• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    আর্জেন্টিনার বিদায়: সর্ষের মধ্যেই ভূত?

    আর্জেন্টিনার বিদায়: সর্ষের মধ্যেই ভূত?    



     

    ফ্রান্স মাঠ ছেড়ে গেছে। গ্যালারির গাঢ় নীল সমর্থকরাও মাঠ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আকাশি-সাদা জার্সি পরা সমর্থকেরা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। মাঠ থেকে লিওনেল মেসি, হাভিয়ের মাসচেরানোরা বিদায় জানাচ্ছেন সমর্থকদের। একটু আগে এই মাঠেই শেষ হয়ে গেছে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন। শেষ হয়েছে আসলে একটা রোলার কোস্টার রাইড। চড়াই-উতরাইয়ের চূড়ান্তটা দেখা হয়ে গেছে আর্জেন্টিনার। সমর্থকেরাও তাই শেষ পর্যন্ত থাকলেন, দলকে বিদায় জানাতে। এখন একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেওয়াই যায়! গত চার বছরে তিন ফাইনালের হার, শেষ বছরে মিরাকল ঘটিয়ে বিশ্বকাপে আসা, এরপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা পথ শেষ হলো কাজানে- এখন একটু জিরিয়ে নেওয়াই যায়।

    টানেল দিয়ে দল নিয়ে ঢুকেছেন মেসি। এরপর বিদায় জানিয়েছেন মাসচেরানো। তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন লুকাস বিলিয়াও। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে তাদের সব দেখা হয়ে গেছে। সব পাওয়া হয়নি, হয়ত কিছুই পাওয়া হয়নি- বিদায়বেলায় শূন্যতাই হয়েছে সঙ্গী। আরও শূন্য করে দিয়ে গেছেন আর্জেন্টিনার ঘর। কাজান থেকে ব্রনিসিতে ফিরবে আর্জেন্টিনা। এরপর ব্যাগ গুছিয়ে দেশের পথে। ট্রেনিং ক্যাম্পের দেয়ালে সাঁটানো যোদ্ধার বেশে আর্জেন্টিনা খেলোয়াড়দের পোস্টারটা খুলে ফেলা হবে তাড়াতাড়ি।

    এর আগেই অবশ্য আর্জেন্টাইনরা জেনে গেছে, ফুটবল ঈশ্বরের যে খোঁজে তারা বেরিয়েছিলেন, সেটা আসলে অবাস্তব এক কল্পনা ছিল মাত্র। সাড়ে চার কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় মেসিও বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন- তার কাছে একটা বিশ্বকাপ পাওনাই হয়ে গেছে দেশের মানুষের। ডিয়েগো ম্যারাডোনার কাছেও আশা করেছিল আর্জেন্টাইনরা, কিন্তু সেটা চাপ হয়ে যায়নি কখনই। আর্জেন্টাইনদের আকাঙ্ক্ষা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, যে মেসির কাঁধেও সেটা বোঝা হয়ে দাঁড়াল। ফলাফল একটাই হওয়ার ছিল, সেটাই হয়েছে।

    নাইজেরিয়ার সঙ্গে গোলের পর মেসির উদযাপনটাই দেখুন। দুই হাত উঁচুতে মেলে ধরা নিয়মিত ঘটনা, মেসির চেহারাটা কল্পনা করুন। যেন মুক্তি মিলেছে তার। সেই মুক্তির আনন্দে কতক্ষণ চোখ বুজে ফেলেছেন। অথচ ম্যাচ তখন কেবল শুরু, পুরো কাজটাই বাকি। একটা গোল লাইফলাইন দিয়েছে মাত্র। উদযাপনে নিখাদ আনন্দের সঙ্গে মিশে থাকল চাপা একটা কষ্ট। গ্রুপপর্ব পেরুতেই মেসিকে এই উদযাপন করতে হয়, তাহলে আরেকবার ফাইনাল পর্যন্ত উতরে যেতে হলে কতোখানি শক্তি প্রয়োজন ছিল? সেই মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতা কি অ্যাথলেট হলেও থাকে?

    অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবল তাদের শিল্প-সংস্কৃতির অংশ। রাস্তা থেকে শুরু হয় ফুটবলের হাতেখড়ি। তারপর নিছক মজার ছলে করা খেলাটাই হয়ে যায় অনেকের পেশা। আর্জেন্টিনার একেকটা শহর একেকটা ফুটবলের দেশ। ইউরোপের আলোঝলমলে লিগের কাছে ম্লান মনে হতে পারে। কিন্তু বোকা জুনিয়র্স-রিভার প্লেটের কাছে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনার ম্যাচ তেমন গুরুত্ব পাবে না বুয়েনস আইরেসে।

    প্রতিটি শহর একেকটা ফুটবলের দুর্গ। ভরা গ্যালারির সামনে প্রতি সপ্তাহে খেলেন শত শত আর্জেন্টাইন ফুটবলার। ফুটবল আপনার পেশা হতে পারে, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে নিজ শহরের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে মাঠে নামতে হলে খেলাটা আপনাকে উপভোগ করতেই হবে। ফুটবলকে ঘিরে আর্জেন্টাইনদের আলাদা একটা ইতিহাস আছে, একটা ঐতিহ্য আছে। আপনাকে কৌশল জানতে হবে, চতুর হতে হবে, নিখুঁত ফুটবল খেলতে পারতে হবে- সবকিছু করতে হবে মাঠেই। আপনি যদি আগেই চাপে ভেঙে পড়েন তাহলে আর্জেন্টাইন ফুটবলের ওই স্বাদটাই আর পাওয়া হবে না।

    মেসি এখানেই হেরে গেছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে খেলাটাই উপভোগ করতে পারেননি তিনি। আগের বিশ্বকাপ পর্যন্তও সেটা সামলে নিতে পারছিলেন। কিন্তু পরের দুইবছর কোপা আমেরিকা ফাইনালের হার বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে। মেসিকে, আর্জেন্টিনাকে।

    আর্জেন্টিনার হারের লম্বা ব্যবচ্ছেদ করা যায়। কোচ হোর্হে সাম্পাওলির প্রতিটি সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।  নতুন কাউকে এনে হয়ত সবকিছু রাতারাতি ঠিকও করে ফেলা যায়, তারপর আরেকবার বিশ্বকাপ এলে স্বপ্নে বুক বাধতে পারেন আর্জেন্টাইনরা। কিন্তু সেই স্বপ্নের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

    আর্জেন্টিনার সমস্যা আরও গভীরে। শেষ ৪ বছরে তাদের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বদলেছে ৪ বার। রাশিয়ায় বড়সড় একটা বিমান ভাড়া করে এসেছিল আর্জেন্টিনা। সেটা পাওয়া গেছে আগের একটা ঘটনার কারণে। যেটা নিমিষেই দুর্ঘটনায় পরিণত হতে পারত।

    শ্যাপোকোয়েন্সের কথা মনে আছে? বছর দুই আগে আর্জেন্টিনা দলের জন্য ভাড়া করা বিমান একটুর জন্য বেঁচেছে দুর্ঘটনার হাত থেকে। বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই জ্বালানী প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল, ১৮ মিনিট বাকি ছিল। সপ্তাহ দুই পরে শ্যাপোকোয়েন্স ওই উড়োজাহাজে করেই কলম্বিয়ার পথে রওয়ানা হয়েছিল। এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা। আপনি মেসি, আপনি আগুয়েরো বা ডি মারিয়া- মাঠের খেলায় জান ঢেলে দেবেন? নাকি জান বাঁচানোর চিন্তা করবেন? দুর্ঘটনার কথা অবশ্য আলাদা করে ফেলা যায়। কিন্তু আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের আর্থিক দৈন্যের কথা তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। খেলোয়াড়দের বেতনভাতা নিয়মিত পরিশোধ হয় না সেখানে, কর্মচারিদের বেতন তো বাদই। তাই মেসিরা এগিয়ে আসেন। শেষ ৬ মাস তাদের বেতন ভাতা মিটিয়েছেন মেসি নিজেই।

    ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ঝামেলাও হয়ত কয়েক বছরের মধ্যে সমাধান সম্ভব। কিন্তু যে পরিবর্তনটা সবার আগে দরকার সেটা কি সম্ভব? সবকিছুর আগে দরকার ধৈর্য্য। আর্জেন্টিনার ফুটবলে একটা মেধাশূন্যতা চলছে। সেটা ইউরোপিয়ান ফুটবলের দিকে একটু চোখ বুলালেই বোঝা যাবে। এ বছর চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে খেলা চার ক্লাবের তিনটিতেই ছিল না কোনো আর্জেন্টাইন। একমাত্র রোমায় ছিলেন দুইজন। অথচ ৫-৬ বছর পেছনে ঘুরে আসুন, চার দলের খেলোয়াড়দের মিলিয়ে আর্জেন্টিনার একটা স্কোয়াডই দাঁড় করিয়ে ফেলা যেত।

    রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে গত প্রায় ৪ বছরে কোনো আর্জেন্টাইনের জায়গা হয়নি। ব্যাপারটা যেমন আর্জেন্টাইনদের জন্য নতুন, রিয়ালের জন্যও তাই। মেসিই হয়ে আছেন একমাত্র আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় যিনি বার্সেলোনায় খেলেন। আসলে আর্জেন্টিনার একটা প্রজন্মই হারিয়ে গেছে, এই বিশ্বকাপ দিয়ে। বুড়ো একটা দল নিয়ে রাশিয়া গিয়েছিল লা আলবিসেলেস্তেরা। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে নামানো দলটা গড় বয়সের হিসাবে বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে বুড়ো একাদশ। কোনোমতে নাইজেরিয়াকে টেক্কা দেওয়া গেলেও, পরের ম্যাচেই বয়সের ছাপটা টের পাওয়া গেল আর্জেন্টিনার খেলায়। কিলিয়ান এমবাপ্পে দৌড়াচ্ছেন বিদ্যুৎ গতিতে, তার পেছনে ছুটছেন মাসচেরানোরা, গতি দেখেই বলে দেওয়া যায় কার বয়স কত। এই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারাও ডুবিয়েছে আর্জেন্টিনাকে। সাড়া জাগানোর মতো নতুন কোনো খেলোয়াড় আসেননি, তাই এই বুড়ো দলের বিকল্পও ছিল না। অথচ অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি শিরোপা নেই অন্য কোনো দেশের। ১৯৮৬ সালের পর ৫ বার অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টাইন যুবারা। তাই মেসি, রিকেলমে, আইমার, তেভেজ, আগুয়েরো, মাসচেরানোর মতো খেলোয়াড়দের পেতে কখনও সমস্যা হয়নি তাদের। কিন্তু এই দেশটাই গত ১১ বছর ধরে শিরোপাশূন্য। শেষ ৫ আসরে মধ্যে দুইবার বিশ্বকাপেই বাছাই করতে পারেনি তারা। সেরা সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনাল, আর বাকি দুইবার প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়।  

    সবকিছুর সমাধান হলেও তাই এ একটা জায়গায় ধৈর্য্যই ধরতে হবে আর্জেন্টাইনদের। স্পেন, জার্মানিও এই সময়টা পার করেছে। এবারের বিশ্বকাপটা হয়ত জার্মানদের ভালো যায়নি, কিন্তু তাতে একটুও কালির আঁচড় পড়ছে না ৪ বছর আগে লেখা মহাকাব্যে। জার্মানির কাছে আছে খেলোয়াড়, সবাই একটা ছকের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। এই জার্মানি উঠে দাঁড়াবেই। স্পেনও যেমন গত বিশ্বকাপের ধাক্কা সামলে আবার এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকাপ জেতার লক্ষ্যে। আর্জেন্টাইনদেরও অনুসরণ করতে হবে সে একইরকম ব্লু-প্রিন্ট। দলের সিনিয়রদের অবসরে অবশ্য না চাইতেও সে পথেই হাঁটতে হত আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু এই ভুল রাস্তা ধরে হাঁটলে পথের দূরত্বটা কেবল বাড়বেই। শিরোপার সঙ্গে যেমন দূরত্বটা বেড়েছে আর্জেন্টাইনদের, ঠিক সেভাবেই। কোচের পরিবর্তনটা সবার আগে দরকার, সেটা নিয়ে বোধ হয় কারও সন্দেহ নেই। সাম্পাওলি ভালো কোচ, কিন্তু বড় অসময়ে দলের হাল ধরেছিলেন। সাম্পাওলি আর আর্জেন্টিনার ফুটবলের গল্পটা যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমনটা হয়নি। সময়টা তার ফুরিয়েই এসেছে। আর্জেন্টিনার মতো সবকিছু হারিয়েছেন তিনিও। আর্জেন্টিনার চাপ তিনিও নিতে পারেননি, এমন অগোছালো ফুটবল সাম্পাওলির কোনও দল আগে খেলেনি, হয়ত পরেও খেলবে না।

    আর্জেন্টাইনরা তাই ফিরে যাক রাস্তার ফুটবলে, যেখানে একদিন হেরে গেলে পরদিন দ্বিগুণ উৎসাহে জয়ের লক্ষ্যে নামা যায়। ইউরোপে আসার আগে আর্জেন্টাইনরা দুইবার ভাবুক, নিজেদের শহরের ক্লাবগুলোতে আরেকবার প্রমাণ করে আসুক নিজেকে। একেবারে গোড়া থেকে শুরু হোক আর্জেন্টিনার ফুটবলকে ভেঙে গড়ার প্রক্রিয়া। এমন একজনকে দলের দায়িত্ব দেওয়া হোক, যার একটা দর্শন আছে। যিনি একটা দলকে এক সুতোয় গাঁথতে পারেন। কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের ওপর ভরসা না করে দলের ওপর ভরসা করতে পারেন। ফুটবল ঈশ্বর বিশ্বকাপ জেতাবেন না আর। একজন মেসির কাছেও বিশ্বকাপ চাইতে হবে না আর। একটা দলের কাছ থেকে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখা শিখতে হবে আর্জেন্টাইনদের।    

    কাজানের মাঠ দিয়ে বেরুনোর সময় মেসি আর আর্জেন্টাইন সমর্থকদের নির্বাক চোখাচোখিও ইঙ্গিত দিল এসব কিছুরই। এবার বোধ হয় একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিতেই পারেন মেসি, তার সঙ্গে আর্জেন্টাইনরাও। এখন সবকিছু ভেঙে নতুন করে সাজানোর সময়।