খেলতে পারেননি। সর্বশেষ তিনটি ম্যাচ অবশ্য খেলেছেন, কিন্তু সেটা এমন কিছু মনে রাখার মতো নয়। এই দলের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে যা একটু সুখস্মৃতি, তা তো শুধু সাকিব আল হাসানেরই। সেই ২০০৬ সালে ভারতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বার্তা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছে ভবিষ্যত ভরসাকে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ৬৭ রানের ইনিংস ছিল তাঁর প্রথম ফিফটি, পরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের একমাত্র জয়েও ৩৬ রান করে অবদান রেখেছিলেন। সেখানে মাশরাফির রেকর্ড রীতিমত দীনহীন, তিন ম্যাচে মাত্র দুইটি উইকেট। বরং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ৩০ রানটাই যা একটু মনে পড়ার মতো। তাহলে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে বাংলাদেশ অধিনায়কের ‘অন্যরকম’ মনে হবে কেন?
বাংলাদেশ যে ১১ বছর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পারেনি, সেখানে পাওয়া যাবে উত্তরের প্রথম পত্র। আর দ্বিতীয় পত্রের উত্তরটা পাওয়া যাবে এই বাংলাদেশ দলের কাছেই। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি যখন ঠিক কুলীন হয়নি, সেই ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা চার আসরে নিয়মিতই ছিল বাংলাদেশ (হোক সেটা বাছাইপর্বে)। এরপর আট দলের হয়ে যাওয়ার পর থেকে আবার হয়ে গেল দর্শক। কাকতালীয়ই বটে, ২০০৬ সালের পরের বছরেই প্রথমবারের মতো র্যাঙ্কিংয়ের নয়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশ, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তখন হয়ে গেছে আট দলের। বাংলাদেশ অবশ্য ২০১১ সালে ক্ষণিকের জন্য আট নম্বরে উঠে এসেছিল, কিন্তু সেটা ধরে রাখতে পারেনি। ২০১৩ সালের আসরেও তাই দর্শক হয়েই থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১১ বছর পর ‘জাতে উঠতে’ পেরেছে বাংলাদেশ, জায়গা করে নিয়েছে শীর্ষ আটে। সেটা বললে অবশ্য পুরোটা বলা হয় না, বাংলাদেশ তো এই আসর শুরু করেছে শ্রীলঙ্কাকে টপকে ছয়ে থেকে। তিন বছর আগেও যে দলটা নয়ে ছিল, তাদের জন্য এই যাত্রা তো স্বপ্নের মতো।
তবে মাশরাফি বেশি রোমাঞ্চিত থাকবেন উত্তরের অন্য অংশটুকু নিয়ে। র্যাঙ্কিং যেটা বলছে, এই দলের সামর্থ্য যে এর চেয়েও বেশি সেটা বাংলাদেশ অধিনায়ক ভালোই জানেন। নিজে টি-টোয়েন্টি ছেড়ে দিয়েছেন, ধ্যানজ্ঞান এখন শুধুই ওয়ানডে। এরকম বৈশ্বিক আসরে খেলার সুযোগ দুই বছরের মধ্যে নেই, সেটাও জানেন। নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য বাড়তি কোনো প্রেরণার নিশ্চয় দরকার নেই তাঁর।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডবেরই’ এবারের আসর হতে পারে নিজেদের চেনানোর সেরা মঞ্চ। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ- অনেক দিন ধরেই খেলছেন এক সাথে। অনেক ঝড় ঝাপটা সয়েছেন, দেখেছেন মুদ্রার দুই পিঠ। তবে এই দলে নিজেরা এখনও আছেন নির্ভরতা হয়ে। একসঙ্গে জ্বলে ওঠার এই সুযোগ নিশ্চয় তারা হাতছাড়া করতে চাইবেন না। একটা জায়গায় অবশ্য দলের তরুণদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছেন তামিম, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে যে কখনো খেলা হয়নি এই তিনজনেরও।
এই দলের অনেকের জন্য অবশ্য ইংল্যান্ডেই খেলার অভিজ্ঞতা নতুন। মুস্তাফিজের তাও সাসেক্সের হয়ে গোটাকয়েক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে, সৌম্য-মোসাদ্দকের তাও নেই। ইংলিশ কন্ডিশনের রহস্য কি বাংলাদেশের তরুণেরা ভাঙতে পারবেন?
মাশরাফি জানেন, সেটা পারলে এই দলই পারবে। সেই বিশ্বকাপ থেকে শুরু, এরপর দুয়েক বার পিছলে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ একের পর এক সিঁড়ি ভেঙেছে তরতর করে। বিশ্বকাপের পর থেকে জয় -পরাজয় অনুপাতের হিসেবেও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে শুধু ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রস্তুতি ম্যাচে দুই পরাজয় সিঁদুরে মেঘ দেখাতে পারে। তবে অনেকেরই মনে থাকতে পারে, ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের কাছে দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচেই হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ায় বিরুদ্ধ কন্ডিশনে দলের ভরাডুবি দেখেছিলেন অনেকে। সেবার ইংল্যান্ডকে হারিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয়। সেই ইংল্যান্ডকে এবারও পাচ্ছে বাংলাদেশ, সেবারের গ্রুপের অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড প্রতিপক্ষ এই আসরেও। আরেকটি অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী হওয়ার ক্ষণ কি অপেক্ষা করছে এবারও?