• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    ভেট্টরিদের বিদায় বলতে নেই!

    ভেট্টরিদের বিদায় বলতে নেই!    

    ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠের টেস্ট সিরিজে ডাক পেলেন, তাঁর বয়স তখন সবে আঠারো পেরিয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উচ্চ শিক্ষার। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তিও হয়ে গিয়েছিলেন। হতে পারতো ঠিক এই মুহূর্তে ওই মধ্যবয়স্ক ফার্মাসিস্ট কাউন্টারে পিছনে বসে রোগীর পথ্য লিখছেন। মাঝেমধ্যে সামনের টিভি পর্দায় দেখছেন ফাইনাল খেলে দেশা ফেরা নিউজিল্যান্ড দলকে জনতার বরণ করে নেয়ার দৃশ্য।

     

     

    না তাঁর গল্পটা এভাবে এগোয় নি। টিভি পর্দায় যে দৃশ্যের তিনি কেবল একজন দর্শক হতে পারতেন, তিনি আজ ওই দৃশ্যের নায়কদেরই একজন। ১৮ বছরের বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন বলে গণমাধ্যমকর্মীদের আগ্রহটাও যেন তাঁকে ঘিরেই একটু বেশী! তাঁর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা বারবারই ছুটে যাচ্ছিল, ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা কি সত্যিই খেলে ফেলেছেন?

     

     

    মৃদুভাষী, লাজুক ডেনিয়েল ভেট্টরির তরফে জবাবটা এলো একটু হেঁয়ালি করেই, “আমার তো তাই মনে হয়!”

     

    অনেকদিনধরেই বিভিন্নভাবে এড়িয়ে যাওয়া প্রশ্নের জবাবটা অবশ্য এবার পরিষ্কার করে দিতে কোন দ্বিধা করলেন না, “ফাইনালটাই নিউজিল্যান্ডের হয়ে আমার শেষ ম্যাচ ছিল। এবং শেষটা আক্ষরিক অর্থেই খুব দারুণ হল।”

     

    একই দিনে ক্রিকেটকে বিদায় জানানো অজি অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের ছায়ায় ভেট্টরির বিদায়লগ্ন যেন খানিক ঢাকাই পড়ে গিয়েছিল।  কিন্তু চাইলেই কি আর তা ঢেকে রাখা যায়? কিছু মানুষের হয়ে তাঁদের অনবদ্য কীর্তিই যে কথা বলে!

     

     

    ‘৯৭ সালের ওইদিন নিউজিল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট খেলোয়াড় হিসেবেই অভিষেক হয়েছিল তাঁর। সে রেকর্ডটা আজও রয়ে গেছে ভেট্টরির দখলে। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় কিউইদের হয়ে সবচেয়ে বেশী টেস্ট (১১৩) ও ওয়ানডে (২৯৫) খেলা ক্রিকেটারও এখনও পর্যন্ত তিনিই।  চলতি বিশ্বকাপেই পেরিয়েছেন একদিনের ক্রিকেটে তিনশ’ উইকেটের মাইলফলক। নিউজিল্যান্ডের হয়ে এই কীর্তিটিও তাঁরই প্রথম, গোটা ক্রিকেট দুনিয়াতেই যেটা এগারোতম কৃতিত্ব। আর টেস্ট-ওয়ানডে উভয় সংস্করণে এ রেকর্ড আছে ভেট্টরি ছাড়া আরও আটজনের। টেস্ট ক্রিকেটে চার হাজার রান আর তিনশ’ উইকেটের আরেকটি বিরল কীর্তি ভেট্টরির আগে কেবল দু’জন গড়েছিলেন, কপিল দেব আর ইয়ান বোথাম। এসবই তিনি গড়েছেন প্রথম নিউজিল্যান্ডার হিসেবে।

     

    ক্রিকেটের সব সংস্করণ মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার রান আর সাত শতাধিক উইকেটের মালিক কি কেবলই পারফরম্যান্সের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন? ক্রিকেটটা যে ভদ্রলোকের খেলা সেটা যারা নিয়মিতই স্মরণ করিয়ে দেন ভেট্টরি তো তাঁদেরও একজন! ২০০৯-১০ মৌসুমে তাঁর নেতৃত্বাধীন নিউজিল্যান্ড দল জিতে নেয় আইসিসির ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ সম্মাননা। ওটা আবার ভেট্টরি এককভাবে পেয়েছিলেন ২০১২ সালে। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের সাথে ধাক্কা লাগার কারণে সুযোগ পেয়েও তাঁকে রান আউট না করার নজির যে খুব বেশী নেই!

     

     

    আপাদমস্তক ভদ্রলোকটি যখন বয়সের কাছে হার মেনে ২০১২ সাল থেকে লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেলেন, তখন অনেকেই ভেবেছিল তিনি বোধহয় আর ফিরবেন না। কিন্তু ভেট্টরি তো ফুরিয়ে যান নি! শত বর্ষে যার মতো দুয়েকজন বিরল প্রতিভা মেলে, তাঁর তো অতো সহজে ফুরিয়ে গেলে চলে না!


     

    ভেট্টরি আবার ফিরলেন মাঠে। গত বছরের শেষ নাগাদ পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর শেষ টেস্টটিতে নিউজিল্যান্ড মাঠ ছাড়ে ইনিংস ব্যবধানের জয় নিয়ে। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপজুড়েও তিনি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর অভাবটা খুব করেই অনুভব করবে ক্রিকেট। পেসারদের দাপটের আসরে ২০.৪৬ গড়ে ১৫ উইকেট নিয়ে তিনি টুর্নামেন্টের অষ্টম সেরা বোলার, আর শীর্ষ স্পিনার তো বটেই। রানবন্যার বিশ্বকাপে ভেট্টরি খরচেও ছিলেন বেশ হিসেবি,ওভার প্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ৪.০৪ হারে। এক ইনিংসে ১৮ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট নিয়ে আছেন সেরা বোলিং ফিগারের তালিকারও ৯ নম্বরে।

     

     

    কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে সীমানা দড়ির উপর থেকে যেভাবে লাফিয়ে উঠে এক হাতে স্যামুয়েলসকে তালুবন্দী করলেন, কে বলবে তাঁর বয়স ছত্রিশ পেরিয়ে গেছে? কে-ই বা মানতে চাইবে এই মানুষটিকে আর দেখা যাবে না বাইশ গজের লড়াইয়ে!

     

     

    কিন্তু কিছু ব্যাপার যে না চাইলেও মানতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়! নিউজিল্যান্ড দলও হয়তো মানিয়ে নেবে তাঁকে ছাড়া। কিন্তু সেটা যে খুব সহজ হবে না তা মানছেন খোদ কিউই কাপ্তান ব্র্যান্ডন ম্যাককালামও, “আমাদের সর্বকালের সেরাদের একজনকেই হারাতে যাচ্ছি। আর ড্রেসিংরুমে তাঁর মতো একজনের শূন্যস্থান পূরণ করাটা কঠিনই হবে।”

     

     

    প্রিয় সতীর্থকে বেশ আড়ম্বরের সাথেই বিদায় দেবেন জানিয়ে ম্যাককালাম বললেন, “অমন একজনের সাথে খেলতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার!”

     

    ভাগ্যের ব্যাপার তো গোটা ক্রিকেট দুনিয়ার জন্যই। বাউন্স-স্পিনের বৈচিত্র্য, ড্রিফট-ড্রপের মুন্সিয়ানা...ক্রিকেটীয় দক্ষতার বাইরে একজন ডেনিয়েল ভেট্টরি ক্রিকেট ইতিহাসে পূজনীয় হয়ে থাকবেন অনন্য সাধারণ মানুষ হিসেবেও।