• অ্যাশেজ
  • " />

     

    ‘এপিক’ এজবাস্টন

    ‘এপিক’ এজবাস্টন    

    লর্ডসে ভাল একটা শুরুর পরও প্রায় উড়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। ২০০৫ সালের অ্যাশেজে। প্রথম দিনের মর্নিং সেশনের ‘আক্রমণাত্মক’ মানসিকতা উড়ে গিয়েছিল গ্লেন ম্যাকগ্রা আর শেন ওয়ার্নের তোপে। এলোমেলো ইংল্যান্ড, ধরাশায়ী ইংল্যান্ডকে দিয়ে ‘নতুন কিছু’র আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন সবাই। সমালোচকরা বলেছিলেন, এ ইংল্যান্ড দলের ‘সামর্থ্য’ নেই, ‘মানসিকতা’ নেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর।

     

    এসব ক্রিকেট ‘পন্ডিতের’ একজনও বোধহয় লিখতে পারতেন না, ১১ দিন পরে বার্মিংহামে শুরু হতে যাওয়া ‘এপিক’ এজবাস্টনের চিত্রনাট্য!

     

    ১. একটি ক্রিকেট বল

     

    আগস্ট ৪, ২০০৫। এজবাস্টন, বার্মিংহাম। অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর বাকি মিনিট ৭৫। অস্ট্রেলিয়ানরা রাগবি খেলে গা গরম করছিলেন। পড়ে থাকা নিরীহ একটা ক্রিকেট বলের ওপর পা পড়লো গ্লেন ম্যাকগ্রার। ম্যাকগ্রা ছিটকে গেলেন এজবাস্টন থেকে। লর্ডসে আগের টেস্টের মর্নিং সেশন ইংল্যান্ডকে নতুন কিছুর আশা জুগিয়েছিল, এই ভদ্রলোকই সে আশায় গুঁড়েবালি দিয়েছিলেন। ম্যাকগ্রা ছিটকে গেলে ইংল্যান্ড তো বাড়তি একটু ‘আশা’ পাবেই।

     

     

    বল ছিটকে গেল, ছিটকে গেলেন ম্যাকগ্রাও দল থেকে

     

    ২. বার্মিংহামের আকাশ আর রিকির ‘স্টুপিড’ সিদ্ধান্ত

     

    একটু মেঘাচ্ছন্ন কন্ডিশনে রিকি পন্টিং টসে জিতে ফিল্ডিং নিলেন। মার্ক নিকোলাসকে যখন রিকি এ কথা বলছেন, পাশে দাঁড়িয়ে মাইকেল ভনও যেন তখন হতবাক। একটু হাসিও খেলে গেল মুখে! হতবাক প্রায় পুরো মাঠই। এজবাস্টনের উইকেট যে চরম ব্যাটিং সহায়ক তখন! পরে এ নিয়ে জিওফ বয়কট বলেছিলেন, ‘সে অসাধারণ একজন, এই রিকি পন্টিং। সে ইংলিশদের এতটাই ভালবাসে যে, নিজের জীবনের সবচেয়ে “স্টুপিড’’ সিদ্ধান্ত দিয়ে সে সিরিজটাই বদলে দিয়েছিল!’

     

    পন্টিংকে একটু পরেই একরাশ হতাশা উপহার দিল বার্মিংহামের আকাশ। রোদ ঝলমল করে উঠলো। ১১২ রানের উদ্বোধনী জুটি পন্টিংয়ের সিদ্ধান্তকে উপহাসই করেছিল শুধু। দলীয় ১৬৪ রানে ৯০ করে ফিরলেন ট্রেসকোথিক। তারপর হঠাৎ করেই ২৩ রানে ৩ উইকেট নেই ইংল্যান্ডের। ফিরে কি আসছে সেই পুরোনো ইংল্যান্ড! নামলেন অ্যান্ড্রু ফ্রেডি ফ্লিনটফ। লর্ডসের দুই ইনিংসে করেছিলেন ০ ও ৩ রান। এবার করলেন ৭৪ বলে ৬৮, সংগ দিলেন কেভিন পিটারসেন, লর্ডসে যিনি ঝলক দেখিয়েছিলেন, গ্রাহাম থর্পকে টপকে কেন তাঁকে বেছেছিলেন নির্বাচকরা, সে সিদ্ধান্তের পক্ষে কথা বলেছিলেন। আবার বললেন, এবার ৭১ করে। ইংল্যান্ড অলআউট ৪০৭ রানে। প্রথমদিনেই ৪০৭ রান, ইংল্যান্ডের রানরেটটাই যে বিস্ময় জাগানিয়া- ৫.১৩!      

          

     

                                ৯০ করে সাজঘরে ফিরলেন ট্রেসকোথিক                            

     

     

    ৩. অ্যাশলি ‘না পারা’  জাইলস

     

    প্রথম টেস্টের পর সবচেয়ে বেশী সমালোচনাটা হয়েছিল অ্যাশলি জাইলসকে নিয়ে। অনেক সংবাদমাধ্যমে তো এটাও বলা হয়েছিল, জাইলসকে নিয়ে খেলা দশ জনকে নিয়ে খেলার মতই! তবে পত্রিকায় লেখা নিজের এক কলামে জাইলস বলেছিলেন, ‘ইংলিশ শেন ওয়ার্ন বলে কিছু নেই। আমাদের যারা আছে, তাদের মধ্যে আমিই সেরা।‘ ভন বল তুলে দেওয়ার পর প্রথমে পন্টিং, পরে ক্লার্ককে তুলে নিলেন জাইলস। তবে প্রতীকি একটা ব্যাপার ঘটলো, শেন ওয়ার্ন ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে জাইলসকে তুলে মারতে গিয়ে বোল্ড হলেন। ইংলিশ শেন ওয়ার্ন বলে কেউ ছিল না, তবে যিনি ছিলেন, তিনি অস্ট্রেলিয়ান শেন ওয়ার্নকে বোল্ড করতে পারেন! অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস শেষ করলো ৯৯ রানে পিছিয়ে থেকে।

     

     

    আরো একটি উইকেট তুলে নিলেন জাইলস

     

    ৪. একবিংশ শতাব্দীর সেরা বল

     

    শুক্রবার, আগস্ট ৫, ঘড়িতে ৫.৫৫। শেন ওয়ার্নের অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলকে প্যাড-আপ করতে গেলেন অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস। চেয়ে চেয়ে দেখলেন শুধু, কীভাবে স্পিন জাদুকরের বলটি গিয়ে মিডল-লেগ স্ট্যাম্পে আঘাত হানলো! বল অব দি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি! ওয়ার্নের জাদু চললো পরের দিনও। ইংল্যান্ড পরিণত হলো ৭৫/৬ এ। আবার এলেন ফ্লিনটফ। ফ্রেডি ফ্লিনটফ। ৬ চার ও ৪ ছয়ে ৮৬ বলে করলেন ৭৩ রান, সাইমন জোনসকে নিয়ে শেষ উইকেটে গড়লেন ৫১ রানের জুটি। বোল্ড হলেন ওই শেন ওয়ার্নের বলেই। ইংল্যান্ডের লিড তখন ২৮১ রান। ফ্রেডি আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন, ওয়ার্নি পেছন থেকে ডাকেন, ‘ফ্রেডি, হে ফ্রেডি’! যখন পেছন ফিরে চাইলেন, হাততালি দিয়ে ওয়ার্নি বললেন, ‘ওয়েল প্লেইড’! শেন কিথ ওয়ার্ন, ক্রিকেটার শেন কিথ ওয়ার্নকে মিস করার এমন আরও অনেক কারণই চাইলে বের করতে পারেন।

     

     

    ওয়ার্নের "সেই ডেলিভারি"

     

     

    ৫. একটি ক্যারিয়ার, একটি ওভার!

     

    জাস্টিন ল্যাঙ্গার আর ম্যাথু হেইডেনের শুরুটা খারাপ হলো না। অস্ট্রেলিয়া তারপর মুখোমুখি হলো ফ্লিনটফের ক্যারিয়ারের করা সম্ভবত সেরা ওভারের।

     

    ত্রয়োদশ ওভার।

     

    প্রথম বল, রাউন্ড দ্য উইকেট, অফস্ট্যাম্পের একটু বাইরে, হালকা মুভমেন্ট। ল্যাঙ্গার কাভারে খেললেন।

     

    দ্বিতীয় বল, অফস্ট্যাম্পে শর্ট অব আ গুড লেংথ, পিচে পড়ার পর ল্যাঙ্গারের কনুই, তারপর স্ট্যাম্প, বোল্ড!

     

    তৃতীয় বল, অফস্ট্যাম্পের বাইরে থেকে এসে পন্টিংয়ের প্যাডে আঘাত হানলো, একটু উঁচু, এলবিডাব্লিউয়ের আবেদনে সাড়া দিলেন না বিলি বাউডেন।

     

    চতুর্থ বল, অফস্ট্যাম্পের বাইরে শর্ট অব আ লেংথ আবারও, এজড হয়ে স্লিপে গেল বল।

     

    পঞ্চম বল, আবারও অফস্ট্যাম্পের বাইরে থেকে ভিতরে ঢোকা বল, আবারও এলবিডাব্লিউয়ের আবেদন, বিলি নাকচ করলেন আবারও।

     

    ষষ্ঠ বল, অফস্ট্যাম্পের বাইরে ব্যাক অব আ লেংথের বল, ছেড়ে দিলেন রিকি পন্টিং। নো বল।

     

    ষষ্ঠ বল, ফুললেংথের, অফস্ট্যাম্পের বাইরে, পন্টিং ড্রাইভ করতে গেলেন। আচমকা মুভমেন্টে বল পন্টিংয়ের কোকাবুরাতে চুমু খেয়ে গেরাইন্ট জোনসের গ্লাভসে!

     

    এক ওভারেই নেই ল্যাঙ্গার, নেই পন্টিং। এরপর হেইডেন, মার্টিন, ক্যাটিচ, গিলক্রিস্ট, গিলেস্পিও গেলেন। অস্ট্রেলিয়ার রান তখন ১৩৭, ক্রিজে মাইকেল ক্লার্ক আর শেন ওয়ার্ন। ইংল্যান্ড অতিরিক্ত আধা ঘন্টা চেয়ে নিল, খেলা সেদিনই শেষ করতে। দিনের শেষ ওভারে ক্লার্ক আউট হলেন, হার্মিসনের স্লোয়ার বুঝতে না পেরে। রইলেন শুধু শেন ওয়ার্ন, ক্রিজে আসতে বাকি ব্রেট লি ও মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ।

     

     

    ফ্লিনটফের ক্যারিয়ার সেরা ওভার?

     

     

    ৬. দীর্ঘ ‘সংক্ষিপ্ত’ সময়

     

    অস্ট্রেলিয়ার রান দরকার তখনও ১২৭, ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ‘মাত্র’ দুটি উইকেট। চতুর্থ দিন, ৭ আগস্ট, বাকি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। তবে সকাল সাতটা থেকেই এজবাস্টনের বাইরে দর্শকের দীর্ঘ সারি! ঐতিহাসিক এক জয়ের সাক্ষী হতে হবে যে!

     

    দিনের শুরুতে রিচি বেনো বলছিলেন, ‘খুবই সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট হওয়ার কথা’। তবে ওয়ার্ন, লি আর ক্যাচপ্রোভিচ অবশ্য ভেবেছিলেন একটু অন্যরকম।

     

    এইতো আউট হবেন, এইতো টেস্ট জিতছে ইংল্যান্ড, এইতো সিরিজে সমতা এলো। এই ‘এইতো’ এলো না সহসাই! ওয়ার্ন আর লি ৫.২৩ হারে রান তুললেন ৪৫। ওয়ার্ন, লি অনেক ‘আঘাত’ সয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বাউন্সারের আঘাত। ওয়ার্ন ব্যাকফুটে গিয়ে খেলছিলেন, এই ব্যাকফুটে যাওয়াটাই কাল হলো তাঁর। ফ্লিনটফের ফুল লেংথের বলটিতে চলে গেলেন একটু বেশিই ব্যাকফুটে, স্ট্যাম্পে লাগলো পা! হিট উইকেট। এরপর এলেন ক্যাসপ্রোভিচ। সময়ের অপেক্ষা শুধু। সেই সময় যে এতো পরে আসবে, কে জানতো! তখনও অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৬২ রান!

     

     

    ঝড় সামলাচ্ছেন ওয়ার্ন

     

     

    ৭. গল্প আছে বাকী!

     

    ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচগ্র মেদিনী’ পণ যেন ভর করলো লি-ক্যাসপ্রোভিচের ওপর। অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ৫৬, তারপর ৫৫, ৪৬। তারপর ৩৩। নড়েচড়ে বসতে হয়! একটি করে ওভার শেষ হয়, অস্ট্রেলিয়ার ‘অনতিক্রম্য’ সীমা চলে আসে দৃষ্টিসীমায়। ৩০, ২৭, ২০, ১৯, ১৫। যেন টিকটিক ঘড়ির কাঁটা চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গোটা ইংল্যান্ডের হার্টবিট! ১৫ থেকে এক ধাক্কায় ৬ রান! হার্টবিট মিস করে যাওয়ার মতো অবস্থা তখন। যখন ৪ রান প্রয়োজন, হার্মিসনের ফুলটসকে কাভারে মারলেন লি। চার...। নাহ্‌! ভন আগে থেকেই সুইপার কাভারে ফিল্ডার রেখেছিলেন, হলো এক রান। দরকার ৩। ১, ২, ৩!

     

    পরের বলটা শর্ট লেংথের, ঠেকালেন ক্যাসপ্রোভিচ। তারপর লেগস্ট্যাম্প দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া এক শর্ট বল। ক্যাসপ্রোভিচ ডিফেন্ড করতে চাইলেন, গ্লাভসে লেগে গেল পেছনে। তারপর?

     

     

    ৮. একটি ছবি, একটি ইতিহাস

     

    শুনুন রিচি বেনোর মুখেই।

     

    ‘জোনস(শ)....বাউডেন... ক্যাস(শ)প্রোভিচ(স)... দ্য ম্যান টু গো.... অ্যান্ড হার্মিসন হ্যাজ ডান ইট, ডিস(শ)পেয়ার অন দ্য ফেসে(শ)স অব ব্যাটস(শ)ম্যান অ্যান্ড জয় ফর এভরি ইংল্যান্ড প্লেয়ার অন দ্য ফিল্ড...’।

     

    জোনস উল্লাসে হাত ছুড়ছেন, দিগ্বিদিক ছুটছেন ভন। ক্যাসপ্রোভিচ হাঁটুর ওপর ভর করে বসে পড়েছেন, এ প্রান্তে লিও তাই! হার্মিসন, জোনসকে ঘিরে ইংলিশরা উদযাপনে ব্যস্ত, ফ্রেডি ছুটে এলেন এদিকে। বসে থাকা ব্রেট লি হঠাৎ নিজের কাঁধে হাতের স্পর্শ অনুভব করলেন। ফ্লিনটফ সান্ত্বনা দিতে এসেছেন! অবশ্য হার্মিসন আগেই হাত মিলিয়ে গেছেন, তবে কোনো ক্যামেরায় ধরা পড়েনি তা। ফ্লিনটফ আর লি এর ছবিটাই তাই ইতিহাসে ঠাঁই পেয়ে গেল। "সবার ওপরে ক্রিকেট"- কথাটার ব্যাখ্যা করতে যা ব্যবহার করা হবে অনেকদিন। কী বলেছিলেন ফ্লিনটফ? কয়েকটা কথা ছড়ানো আছে, তবে লি ঠিক মনে করতে পারেন না, ওই সেকেন্ড দশেক এ ফ্লিনটফ কী বলেছিলেন!

     

    ইংল্যান্ড জিতলো। তবে ‘সংক্ষিপ্ত’ সময়ে নয়।

     

     

    কি বলেছিলেন ফ্রেডি?

     

     

    ৯. ‘এপিক’ এজবাস্টন

     

    দোরগোড়ায় আরেকটি অ্যাশেজ। এজবাস্টনের সেই জয় ইংল্যান্ডকে ১৮ বছর পর অ্যাশেজ জয়ের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। এই অ্যাশেজে জোনস নেই, বাউডেন নেই, ক্যাসপ্রোভিচ নেই। নেই শেন কিথ ওয়ার্ন, অ্যান্ড্রু ফ্রেডি ফ্লিনটফ। ব্রেট লিও নেই। রিচি বেনো তো পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছেন।

     

    তবে ৪ আগস্ট ২০০৫ সালে শুরু হওয়া এজবাস্টন টেস্টকে মনে রাখবেন তাঁরা, হয়তো আজীবনই। মনে রাখবেন তাঁরাও, যাঁরা দেখেছেন। এবার তৃতীয় টেস্ট এজবাস্টনে। হয়তো দশ বছর আগের সেই ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো ম্যাচ দেখা হবে না এবার। তবে তার স্মৃতি ফিরে আসবে।

     

    মনে রাখার মতো অসংখ্য ঘটনা অ্যাশেজ উপহার দিয়ে চলে। সেসবের মধ্যেও আলাদা করে মনে রাখতে হয় এজবাস্টনকে।

     

    ‘এপিক’ এজবাস্টনকে।

     

    যে মহাকাব্যের শুরুতে ছিল একটা ‘নিরীহ’ ক্রিকেট বল।

     

    শেষে ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ছবি।

     

    ইতিহাস রচিত হল, ইংল্যান্ডের জয়ের মাধ্যমে