• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    সাক্ষী ছিলেন 'থাকা, না থাকার' রোহো

    সাক্ষী ছিলেন 'থাকা, না থাকার' রোহো    

    মার্কোস রোহোর সেখানে থাকার কথা ছিল না।

    ডানদিক থেকে গ্যাব্রিয়েল মের্কাদো যখন ক্রস করছেন, উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই রোহো ছিলেন না। ডিবক্সের ভেতর থেকে ডান পায়ে এরপর রোহো যে গোল করলেন, সেটা দেখে ঈর্ষায় ভুগবেন স্ট্রাইকাররাও। হেড থেকে হলে নাহয় কথা ছিল, তার শক্তির জায়গা বাঁ পায়ে হলেও নাহয় ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ডিফেন্ডার হয়ে ডান পায়ে এমন ফিনিশ?

    ***



    রোহোর তো আসলে দলেই থাকার কথা ছিল না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে প্রায় পুরোটা মৌসুম কাটিয়েছেন সাইডবেঞ্চে। রেড ডেভিলদের হয়ে শুরু করেছেন মাত্র ৪টি ম্যাচ। বাছাইপর্বেও আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলির দলে ঠাঁই হয়নি। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে অনেকটা চমকই ছিল রোহোর নাম।

    সেই রোহো নেমেছিলেন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচেও। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে জেতা হয়নি আর্জেন্টিনার। দলগতভাবেই রক্ষণে একাধিক ভুল করেছিল আর্জেন্টিনা। তার ভুলগুলোই চোখে পড়ল বেশি। নিকোলাস অটামেন্ডিরা ক্লাবের হয়ে দারুণ মৌসুম কাটানোয় সমালোচনা থেকে রেহাই পেয়ে গেলেন। আর রোহো হয়ে গেলেন বলির পাঁঠা। পরের ম্যাচে একাদশ থেকেই বাদ পড়লেন, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনা হারল আরও বাজেভাবে

    ***

    কোপা আমেরিকা ফাইনাল, ২০১৬। চিলির দশ জনের দলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার লড়াইটা সহজই হয়ে গিয়েছিল কিছুটা। ২৮ মিনিটে চিলির মার্সেলো ডিয়াজ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছিলেন। অবশেষে আর্জেন্টিনার কিছু জেতা হচ্ছে। লিওনেল মেসির শিরোপা খরাও বোধহয় কাটতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে। সেই স্বস্তি প্রথমার্ধের আগেই শেষ। ৪৩ মিনিটে রোহোকে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দিলেন রেফারি। সেই সিদ্ধান্ত বিতর্কিত ছিল, আজকে দিনের ভিএআরের সাহায্য থাকলে হয়তো বেঁচেই যেতেন রোহো। রোহোর ভাগ্য খোলেনি, আর্জেন্টিনারও শেষ পর্যন্ত শিরোপা জেতা হয়নি।

     

     

    রোহো ওখানে থাকতে চেয়েছিলেন। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চেয়েছিলেন।  

    তার দুইবছর আগে বিশ্বকাপ দিয়েই রোহো আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ২০১৪ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল বাদে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছেন প্রতিটি ম্যাচ। হলুদ কার্ডের খড়গে বেলজিয়ামের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা হয়নি তার। সেবার খেলেছিলেন লেফটব্যাক হিসেবে। ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনার বাঁ দিকের রক্ষণ নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন সবাই। ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিলেন রোহো। অথচ বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনার লেফটব্যাক হিসেবে রোহোর নামটাই আশ্চর্যজাগানিয়া। বসনিয়া ও হার্জেগভিনার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তো আরেক কান্ড। আক্রমণে বসনিয়া চলে এসেছে আর্জেন্টিনার ডিবক্স পর্যন্ত, রোহো কোনোমতে বলের নাগাল পেয়েছেন। দলকে বিপদমুক্ত করতে হলে যে কোনো দিকেই নিজের বাঁ পায়ে শট করতে পারতেন। রোহো মারলেন একটা র‍্যাবোনা কিক। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, ডিফেন্ডার হয়ে র‍্যাবোনা, তাও আবার নিজের ডিবক্সের সামনে? এমন দৃশ্য তো হাস্যরসই যোগায়। “ডিয়েগো ম্যারাডোনার দেশে সবাই ফুটবল ঈশ্বর হতে চান। গোল ঠেকানোটা আর্জেন্টাইনরা কাজই মনে করে না”- এমন একটা মন্তব্য ‘টপ কমেন্ট’ হয়ে ছিল অনেকদিন।

    রোহোর রাতারাতি নাম ডাক ওই ম্যাচের পর থেকেই। কিন্তু এই কারণে রোহো 'টপ কমেন্ট' হয়ে থাকতে চাননি। র‍্যাবোনা মারার পরই সতীর্থদের বিস্ময় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন রোহোও। হাত তুলে জানান দিয়েছিলেন এমনটা আর হবে না, এমন ছেলেমানুষী আর করবেন না। রোহোকে আর র‍্যাবোনা মারতেও দেখা যায়নি।

    ***

    ২০১৪ বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া। 

    ততোদিনে গ্রুপপর্ব উতরে গেছে আর্জেন্টিনা। তেমন কোনো চাপ নেই। কিন্তু জয়ের ধারা বজায় রাখতে নাইজেরিয়াকেও হারাতে হবে। বিশ্বকাপে ৭ টা ম্যাচ খেলতে চাইবেন আপনি, তার কোনোটাই হারতে চাইবেন না। মেসি করলেন দুই গোল, নাইজেরিয়াও শোধ করলো দুইবার। এরপর কর্নার থেকে অনেকটা না চাইতেই গোল করে ফেললেন রোহো। বাঁ পায়ে মারতে চেয়েছিলেন, কিন্তু টাইমিং হয়নি। হাঁটুতে বল লেগে জালে ঢুকে গেল। ওই গোলেই পরে নির্ধারিত হলো ম্যাচের ভাগ্য। আর্জেন্টিনা জিতল ৩-২ গোলে।

    ৪ বছর পর আবারও প্রতিপক্ষ সেই চেনা নাইজেরিয়া। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচই।

    এই ম্যাচটা আর্জেন্টিনার জন্য হয়ে গেল ফাইনালের মতো, সমীকরণটাও সহজ। জিততেই হবে। তবে এই ম্যাচের আগেই টালমাটাল আর্জেন্টিনা। তবুও এই বেসামাল দলকে সমর্থন যোগাতে কয়েক হাজার আর্জেন্টাইন সমর্থক হাজির টিম হোটেলের সামনে, ম্যাচের আগেরদিন। নেচে-গেয়ে মাতিয়ে রাখলেন সামনের পুরো রাস্তাটা। আর্জেন্টিনা থেকে উড়ে আসা সমর্থকদের কৃতজ্ঞতা জানাতে হোটেল থেকে নেমে এলেন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরাও। তাদের মধ্যে ছিলেন রোহো। সমর্থকদের দিকে হাত নাড়ালেন, এক হাত উঁচিয়ে আর্জেন্টাইন রীতি অনুযায়ী তাল মেলালেন গানের সুরে। এই রোহো আর আর্জেন্টিনাকে দেখে চেনার উপায় নেই- এই দলটাই আছে পাহাড়সমান চাপে! 

    সেন্ট পিটার্সবার্গের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দলে ফিরলেন রোহো। এবার আর লেফটব্যাক নয়, সেন্টারব্যাক তিনি। মেসিও বিশ্বকাপে গোল পেলেন। শেষ এই নাইজেরিয়ার সঙ্গেই নিজের গোল উদযাপন করার সুযোগ হয়েছিল তার। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য খেলার মোড় গেল ঘুরে। আর্জেন্টিনা আবারও চাপে, পেনাল্টি থেকে গোল হজমের পর আবারও এলোমেলো তাদের খেলা। শুরুতে দেওয়া ভালো কিছুর ইঙ্গিত মিলিয়ে গেছে ততোক্ষণে। কিন্তু একটা গোল দিলে তবুও একটা সম্ভাবনা থাকে আর্জেন্টিনার, জয়টা পেলেই তো নিজেদের হাতে থাকা কাজটা হলো।

    ৭৬ মিনিটে নাইজেরিয়ার কাউন্টার অ্যাটাক। বাঁ দিক থেকে ক্রস ঠেকাতে রোহো লাফ দিলেন, লাগলো হাতে। রেফারি অবশ্য দেখলেন না। বল তবুও গেল নাইজেরিয়ার স্ট্রাইকার ইঘালোর কাছে। তার সামনে শুধু আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক। তিনি শট করলেন, সেটাও গেল বাইরে দিয়ে। রোহো হাফ ছেড়ে বাঁচবেন সেই উপায়ও নেই। রেফারির চোখ এড়ালেও ভিএআরের চোখ তো এড়ায়নি। ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির পরামর্শে রেফারি নিজেও একবার মাঠের বাইরে গিয়ে দেখে আসলেন ওই ঘটনা। অন্যদিন হলে হয়ত পেনাল্টিই পেয়ে যেত নাইজেরিয়া। রেফারির সিদ্ধান্তে বেঁচে গেছেন রোহো, বেঁচে গেছে আর্জেন্টিনাও। দম বন্ধ হয়ে আসা শেষ মুহুর্তে রোহো নিশ্চয়ই আরেকবার 'ভিলেন' হতে চাননি।


    তারপর বদলে গেল রোহোর খেলার ধরন। সবকিছু ছেড়ে এসেছিলেন রক্ষণে। বিপদ হতেই পারত। কিন্তু একটু আগে জুয়ায় জিতেছেন। সেটাই বোধ হয় অনুপ্রেরণা যোগালো। হয় বাঁচো নয় মরো। রোহো আক্রমণেই উঠে এলেন, রক্ষণ ছেড়ে। বাঁ দিক থেকে ৮০ মিনিটে গঞ্জালো হিগুয়াইনের জন্য একটা বল বাড়িয়েছিলেন, হিগুয়াইন অন টার্গেটে শট করলেই হয়ত গোল হয়ে যেত। কিন্তু তিনি বাঁ পায়ে শট মারলেন অনেক ওপর দিয়ে। ৬ মিনিট পর রোহোর ওই গোল।  দুর্বল ডান পায়ে ডিবক্সের ভেতর থেকে সেটপিস পরিস্থিতি ছাড়া এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কবে গোল করেছেন কোনো ডিফেন্ডার? সেটা চট করে মনেও পড়ার কথা নয়।

    মেসিই হয়ত উজ্জীবিত করেছিলেন। চার বছর আগেও গল্পটা একইরকম ছিল, সেই গল্পটাই নতুন করে লিখলেন রোহো। গোলের পর মেসি চড়লেন তার কাঁধে। রোহোও তাকে বয়ে নিয়ে গেলেন কর্নার ফ্ল্যাগ পর্যন্ত। ওই মুহুর্তটা হয়ে গেল ম্যাচের প্রতিচ্ছবি, আর্জেন্টিনার এই বিশ্বকাপের প্রতিচ্ছবি। আসলে আর্জেন্টিনাই ওই কাঁধে ভর করে পার হলো গ্রুপপর্ব। কাঁধ নয়, আসলে ডান পায়ে।

    আর্জেন্টিনায় সবাই ম্যারাডোনা হতে চায়- পুরনো প্রবাদবাক্য। হয়ত রোহোও সেটাই হতে চেয়েছিলেন ছোটবেলায়। নিজের রক্ষণে মারা র‍্যাবোনাটা হয়ত এসেছিল ভেতর থেকেই। আজ যেমন ডান পায়ের ফিনিশটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সময়মতো!

    রোহোর সেখানে থাকার কথা ছিল না, কিন্তু রোহো সেখানেই থাকতে চেয়েছিলেন।