• চ্যাম্পিয়নস ট্রফি
  • " />

     

    জীবন থেকে নেওয়া যে জুটি

    জীবন থেকে নেওয়া যে জুটি    

    কার্ডিফের পড়ন্ত দুপুরে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরতে থাকা মুশফিকুর রহিমের ছায়া দীর্ঘতর হতে পারে, সাকিব আল হাসান তখন ঠিক কী ভাবছিলেন? ওই মুহূর্তে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ এনে দিলে নিজের তিন ইচ্ছার জন্য পড়ে যাওয়া তিনটি উইকেট চাইতেন? নাকি সাকিব জানতেন, ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রদীপ লাগে না, সেটা তো আসলে মানুষের হাতেই। তবে ক্রিকেটে আরও বাড়তি কিছু লাগে। দরকার হয় একজন সঙ্গী, অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য একজন দোসরের।

    দোসর শব্দটা ঠিক যুৎসই হলো না। কখনো কুশীলব আর দোসরের ভূমিকা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দুজনের কাঁধই যখন চওড়া হয়ে যায়, তখন তো ভারটাও কমে যায় অনেক। তা সাকিব বা মাহমুদউল্লাহর সেই কাঁধ যে আগেও অনেক বার চওড়া হয়েছে, সেটা দুজন জানতেন ঠিক। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে মাহমুদউল্লাহর ওই ইনিংস তো সাকিব দেখেছিলেন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায়। আবার পরের বছর এশিয়া কাপে সাকিবের ওই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ইনিংসও মাহমুদউল্লাহর খুব কাছ থেকেই দেখা। সাকিব অবশ্য রং তুলি এঁকে ক্যানভাসটা প্রায় তৈরি করে দিয়েছিলেন, তুলির আঁচড়ে তাতে শেষ টান দিয়েছেন মাহমুদউল্লাহই।

    নাকি দুজন একে অন্যকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন সাত বছর আগের এক ম্যাচের কথা। সেবার প্রতিপক্ষ ভারত, এই মিরপুরেই। ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে কম্পমান বাংলাদেশ, মাহমুদউল্লাহর তখনও সাতের ওপরে ব্যাট করার ‘সৌভাগ্য’ হতো কালেভদ্রে। দুজনের ১০৬ রানের জুটি পথ দেখিয়েছিল বাংলাদেশকে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই ম্যাচটা মনে রাখার মতো হয়নি বাংলাদেশের।

    আচ্ছা, পরের বছরের কথা মনে করা যাক। এবার বুলাওয়েতে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। মাহমুদউল্লাহ তখনও ঘুরপাক খাচ্ছেন সেই সাতের চৌহদ্দিতেই, ১২৭ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর বেপথু বাংলাদেশের আবারও অন্ধের যষ্ঠি। এবার ১০৭ রানের জুটিটা আর অর্থহীন হয়ে যায়নি। তবে ৬০ রান আর ৩ উইকেট নেওয়ার পরেও কিছুটা আড়ালে চলে গিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ, অনেক বারই যেমন হয়েছে। ৮০ রান আর ২ উইকেট নিয়ে আরও একবার সাকিবের ওপরেই ছিল পাদপ্রদীপ।

    কিন্তু এদিন তো কাজটা ছিল আরও কঠিন। অনেকটা প্রায় ফুটো হয়ে যাওয়া অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে এভারেস্টে ওঠার মতো। বা বৃহস্পতিবারের ব্যস্ত বিকেলে আধ ঘন্টায় মতিঝিল থেকে উত্তরায় চলে যাওয়ার মতো। ৩৩ রানে নেই ৪ উইকেট, বোল্ট-সাউদিদের বল ফণা তুলছে থেকে থেকে, এক্সপ্রেস গতির মিলনের বল পড়া যেন ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র পড়ার মতোই কঠিন। ওই ভীষণ কঠিন সময়ে দুজন একে অন্যকে কী বলেছিলেন? বুলাওয়ে বা মিরপুরের সেই সময়ের কথা কি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন দুজন?

    কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁরা কেউ নাকি নাকি কথাই বলেননি! ম্যাচ শেষে নিরুত্তাপ মাহমুদউল্লাহ গড়গড় করে বলছিলেন, ‘আসলে আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথাই বলিনি। আমরা আসলে যখন একসঙ্গে ব্যাট করি, তখন একসঙ্গে খুব একটা কথাই বলি না। এটাই আমাদের ধরন। আমি শুধু ওকে বলেছিলাম, ব্যাট করে যাই।’ সাকিবের কন্ঠেও খানিক পর সেটিরই প্রতিধ্বনি, ‘আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে। ব্যাট করার সময় কথা না বললেও চলে।’ এ যে ‘অনেক কথা যাও যে বলি কোনো কথা না বলির মতো’। অথবা ‘যে আপনার নীরবতা পড়তে পারে, সে ভাষাও তো পড়তে পারে।’

    তা সেই ভাষাটা শুরু থেকেই দুজন পড়ছিলেন দারুণ। মুশফিকের আউটের ঠিক পরের ওভারেই সাউদির দ্বিতীয় বলে চার মারলেন সাকিব, ওভারের শেষ বলে মাহমুদউল্লাহও মারলেন নিজের প্রথম চার। ওই মুহূর্ত থেকে কি বুঝে গিয়েছিলেন, আজ কিছু একটা হতে চলেছে?

     

     

    নাকি সেটা বুঝেছিলেন আরও ছয় ওভার পর। তখনও দুজনের জুটিতে রান হয়েছে ৩৯, বাংলাদেশের জয়টা তখনও ‘কার্ডিফ (নাকি এজবাস্টন?) দূর অস্ত’। নিশামের দ্বিতীয় বলটা স্কয়্যার লেগের ওপর দিয়ে আছড়ে ফেললেন মাহমুদউল্লাহ। পরের বলটা আবার মাঠছাড়া করলেন ডিপ স্কয়্যার লেগ দিয়ে। ওই ওভারে এলো ১৩ রান, বাংলাদেশের আশার বাতিঘরে তখনই একটু একটু করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে দিশা পাওয়ার আলো?

    কার্ডিফ থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে ঢাকাও হয়তো তখন ভীষণ অসম্ভবে আস্থা রাখতে শুরু করেছিল। নিউজিল্যান্ড ২৬৭ রান তখনও অনেক দূরের পথ, দরকার আরও ১৮৪ রান। ব্যাটসম্যান তো বলতে শুধু মোসাদ্দেক, বাকিদের নিয়ে তো তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেওয়া মুশকিল। কিন্তু এই দুজন কতদূরই বা যাবেন? বড়জোর ১৫০। বা তার আরেকটু বেশি?

    সাকিব-মাহমুদউল্লাহ তখনও কথা বলেননি। ইথারে ভেসে আসা ব্যাটের ভাষাটা অবশ্য পড়তে পারছিলেন দারুণ, এক রান–দুই রান এসে যাচ্ছিল অনায়াসে। সেঞ্চুরি জুটিটা কখন হয়ে গেল, টেরই যেন পাওয়া গেল না। ড্রেসিংরুমে তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে থাকা সৌম্যের স্মিত হাসির আড়ালে তখন রাজ্যের উদ্বেগ, টুপি পরা মুশফিকের চাপা উত্তেজনা তখন ছড়াতে শুরু করেছে পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের বদ্বীপেও। সাকিব-মাহমুদউল্লাহ তখনও কথা বলেননি। সেটার দরকারও ছিল না হয়তো।

    এর মধ্যে দুজনের ফিফটিও হয়ে গেছে। সাকিবও ছুঁলেন, আর খানিক পরেই মাহমুদউল্লাহ।  রান রেটের উর্ধ্বমুখী গ্রাফ নামতে শুরু করেছে নিচে, কিন্তু চড়চড় করে বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। সাকিব-মাহমুদউল্লাহ তখনও নির্ভার। এর মধ্যেই সাকিব প্রায় এক বার অ্যান্ডারসনের বলে ক্যাচ তুলেই দিয়েছিলেন, ষোল কোটি লোকের হার্টবিটও যেন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সাকিব বেঁচে গেলেন একটুর জন্য, বাংলাদেশের হৃদপন্দন আরও দ্রুততর হলো।

    ওদিকে চূড়ার সঙ্গে ব্যবধান কমতে শুরু করেছে একটু একটু করে, দুজনের এগিয়ে যাচ্ছেন কাঁধে কাঁধ লাগিয়েই। দেখতে দেখতে সাকিবের সত্তর, আশি হয়ে গেল, মাহমুদউল্লাহও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ধরে ফেললেন। লক্ষ্যটা তার অনেক আগেই নেমে গেছে ১০০ রানের নিচে। বাংলাদেশ তখন থম মেরে আছে প্রপঞ্চময় এক নীরবতায়, যে যেখানে আছেন সবাই যেন স্থির। একটু নড়লেই যেন হয়ে যাবে অঘটন। তবে দুজন তখন যুধিষ্ঠিরের মতোই লক্ষ্যে অটল। দেখতে দেখতে হয়ে গেল নব্বইও। কার্ডিফের স্নায়ুচাপ তখন ছড়িয়ে গেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়, কিন্তু দুজনের মধ্যে নেই তার ছিটেফোঁটাও। বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের জুটিটা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। মাশরাফি পরে বলছিলেন, ‘ওদের ওপর আমার আস্থা ছিল, তবে ২০০ করে ফেলবে সেটা ভাবিনি।’ কিন্তু এদিন যে যা ভাবনার অতীত, তা ভাবার। যা হওয়ার নয়, তা করে দেখানোর।

    নব্বইয়ে অবশ্য মাহমুদউল্লাহ আগেই ঢুকে পড়েছিলেন, তিন অঙ্কও আগে ছুঁয়ে ফেলবেন বলে মনে হচ্ছিল। তবে সাকিব পিছিয়ে এসে আবার ধরে ফেলেছেন, এক সঙ্গে হয়ে গেছে ৯৮। এর পরেই এলো সেই মুহূর্ত, মিলনেকে হুক করে সাকিব আছড়ে ফেললেন মাঠের বাইরে। বাংলাদেশ তখন পেয়ে গেছে জয়ের গন্ধ, মাহমুদউল্লাহ তখন এসে জড়িয়ে ধরলেন সতীর্থকে। দুজনের মধ্যে কি তখনও কথা হয়নি? ম্যাচটা দুজন মিলে শেষ করে আসবেন, সেটাই কি বলছিলেন?

    সাকিব বোল্টের পরের দুই বলে পর পর দুই চারে মনে করাচ্ছিলেন সেরকমই। তামিম তাঁকে আগে বলেছিলেন, ‘তোর তো একটা ম্যাচ শেষ করে আসা দরকার’- কথাটা হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। কিন্তু বোল্টের পরের বলেই বোল্ড, সাকিব আর তুলিতে শেষ টান দিতে পারলেন না। বোল্ট তখন হাততালি দিয়ে পুরো বিশ্বের হয়ে কুর্নিশ জানালেন তাঁকে।

    তবে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি বাকি ছিল তখনও। পরের ওভারেই চার মেরে সেটি হলো। ব্যাটের দিকে অটোগ্রাফ দেওয়ার ইঙ্গিত করে উদযাপন করলেন, পরে জানা গেল শিশুপুত্রের জন্যই তাঁর এই সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের জয়টাও এসে গেছে একটু পরেই, কার্ডিফের বারান্দায় মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়তে থাকা মাশরাফির জাদুবাস্তব ছবিটা আঁকা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। একটু পরেই সাকিব-মাহমুদউল্লাহর আবার দেখা হলো, এবার কী বললেন দুজন?

    সেই গল্পটা না হয় না অন্য কোনো দিনের জন্য তোলা থাক। হয়তো মিরপুর, চট্টগ্রাম, বা কে জানে, আরেকটা কার্ডিফের জন্য!