• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    বড় ম্যাচ মানেই 'সুপার মারিও'

    বড় ম্যাচ মানেই 'সুপার মারিও'    



    দ্বিতীয় রাউন্ডের পর, কোয়ার্টার ফাইনালেও ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রোয়াট খেলোয়াড়েরা ক্লান্ত। তাদের মধ্যে মারিও মাঞ্জুকিচের ক্লান্তিটা বোধ হয় একটু বেশিই ভর করেছিল। এক প্রান্তে শুয়েই পড়েছিলেন একটা সময়। সেটা অবশ্য অল্প সময়ের জন্য, তার ক্লান্তিটা চোখ এড়াল না কারও। মাঞ্জুকিচ অবশ্য উঠেই দাঁড়িয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত চেষ্টাও চালিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ হাসিটাও বোধ হয় তাই তার দলেরই পাওনা হয়ে গিয়েছিল।

    সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ক্রোয়াশিয়া। নক আউট পর্বে আগের দুই ম্যাচেও প্রথমে পিছিয়ে পড়েছিল ক্রোয়েশিয়া, আজও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। কিন্তু প্রথম দুইবার ম্যাচে ফিরতে ৩ মিনিট আর ৮ মিনিট সময় লেগেছিল ক্রোয়াটদের। আজ একটু দেরিই হলো সেই অর্থে। রীতি ধরে রেখে সেই খেলাও অতিরিক্ত সময়ে গেল। কিন্তু সেটা আর টাইব্রেকার পর্যন্ত যেতে দিলেন না মাঞ্জুকিচ। 

    অতিরিক্ত সময়েই তার কাছে দারুণ একটা সুযোগ এসেছিল, গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ডের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে, কিন্তু সেই যুদ্ধে মাঞ্জুকিচের জেতা হয়নি। পিকফোর্ডের দারুণ সেভ আলো কেড়েছে সব। মাঞ্জুকিচ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্ট্রাইকার হিসেবে, গোল করাই ছিল তার কাজ। বায়ার্ন মিউনিখ, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ হয়ে জুভেন্টাসে যেতে যেতে পরিণত হয়েছেন উইঙ্গারে। গোল করার অভ্যাসেও তাতে মলিন হয়েছে খানিকটা। বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বের ম্যাচেও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সহজ সুযোগ নষ্ট করেছেন। জাত স্ট্রাইকার তকমাটা হারিয়েছেন অনেক আগেই।

     

     

    ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড ঈর্ষণীয়, রক্ষণও ভালো, কিন্তু গোলটা করবেন কে? ক্রোয়েশিয়া দলে যদি একটা সমস্যা থাকে, তাহলে এই অভাবটা যাবে তালিকার সবার ওপরে। যেটা ইংল্যান্ডের জন্য দারুণ সেভ, সেটা ক্রোয়েশিয়ার জন্য নষ্ট হওয়া সুযোগ। কিন্তু মাঞ্জুকিচকে আলাদা করে দোষ চাপানো যায় না, ক্লান্ত হয়ে গেলেও তাকে তুলে নেওয়ার মতো অভিলাষ দেখানো যায় না। বড় ম্যাচে বড় কিছু করার জন্যই তো জন্ম মাঞ্জুকিচের। আজ যেমন করলেন ১০৯ মিনিটে। ইংল্যান্ডের আক্রমণ ঝিমিয়েই পড়েছিলেন, ক্লান্তি ভর করেছিল মাঞ্জুকিচকেও। নিজের দিকে উড়ে আসা একটা হেড করেছিলেন ইভান পেরিসিচ, কাউকে লক্ষ্য করেও হেডটা করেননি। ডিবক্সের ভেতর ফেলবেন, এটুকুই জানতেন। মাঞ্জুকিচ অপেক্ষায় ছিলেন ক্ষুধার্ত সিংহের মতো, দুই ইংলিশ ডিফেন্ডার মার্ক করে রেখেছিল তাকে। ধূর্ত শেয়ালের মতো দুইজনকেই ফাঁকি দিয়ে দিলেন দৌড়। তার আগেই ঠিক করে রাখলেন, পাওয়া মাত্রই ওই বল করবেন শুট। যেভাবে পেলেন, সেভাবেই মারলেন, বাঁ পায়ে। এবার হয়ে গেলেন নিখুঁত শিল্পী। গোল! তাতেই ইতিহাস গড়া হয়ে গেল ক্রোয়েশিয়ার, বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম ফাইনালের আনন্দে মাতল ক্রোয়াটরা।

     

    বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যেখানে নাম্বার নাইনরা ধুঁকেছেন গোল পেতে, সেখানে ‘সাবেক’ এক নাম্বার নাইন বাকি সবাইকে ফেলে ক্লাউড নাইনে উঠে গেলেন। হ্যারি কেইন, রোমেলু লুকাকুদের কেউ সেমিফাইনলে গোলেই শট নিতে পারেনি- বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ দুই গোলদাতার তালিকায় ওপরের দুইটি নাম তাদের। অথচ ‘এককালের’ স্ট্রাইকার মাঞ্জুকিচই সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন। স্ট্রাইকারদের আসলে জন্মই তো এমন সব মুহুর্ত তৈরি করতে।

    মাঞ্জুকিচের অবশ্য বড় ম্যাচে গোল করাটা অভ্যাসই। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে এগিয়ে দেওয়ার প্রথম গোলটা ছিল তারই করা। ৪ বছর পর কার্ডিফের ফাইনালে চোখ ধাঁধানো এক গোল করে মাঞ্জুকিচই ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিলেন জুভেন্টাসকে। দুই চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে দুই দলের হয়ে গোল করা, আর বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় হয়ে গেছেন তিনি। দলের প্রয়োজনে নিজের স্ট্রাইকার সত্ত্বাকে হয়ত বিসর্জন দিয়েছেন খানিকটা, কিন্তু সময়মতো তিনি যে একজন জাত স্ট্রাইকার সেই প্রমাণ নিয়মিতই দিয়ে রেখেছেন সুপার মারিও।

    দ্বিতীয় রাউন্ডে ডেনমার্কের বিপক্ষে শুরুতেই পিছিয়ে পড়ার পর মাত্র দুই মিনিট পরই মাঞ্জুকিচই ফিরিয়ে এনেছিলেন দলকে, গোল করে। আজকের পর মাঞ্জুকিচের বিশ্বকাপ গোল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে, ৪। সামনে আছে কেবল ডেভর সুকার। বয়স হয়ে গেছে ৩২, এটাই শেষ বিশ্বকাপ হওয়ার কথা। জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাচটা খেলবেন ফ্রান্সের বিপক্ষে, লুঝনিকিতে। তার আগে ক্লান্তি দূর করার সময় অবশ্য পাচ্ছেন মাঞ্জুকিচ।   

    ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শেষেও মাঞ্জুকিচ শুয়ে পড়েছিলেন, সেটা আনন্দে। ক্লান্তি তখন ভুলে গেছেন। তার আগে ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে গেছেন স্বপ্নের ফাইনালে। যেখানে গোল করা তিনি অভ্যাসই বানিয়ে ফেলেছেন! সময়মতো স্বরূপে ফেরার জন্যই তো তিনি 'সুপার মারিও'।