মাঠের বাইরের 'অচেনা' সাকিব
‘আরও তিনটি প্রশ্ন! ওখানের জন্য তো কিছু রাখেন’
গত বৃহস্পতিবার হাসতে হাসতে যখন সাকিব আল হাসান কথাটা বললেন, সংবাদ সম্মেলনেও সংক্রমিত হলো সেটি। পুরোটা সময় সম্মেলনে ছিলেন দারুণ চনমনে, প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছিলেন তাঁর নির্ভুল টাইমিংয়ের স্কয়্যার কাটের মতো। নিজেদের স্পিন আক্রমণ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ভালো মনে করেন, অস্ট্রেলিয়াকে দুই টেস্টেই হারাতে চান- এমন কিছু স্ট্রেট ড্রাইভও খেলে ফেলেছেন তখন। তবে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছয়ের ইঙ্গিতটা যে দিয়েছেন, সেটা তখনও জানা ছিল না। সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে আসার সময়ই আরেকবার হাসিমুখে বললেন, ‘আপনারা সবাই চলে আসবেন। কাছেই কিন্তু!’
মোগলের সাথে পড়লে খানা খেতে হয়, আর এ তো সাকিব আল হাসান! সাকিবের নতুন কনভেনশন সেন্টারের দূরত্ব মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে ঢিল ছোঁড়া না হলেও খুব বেশি নয়। মিরপুরের লোক চাইলে এখন থেকে এখানেই গাঁটছড়া বাঁধার কাজটা সেরে নিতে পারবেন। আর অতদূর এগুতে না চাইলে নিচের রেস্টুরেন্ট সাকিবস সেভেন্টিফাইভ থেকে উদরপূর্তি করে আসার সুযোগ তো আছেই। কনভেনশন সেন্টারের সঙ্গে তাঁর আরেকটি উদ্যোগ ‘অলরাউন্ডার ক্যাটারিংয়ের’ উদ্বোধনই ছিল কাল, অনুশীলনের পর যাতে এসেছিলেন বাংলাদেশ দলের আরও অনেকে। তামিম ইকবাল রসিকতা করে মনে করিয়ে দিলেন, সেলুন থেকে রেস্টুরেন্টসহ অনেক ব্যবসায় বাংলাদেশ দলের অনেকেই এখন হাত পাকিয়ে ফেলেছে। বিয়ে আয়োজন করাটাই কেবল বাকি ছিল- বলতেই সেখানে আরেক দফা হাসির রোল।
সাকিব অবশ্য একনিষ্ঠ গৃহস্বামী হয়ে তখন সবকিছুর ওপর শ্যেন দৃষ্টি রাখছেন। একটু হাঁপ ছাড়ার ফুরসত পেলেন খাওয়ার টেবিলে, ডাউন দ্য উইকেটে ছয় বা আর্মারটা তখন আসি আসি করছে। ঠিক ফুরসত বলা অবশ্য ভুল হলো, মিরপুর সড়কে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা অগুণিত গাড়ির মিছিলের মতো একের পর এক সেলফিশিকারীদের ক্রমাগত অত্যাচার কিন্তু চলছেই। তবে সেসব গায়ে না মেখেই খাওয়ার টেবিলে বসে সাকিব খুলে দিলেন স্মৃতির হৃদয়দুয়ার। অতিথিদের কেউ কেউ ততক্ষণে বিদায় নিয়েছেন, সাকিব তাই অনেকটাই নির্ভার গৃহস্বামী।
খেতে খেতেই সাকিব যেন ফিরে গেলেন স্মৃতির বিকেএসপিতে। সেই বিকেএসপি, সাকিবের সাকিব হয়ে ওঠা যখন শুরু। ব্যাটিং, বোলিং দুটোই পারতেন, নামডাকও হয়ে গিয়েছিল বেশ। কিন্তু একহারা ছেলেটাকে সবাই কিন্তু সেভাবে চিনতো না। সাকিবের ভাষায়, ‘সিনিয়রদের সাথে আমার খুব একটা কথা টথা হতো না। নিজের মতোই থাকতাম বেশি।’
ক্রিকেটার সাকিবের কথা তো সবাই জানে, ছাত্র সাকিবের কথা খুব বেশি কেউ জানেন না। এবার সাকিবের ডাউন দ্য উইকেট, পড়াশোনা বেশি না করলেও ছাত্র হিসেবে নাকি বেশ ভালো ছিলেন। শুনুন তাঁর মুখেই, ‘আমি কিন্তু খুব বেশি পড়াশোনা করতাম না। ইন্টারমিডিয়েটের মাত্র মাসখানেক আগে বই কিনেছিলাম। আমার রুমমেট ছিল রুহুল আমিন নামের একজন, ও আবার বেশ পড়ুয়া ছিল। সারা বছরেই বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে রাখত। শেষ পর্যন্ত যখন রেজাল্ট দিল্ তখন দেখা গেল মানবিকে আমি পেয়েছি ৩.৯। ও –ও পেয়েছে ৩.৯। আমাকে অবাক হয়ে বলল, ‘দোস্ত, দুই সারা বছর খেলাধূলা করলি, মজা করলি, দুষ্টুমি করলি, আবার ৩.৯ও পেয়ে গেলি। আর আমি পড়াশোনা করেও এটাই পেলাম। আমি তাহলে কী করলাম’’ বলতে বলতেই সাকিবের মুখে একগাল হাসি। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, ্জিপিএ ফাইভের ওই যুগে এই ফল মোটেই ফেলনা নয়।
কিন্তু এক মাস আগে পড়েই এতো ভালো করার রহস্য কী? সাকিব এবার গোমরটা ফাঁস করলেন, ‘আমার একটা ব্যাপার ছিল সাজেশন থেকে খুব ভালো কমন পড়ত। দেখা যেত আটটা পড়েছি, ছয়টাই সেখান থেকে এসেছে। এমনও হয়েছে, ছয়টা প্রশ্ন পড়েছি ছয়টাই এসেছে। আমি আগে যা করতাম আগের চার পাঁচ বছরের প্রশ্ন নিয়ে সেটা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতাম। তার পর নিজের মতো করে একটা সাজেশন বানাতাম। দেখা যেত ওখান থেকেই কমন পড়ে গেছে।’
এই সাজেশন নিয়েই আরেকটা মজার গল্প শোনালেন, ‘একবার একটা পরীক্ষার খাতা পেয়েই আমি আরেকটা পরীক্ষার উত্তর লিখতে শুরু করে দিলাম। পাশেই এক ম্যাডাম দাঁড়ানো ছিলেন, তিনি বললেন, ‘তুমি এখনই এটা লিখছ কেন?’ আমি বললাম, ‘কালকের পরীক্ষায় এই প্রশ্ন আসবেই, সেটা তাই লিখে একটু হাতের লেখা প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি।’ উনি বললেন, ‘তুমি এতো নিশ্চিত হলে কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘ম্যাডাম, আমি জানি এই প্রশ্ন আসবেই।’
‘পরের দিন সেই পরীক্ষার সময় খাতা পেয়েই আমি আগের উত্তরটা লিখতে শুরু করে দিলাম। ওই ম্যাডাম ওই দিন ছিলেন অন্য রুমের গার্ডে, কিন্তু প্রশ্ন দেওয়ার পর আমার রুমে চলে এলেন। প্রশ্নটা খুলে দেখি, আমি যে উত্তরটা লেখা শুরু করেছিলাম, এক নম্বরেই আছে ওই প্রশ্ন।’ সাকিবের কথায় বোঝা গেল, ক্রিকেটার হিসেবে যেমন, ছাত্র হিসেবেও ছিলেন ততটা কার্যকর। নিজের সামর্থ্যের চেয়ে ফলে তাই থাকত একটু বেশিই প্রতিফলন। তার চেয়েও বড় ব্যাপার সম্ভবত নিজের ওপর অটুট আত্মবিশ্বাস। খাতা পাওয়ার আগেই যেমন প্রশ্ন লিখতে পারতেন, মাঠে নামার সময়েই তাই জানেন দিনটা তাঁর হবে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই মুহূর্তে অমন ইনিংস খেলার মনের জোরটা যে জন্মগত, সেটা তো বলে না দিলেও চলে!
কথায় কথায় এলো আরও অনেক কিছু। এমনিতে খুব কথা না বললেও দুষ্টুমিতে কম যেতেন না, সেজন্য শাস্তিও পেতে হয়েছে। আবার অন্য একজনের অপরাধে তাঁকেও শাস্তি পেতে হয়েছে এমনও হয়েছে। এর মধ্যে পারিবারিক ব্যাপারও চলে এলো। কদিন আগেই গৃহকর্মীর সঙ্গে একটা ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোড়নের প্রসঙ্গও উঠল। হাসতে হাসতেই সাকিব বললেন, ‘ভাগ্যিস ছবিটা ছিল। নইলে তো... !’ প্লেটের ওপর মুখরোচক বিরিয়ানির খুব কম অংশই তখন খাওয়া হয়েছে। এক ফাঁকে এসে ইমরুল কায়েস বিরিয়ানি খাওয়া নিয়ে টিপ্পনীও কেটে গেলেন। সাকিব আবার পাল্টা রসিকতা করতে ছাড়লেন না, ‘এই বিরিয়ানিটা আমার পুরস্কার’।
ব্যবসা প্রসঙ্গে নিজের ভাবনার কথাও এলো। সাকিবস ডাইন নামের একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন, সেটার মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন। কনভেনশন সেন্টার তাঁর নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগেরই ফল। আভাস দিলেন, ক্রিকেট নিয়েও খুব শিগগির কিছু একটা করতে চান।
সেই ‘কিছু একটা’ সাকিবের মতোই কার্যকরী হবে, সেটা নিয়ে আগাম বাজি ধরে ফেলাই যায়!