• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    শেকড়ে ফিরলেন 'শরণার্থী' শাকা-শাকিরি

    শেকড়ে ফিরলেন 'শরণার্থী' শাকা-শাকিরি    

    ১.
    নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যুগোস্লাভিয়ার  জাতিগত বিদ্বেষ রূপ নিয়েছে আন্দোলনে। দানা বাঁধা আন্দোলন একটু একটু করে যুদ্ধের দিকেই গড়াচ্ছে। সে আন্দোলনে অনেকের মতো যোগ দিয়েছিলেন রাগিপ শাকাও। বয়স তখন ২২, বিয়ে করেছেন মাত্র তিন মাস আগে। রাগিপের অপরাধ ছিল যুগোস্লাভিয়া সরকারের বিরোধিতা করা। কসোভো আলবেনিয়ান হওয়ার দোষে জেলে ঢুকতে হলো। সাজা ৬ বছরের। রাজনৈতিক বন্দি হয়ে সার্বিয়ার জেলে আটকা রাগিপ। শুরুর কয়েকদিন কোনোরকমে কাটালো, দিন পনেরো যাওয়ার পর শুরু হলো অত্যাচার।

    এভাবে চললো সাড়ে তিন বছর। কোনো এক অজানা কারণেই তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হলো যুগোস্লাভিয়া সরকার। এই সাড়ে তিন বছর ১৫ দিন পর পর রাগিপের সঙ্গে দেখা এসেছেন রাগিপের স্ত্রী এলমেজ। একদিন হুট করেই বাড়ি ফিরলেন রাগিপ, কাউকে কিছু না জানিয়েই। মুক্তি মিলেছে তার। শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে- ছাড়তে হবে দেশ। স্ত্রীকে নিয়ে সুইজ্যারল্যান্ড যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

    ১৯৯০ সালে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগেই দেশ ছাড়লেন রাগিপ আর এলমেজ। শরনার্থী হয়ে পাড়ি জমালেন সুইজারল্যান্ডে, রাগিপ নিলেন মালীর কাজ। নতুন একটা শুরুর দরকার ছিল রাগিপ আর এলমেজের। তাই জন্য বেছে নিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডকে। রাগিপ আর এলমেজের ঘরেই জন্ম গ্রানিত শাকার।

    সুইজারল্যান্ডেই জন্ম, বেড়ে উঠেছেন সেখানকার সংস্কৃতিতে। কিন্তু বাবার মুখে দেশের গল্প শুনেই বড় হয়েছেন। এখনও প্রায়ই বাবার মুখ থেকে পুরনো গল্পগুলোই শুনতে চান। শুনতে চান বন্দি দশার দিনগুলোর কথা। রাগিপ নতুন করেই বলেন পুরনো গল্প, কিন্তু সেই গল্পের সুর কেটে যায় মাঝে মাঝেই। গ্রানিত বুঝতে পারেন, কিছু একটা লুকাচ্ছেন বাবা। তিনিও বাকিটা শুনতে চাননা, রহস্যঘেরা গল্পগুলোর অবদান আছে তার জীবনে। শরনার্থী হয়ে সুইজারল্যান্ডে আসা বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় নত হন শাকা।

    শাকার বাবা মায়ের নিজেদের জন্মভূমিতে ফেরা হয়নি। কিন্তু তাদের ত্যাগ শাকাকে দিয়েছিল একটা সুযোগ। ফুটবলার হয়ে ওঠার। শাকা কাজে লাগিয়েছেন সেটা। সুইজারল্যান্ড জাতীয় দলের ফুটবলার তিনি, খেলেন আর্সেনালে।       
     

    শাকার বাবা মায়ের মতো সেবার আরও প্রায় দুই লাখ শরনার্থী পাড়ি জমিয়েছিল সুইজারল্যান্ডে। এক প্রজন্ম পর সুইজারল্যান্ডের একটা বিরাট অংশ তারাই। সুইসদের ফুটবল দলের দিকে এক নজর চোখ বুলালেই সেটা বোঝা যায়।



    ২.
    জের্দান শাকিরির জন্ম কসোভোতেই। যুদ্ধ শুরুর আগে তার বাবা মাও শরনার্থী হয়ে এসেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। শাকিরির অবশ্য সে ঘটনা মনে নেই। তার মনে আছে ছোটবেলায় দুর্দশায় কাটানো দিনগুলো। বাবা রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন, মা ছিলেন অফিসের ক্লিনার। শাকিরি আর তার দুই ভাইকে সঙ্গে করে নিয়েই কাজে যেতেন মা। জানালার কাঁচ পরিস্কারে মাকে সাহায্য করতেন ছেলেরা। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় রাতে ঘুমানোর জো নেই। শাকিরি পাগলের মতো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়াতেন। তাতে যদি গা গরম হয়!

    বাবা মায়ের হাত ধরে এসেছিলেন, কিন্তু শাকিরি কসোভো ফেলে এসেছিলেন আরেক পরিবার। যুদ্ধ শুরুর পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল শাকিরির চাচার বাড়ি। সব হারিয়ে নিঃস্ব তারা, শাকিরির বাবা মায়ের অল্প রোজগার থেকেই তাই কসোভো টাকা পাঠাতে হত তাদের কাছে।

    স্কুলের বাকি ছেলেদের ফুটবলে তেমন মন নেই। কিন্তু শাকিরি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে তো ফুটবল জীবনেরই অংশ। রোনালদো ভক্ত ছিলেন শাকিরি, ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে রোনালদোকে মাঠ ছাড়তে দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। পরেরবার রোনালদোর মতো চুলের ছাঁট দিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্কুলে। কে কি ভাবল তাতে শাকিরির কিছু যায় আসে না।

    যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধ থেমেছে বহু আগেই। জীবন যুদ্ধেও শাকিরি জিতেছেন। ১৮ বছর বয়সে ডাক পেয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে। এখন খেলছেন নিজের তৃতীয় বিশ্বকাপ। সুইজারল্যান্ডের লিওনেল মেসি তিনি। আক্রমণের প্রাণ, গোলের উৎসও।  

    ৩.
    ১৭ জুন, সামারা। রাশিয়া।

    কোস্টারিকাকে হারানোর পর সার্বিয়ান সমর্থকদের উল্লাস চললো বহুক্ষণ ধরে। পরের ম্যাচে প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বৈরিতা নেই, ফুটবল মাঠেও শত্রুতার কারণ নেই। আর দশটা প্রতিপক্ষের মতোই। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে গেল অন্য কারণে। রাজনৈতিক ছায়াটা চাইলেও বোধ হয় বাদ দিতে পারতেন না দুই দেশের সমর্থকেরা। 

    যুদ্ধ থামলেও কসোভো নিয়ে সার্বিয়া আর আলবেনিয়ার তিক্ত সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। ফুটবল মাঠে সেই উত্তাপ যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ২০১৬ ইউরোর বাছাইপর্বে পরিত্যক্তই হয়েছিল সার্বিয়া আর আলবেনিয়ার ম্যাচ। আকাশে ড্রোন নিক্ষেপ করে আলবেনিয়ান এক সমর্থক জানান দিয়েছিলেন কসোভো তাদের। গ্যালারির উত্তাপ পরে গড়িয়েছিলে দুই দলের হাতাহাতি পর্যন্তও। আর শরনার্থী শিবির থেকে উঠে আসা ফুটবলারের সংখ্যাও কম নয় সুইস দলে। শাকিরি আর শাকার মতো ভাল্যন বেহরামি, ব্লেমির জেমাইলিরাও কসভো থেকে উঠে এসে জায়গা করে নিয়েছেন। এই দলের অল্প কয়েকজনকে বাদ দিলে বাকিদের সবার শেকড়ই অন্য দেশে।

    শাকা, শাকিরিরা নিজেদের সুইস জাতীয়তা ছাপিয়ে গর্ব করে আলবেনিয়ান বলে পরিচয় দেন। শাকিরির দুই বুটে থাকে দুই দেশের পতাকা। একটা সুইজারল্যান্ডের, আরেকটা কসোভোর। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আলবেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে শাকিরির বুটে ওই দুই দেশসহ ছিল আরও একটা পতাকা, সেটা আলবেনিয়ারই। গোলের পর করেননি কোনো উদযাপনও। কে কি ভাবল তাতে সত্যিই কিছু যায় আসে না শাকিরির।

    এর ফলটাও অবশ্য পেতে হয় মাঝেমধ্যেই। প্রায়ই সুইজারল্যান্ডে সমালোচনারও স্বীকার হন তারা। যথেষ্ট দেশপ্রেম নেই বলে অভিযোগ ওঠে। তখন বাস্তবতাটা মনে করিয়ে দেন তারা- সুইজারল্যান্ডে তাদের পরিবারের আসাটা নিতান্তই ছিল জীবিকার তাগিদে, এই দেশ তাদের অনেক দিয়েছে, তারাও ঋণী। সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন সুইজারল্যান্ডকে সেরাটাই দিয়ে যেতে। কিন্তু নিজেদের দেশের প্রতি ওই আবেগটুকুর জন্য দুয়ো শুনতে চান না তারা।     

    সুইজারল্যান্ডে খেলোয়াড়দের বিরাট এই অংশের কসোভো-আলবেনিয়ার প্রতি এই টানটা অজানা ছিল না সার্বিয়ান সমর্থকদের। কোস্টারিকার সঙ্গে ম্যাচ জয়ের পর একদল সার্বিয়ান বলেই বসলেন, “কসোভো আমাদের”। রাশিয়ার সঙ্গে বরাবরই সার্বিয়ার সম্পর্ক ভালো। সামারায় সার্বিয়ানদের উৎসবের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন রাশিয়ানরাও। আর আলবেনিয়ান সুইসদেরও মনে আগুন, প্রতিশোধটা ফুটবল মাঠেই নেবেন, বিশ্বকাপের চেয়ে বড় আসর কি আছে?  ম্যাচের আগেও তাই ফুটবল ছাপিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও নিজের জায়গা করে নিল আলোচনায়।



    ৪.
    ২২ জুন, কালিনিনগ্রাদ। সার্বিয়া-সুইজারল্যান্ড, ৯০ মিনিট।

    এক দৌড়ে শাকিরি পেছনে ফেললেন সার্বিয়ান ডিফেন্ডারদের। শাকিরি দৌড়াচ্ছেন শৈশবের মতো, সবকিছু পেছনে ফেলে। গা গরম করা এখন আর উদ্দেশ্য নয়, শাকিরির পায়ে বল। ভ্লাদিমির স্টইকোভিচকে বোকা বানিয়ে সেই বল পাঠালেন জালে। শাকিরি দৌড় থামালেন না। দুই হাত উলটো করে, বুড়ো আঙ্গুলে এক করে, আলবেনিয়ান ঈগল বানালেন। তার সঙ্গে যোগ দিলেন শাকাও। কিছুক্ষণ আগে তিনিই এই উদযাপনটা করে দেখিয়েছিলেন। ডিবক্সের বাইরে থেকে করা শটে শাকাই গোল করে সমতায় ফিরিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডকে। শেষ মুহুর্তে শাকিরির ওই গোলে নিশ্চিত জয়। শাকা, শাকিরির সঙ্গে উদযাপনে যোগ দিলেন বেহরামিরাও। সার্বিয়ার সঙ্গে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল সুইজারল্যান্ড। আর যাদের কাছে গোল খাবেন না বলে ঠিক করেছিলেন সার্বিয়ান সমর্থেকেরা, তারাই ঘুরিয়ে দিলেন ম্যাচের মোড়।

    শাকিরি বাঁ পায়ের খেলোয়াড়। ওই পায়ের বুটে তার সুইজারল্যান্ডের পতাকা। গোলটাও করেছেন বাঁ পায়েই। আর উদযাপনে মিশে ছিল কসোভো আর আলবেনিয়া।    

    ২৮ বছর আগে আসা শরনার্থী পরিবারের দুইজনের গোলেই জয় নিশ্চিত সুইজারল্যান্ডের। হয়ত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডটাও। অমন উদযাপনের পর হয়ত ফিফার কাছ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পেতে হতে পারে দুইজনের। হয়ত জরিমানাও গুণতে হবে। ম্যাচের পর শাকিরি তার উদযাপন নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। দেশাত্মবোধ নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠবে তাই হয়ত মুখ খোলেননি। কিন্তু স্নায়ু যখন চরমে, আবেগ যখন তুঙ্গে সেই মুহুর্তে ঠিকই অতীত নাড়া দিয়েছে। গোলের উদযাপনে কেবল ভেসে উঠেছে তার প্রতিফলন। আর পেছনের গল্পটা  দিয়েছে সবকিছুর বৈধতা। শাকা-শাকিরি ফিরে গেছেন শেকড়ে।