• " />

     

    ক্রিকেট ছড়িয়ে যাক দেশজুড়ে

    ক্রিকেট ছড়িয়ে যাক দেশজুড়ে    

    অস্ট্রেলিয়াতে মোট ছয়টি স্টেট আছে।  নিউ সাউথ ওয়েলস, কুইন্সল্যান্ড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া, ভিক্টোরিয়া, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। এদের রাজধানী যথাক্রমে সিডনি, ব্রিসবেন, অ্যাডিলেড, হোবার্ট, মেলবোর্ন, পার্থ। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপের ফিক্সচার যখন করা হয় তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলিয়া গিলার্ড। জনগণের প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে তিনি নিজে থেকে ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিসিকে অনুরোধ করেন প্রত্যেকটা স্টেটে অন্তত অস্ট্রেলিয়া একটি করে ম্যাচ খেলতে পারে। তাহলে প্রত্যেক স্টেটের মানুষেরা অন্তত অস্ট্রেলিয়ার একটা করে ম্যাচ দেখতে পারবে। সমস্যা হলো যখন দেখা গেলো অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড এক গ্রুপে পড়লো। অসিদের গ্রুপ পর্বের ম্যাচটা নিউজিল্যান্ডে গিয়ে খেলতে হলো। তাতে গ্রুপ পর্বের ৫টা ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া তাদের মাটিতে খেললো। সেই ৫টা ম্যাচ কিন্তু ৫টা ভিন্ন স্টেটের রাজধানীতে হয়েছে। যথাক্রমে মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, পার্থ, সিডনি, হোবার্টে। দেখা গেলো অ্যাডিলেড অসিদের কোন ম্যাচ পাচ্ছে না। তখনই কোয়ার্টারের হোস্ট ভেন্যু হিসেবে অ্যাডিলেডকে নির্বাচন করা হয়। আপনাদের মনে পড়ে বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচে ভেন্যু পাল্টানো হয়েছে; এমন নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছিলো? আগে থেকে অসিদের হোস্ট ভেন্যু হিসেবে অ্যাডিলেড নির্বাচনের কারণ হিসেবে "অস্ট্রেলিয়াকে ছয় স্টেটের ছয় রাজধানীতে খেলতে দেয়া হবে" এমন চিন্তাটাই প্রধান ছিল।

     

    এবারে নিউজিল্যান্ডে আসি। ছোট দেশ। কিন্তু নিউজিল্যান্ডও কিন্তু তাদের গ্রুপ পর্বের ছয় ম্যাচ অসিদের মতো একইভাবে ক্রাইস্টচার্চ, ডানেডিন, ওয়েলিংটন, অকল্যান্ড, ন্যাপিয়ার, হ্যামিল্টন; অর্থাৎ ছয়টা ভিন্ন প্রভিন্সে খেলেছিলো।

     

     অর্থনৈতিক অথবা ইনফ্র্যাস্ট্রাকচারগত দিক থেকে বাংলাদেশ কোনভাবেই অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের সমপর্যায়ের না। ভবিষ্যতে কখনো  হয়তো সেই উচ্চতায় যেতে পারে। সুতরাং ওদের সাথে তুলনা দেয়া বোকামি হবে। কিন্তু নিজেদের থেকে চেষ্টাটা জরুরি।

     

    বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোন দলকে বাংলাওয়াশ করে কেনিয়া দলকে দেশের মাটিতে ২০০৬ সালে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেই সিরিজের একটা ম্যাচও মিরপুর অথবা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়নি। ৪-০ তে জেতা সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচ হয়েছিলো বগুড়াতে, দ্বিতীয় ম্যাচ খুলনায়, এবং শেষ দুই ম্যাচ ফতুল্লাতে।

     

    বাংলাদেশ ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজনে ছিল, ছিল ২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের একক আয়োজক। অথচ এই বিশ্বকাপগুলোর সবগুলো ম্যাচই মিরপুর স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয়েছে। এমন না যে, দেশে ভালো স্টেডিয়াম নেই। ভালো স্টেডিয়াম আছে, এবং স্টেডিয়ামের সাথে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সবই আছে। প্রমাণ হচ্ছে, ২০১৪ এর টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মহিলাদের সব খেলা সিলেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কিন্তু আন্তর্জাতিক সব দলের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা সবই ছিলো। সুতরাং পুরুষদের কয়েকটা খেলা সেখানে হলে এমন কোন ক্ষতি ছিল না। তারপরেও কী কারণে সেটা করা হয়নি কে জানে।

     

    বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে প্রথম হারায় ২০০৬ সালে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে। এই স্টেডিয়াম সম্পর্কে হাবিবুল বাশার, রাজিন সালেহদের উচ্ছ্বাসের কথা বেশ মনে আছে। এটা প্রায় বিশ্বমানের এক স্টেডিয়াম ছিল।  কক্সবাজারে এখন বিশ্বমানের স্টেডিয়াম প্রায় তৈরি, সিলেটেও অচিরেই আন্তর্জাতিক খেলা হবে আশা করি। পরবর্তীতে সরকার বদল হলে এই স্টেডিয়ামগুলো আবার ব্রাত্য না হয়ে পড়লেই হয়।  অবশ্য গত এশিয়া কাপের প্রথম ৫টা ম্যাচ ফতুল্লাতে হয়েছিলো। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের কয়েকটা ম্যাচ তো অন্তত ফতুল্লাতে দেয়া যেতো। সেটা তো খুব একটা দূরত্বে না। এই ইস্যু হঠাৎ করে ওঠানোর কারণ হচ্ছে এবারের পাকিস্তানের সাথে সিরিজ।

     

    তিন ওয়ানডে, দুই টেস্ট, এক টি-টুয়েন্টি মিলে মোট ৬টি ম্যাচ হচ্ছে যার ৫টাই মিরপুরে! খুব বড় দেশ তো না আমাদের। প্লেনে এমনকি ট্রেনে ভ্রমণ করতেও এক রাত লাগে না। সেখানে খেলাটাকে তিন-চারটা ভেন্যুতে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতে সমস্যা কী? এদিক দিয়ে বাফুফে বেশ চেষ্টা করছে। তারা ফুটবলকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে। অক্টোবর থেকে জানুয়ারির মধ্যে তিনটা আন্তর্জাতিক খেলা রাজশাহী, যশোর আর সিলেটে অনুষ্ঠিত হয়। খেলাটাকে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে যত ছড়িয়ে দেয়া যাবে তত এর সাথে দর্শকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে। কিশোর-তরুণদের আগ্রহও বাড়বে। এটা অবশ্যই সত্যি যে, বাফুফে যে খেলাগুলো যশোর, সিলেটে আয়োজন করেছিলো সেখানে দর্শকেরা প্রায় মাঠে ঢুকে যাচ্ছিলো, নিরাপত্তার অভাব ছিল এমন বেশকিছু অভিযোগ উঠেছিলো। কিন্তু এগুলোর ব্যাপারে আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়াটা তো আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনে অভিজ্ঞ বিসিবির কাছে তেমন কঠিন হবার কথা না।

     

    মাঠের বাইরেও টিম হোটেল ফ্যাসিলিটি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রশ্ন এসে যায়। বগুড়ায় মূলত স্টেডিয়ামের কারণেই একটা আন্তর্জাতিক মানের ফাইভ স্টার হোটেল গড়ে তোলা হয়েছিলো। সেটা কার্যকরিতা এখন কি কে জানে। খুলনায় এবারে একটা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে। সুতরাং সেখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। চট্টগ্রাম, সিলেট নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তাহলে খেলাটিকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে না কেন? যেসব জায়গায় অবকাঠামোগত সুবিধা আছে সেসব জায়গায় উন্নতি করার জন্য বিসিবির আলাদা বাজেট রাখতে হবে। বিসিবির সেই টাকা কিন্তু আছে। তাহলে আন্তর্জাতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র ঢাকার কংক্রিট আর জ্যাম না দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সকল সৌন্দর্য দেখানোরও সুযোগ করে দেয়া যাবে। পর্যটনের জন্যেও ব্যাপারটা বেশ কার্যকরী হবে। সামনে অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে। এই টুর্নামেন্টটা কি শুধুমাত্র মিরপুর ভিত্তিক না করে দেশের বিভিন্ন বিভাগে ছড়িয়ে দেয়া যায় না? তাহলে আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্ট যারা আসবে তাদের দেশের সৌন্দর্য দেখিয়ে মুগ্ধ করা যেতো।

     

    মাঠ আসলেই পিচের প্রসঙ্গ আসে। জাতীয় লীগে রান বন্যা বয়ে গেছে এবার প্রায় অনেক ম্যাচে। কিন্তু মরা পিচে রান বন্যার চেয়ে স্পোর্টিং পিচে খেলাটা খুব বেশি জরুরি। আমরা কি ভারতকেই অনুসরণ করছি না? মরা পিচে ভালো খেলে ভারতের বিদেশে ভরাডুবিতো আজীবনই বিখ্যাত। ওদের রবীন্দ্র জাদেজার রঞ্জি ট্রফিতে তিনবার ট্রিপল সেঞ্চুরি তো এখন ক্রিকেটীয় হাস্যরসের একটি। পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করতে হয়। ২০১৯ বিশ্বকাপ আমাদের জন্য ষষ্ঠ বিশ্বকাপ হবে। সেই বিশ্বকাপে আমাদের উচিত হবে কাপ জয়ের টার্গেট করা। ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার ২০ বছর পরেও যদি আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার বাসনা না নিয়ে বিশ্বকাপে যাই তাহলে সেটা খুবই পিছিয়ে পড়া মানসিকতা হবে। এজন্যে প্রয়োজন সঠিক প্রস্তুতি!

     

    র‍্যাংকিং এ আটের মধ্যে থাকার জন্য বিসিবির যে বেশি বেশি ম্যাচ খেলার পরিকল্পনা সেটা খুবই প্রশংসনীয়। একইসাথে ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে যেন ভালো খেলা যায় সেজন্যে লীগে মরা পিচ বানানো বন্ধ করতে হবে। এটা অবশ্যই সত্যি যে ইংল্যান্ডের সুইং পিচের মূল কারণ তাদের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। অস্ট্রেলিয়ায় যেমন ঘাস কেটে ফেলেই ব্যাটিং পিচ বানানো গেছে, ইংল্যান্ডের কন্ডিশনের কারণেই সেটা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে সেই আবহাওয়া আনা যাবে না। তবু শীতকালে ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি, পারলে ২০১৭-১৮ থেকেই আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের সাথে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলা বা বিভিন্ন একাডেমি দল পাঠানো ইত্যাদি নিয়ে চার বছরের দীর্ঘ পরিকল্পনা এখন থেকেই করা যায়।

     

    বড় দলগুলোর সিনিয়র খেলোয়াড়েরা ওয়ানডে দল থেকে অনেক আগে থেকে অবসর নেন/ বাদ দেয়া হয় যেন নির্বাচকেরা দীর্ঘ সময় নিয়ে বিশ্বকাপকে লক্ষ্য রেখে দল সাজাতে পারে। এই কাজগুলো বাংলাদেশকে এখন থেকেই করতে হবে। দল নিয়ে খুব একটা এক্সপেরিমেন্ট দরকার নেই, তবে খেলোয়ারদের কঠিন কন্ডিশনে নিয়মিত খেলানোর অনুশীলন করালে সেটা অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে। লক্ষ্যের মধ্যে ৩০-৪০ জন খেলোয়ার রাখা জরুরি যাদের এখন থেকেই প্রস্তুত করতে হবে একাডেমি দল, ‘এ’ দলে খেলিয়ে।

     

    আমরা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো পারব না। তারপরেও দেশের প্রতিটি বিভাগের মানুষ অন্তত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খেলা নিয়মিত দেখবার সুযোগ পাবে এটাই আশা। আর বিশ্বমঞ্চে সব দলকে মোকাবেলা করার জন্য পিচগুলোকে স্পোর্টিং করা হোক।