পেলে হতে পারবেন এমবাপ্পে?
২৪ জুন, ১৯৫৮, সেমিফাইনাল। সুইডেনের রাসুন্দা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ব্রাজিল-ফ্রান্স। আগের দুই ম্যাচে আগমনী বার্তা দেওয়া পেলে যেন সেদিন নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন। চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্সে মন জয় করলেন সবার, করলেন হ্যাটট্রিকও। ৫-২ গোলে জিতে ফাইনালে উঠল সেলেসাওরা। ব্রাজিলের তো বটেই, ফ্রান্সের সমর্থকদের টুপি খোলা অভিবাদনও পেলেন পেলে। সর্বকালের সেরা হয়ে ব্রাজিলকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পথে সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ধাপ।
৩০ জুন, ২০১৮, দ্বিতীয় রাউন্ড। রাশিয়ার কাজানে মুখোমুখি ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা। কিলিয়ান এমবাপ্পে নামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ অভিজ্ঞ হাভিয়ের মাসচেরানোর নেতৃত্বে খেলা আর্জেন্টিনা রক্ষণভাগকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন একাই। এমবাপ্পের চিতাবাঘের মতো গতি কাছে হার মানলেন লিওনেল মেসিরা, জোড়া গোল করে বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, এবার কিছু করে দেখাতেই এসেছেন।
দুই ঘটনার সময়ের ব্যবধান ৬০ বছর। অথচ অদ্ভুত এক মিল আছে দুটিতেই। সুইডেন বিশ্বকাপে পেলে নামের এক তরুণের কাছে হেরেই বিদায় নিয়েছিল ফ্রান্স। রাশিয়া বিশ্বকাপে এক তরুণের কাঁধে ভর করেই শিরোপা থেকে একধাপ দূরে অবস্থান করছে ফরাসিরা। সেবার পেলে যা করে দেখিয়েছিলেন, এমবাপ্পেও কি ছুঁতে পারবে সেই কীর্তিকে?
****
দুজনের মাঝে সময়ের পার্থক্যটা কয়েক প্রজন্মের। অথচ পেলে ও এমবাপ্পের মাঝে কতই না মিল। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ যখন খেলতে আসেন, পেলের বয়স মাত্র ১৭। রাশিয়াতে খেলতে আসা এমবাপ্পে তার চেয়ে একটু বড়, বয়স এখন ১৯। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপজয়ী দিদিয়ের দেশমের দল যখন শিরোপা উল্লাস করছিল, এমবাপ্পে তখন এই পৃথিবীর আলোই দেখেননি! ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের পর জন্ম নেওয়া একমাত্র ফুটবলার হিসেবে এবার কোচ দেশমের দলের হয়েই বিশ্বকাপ মিশনে এসেছেন এমবাপ্পে।
বিশ্বকাপের আগেই ক্লাব ফুটবলে নিজেদের জাত চিনিয়েছেন পেলে-এমবাপ্পে দুজনই। সান্তোস কিংবা মোনাকো-পিএসজি; পেলে ও এমবাপ্পে আক্ষরিক অর্থেই যেন ‘বিস্ময়-বালক’। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮, দুই মৌসুমেই পেলে করেছিলেন অবিশ্বাস্য ১০৭ গোল! ক্লাবের হয়ে এত বয়সেই পেলের এমন পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েই মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তাকে ব্রাজিল বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নেওয়া হয় ভাভা, দিদি, গ্যারিঞ্চাদের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলার সাথে। অনেকেই ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, এই পুচকে ছেলেকে নিয়ে ব্রাজিল কী করবে! পেলে অবশ্য সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন মাঠেই।
ক্লাব ফুটবলে পেলের মতোই অল্প বয়সে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এমবাপ্পেও। মোনাকোর হয়ে তিন মৌসুমে করেছেন ১৬ গোল। পিএসজির হয়ে প্রথম মৌসুমেই করেছেন ২৭ ম্যাচে ১৩ গোল, জিতেছেন ট্রেবলও। নেইমার-কাভানির সাথে মিলে গড়ে তুলেছেন ভয়ংকর এক আক্রমণ ত্রয়ী। পেলের মতো অবশ্য দলে এসে খুব একটা কথা শুনতে হয়নি। কারণ ২০১৬ সালের যুব বিশ্বকাপে ১৭ বছর বয়সেই ফ্রান্সের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করে শিরোপা জিতেছিলেন। ৫ ম্যাচে করেছিলেন ৫ গোল, যার মাঝে ছিল সেমিফাইনালে করা জোড়া গোলও। বয়স মাত্র ১৯ হলেও ফ্রান্সের বিশ্বকাপ দলের অন্যতম বড় ভরসা যে এমবাপ্পে, সেটা শুরু থেকেই স্বীকার করেছেন দেশমসহ সবাই। এখন পর্যন্ত ৩ গোল করে সেই আস্থার প্রতি সুবিচারও করেছেন, গোল্ডেন বলের দৌড়েও এগিয়ে আছেন।
****
নিজের প্রথম বিশ্বকাপের শুরুতে খুব একটা ঝলক দেখাতে পারেনি পেলে, দুই ম্যাচে তো ইনজুরির কারণে মাঠেই নামতে পারেননি। ইনজুরি থেকে ফিরে সময়ের সাথে হয়ে উঠেছেন ভয়ংকর, তাকে সামলাতেই হিমশিম খেয়েছে প্রতিপক্ষের অভিজ্ঞ রক্ষণভাগ।
পেলের মতো এমবাপ্পের শুরুটাও খুব আহামরি ছিল না। গ্রুপ পর্বে পেরুর বিপক্ষে গোল পেয়েছিলেন। কিন্তু এমবাপ্পে কতটা ভয়ানক হতে পারেন, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম থেকেই বারবার ঢুকে পরছিলেন রক্ষণভাগ চিড়ে। তাকে আটকাতে না পেরে তো ফাউল করে পেনাল্টিই হজম করেছে আর্জেন্টাইনরা। আর্জেন্টিনার জালে জড়ানো ৪ গোলের দুটিই এসেছে তার পা থেকে। মেসি-মাসচেরানো ও আর্জেন্টিনা সমর্থকরা দেখেছেন ‘এমবাপ্পে ম্যাজিক।’
১৯৫৮ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ১৭ বছর বয়সী পেলে। পেলের পর বিশ্বকাপে জোড়া গোল করা সবচেয়ে কম বয়সী ফুটবল এখন এমবাপ্পেই।
****
৬০ বছর আগে ভাগ্যক্রমেই ১০ নম্বর জার্সিটা পেয়েছিলেন পেলে। এরপর যা হয়েছে, সেটা ইতিহাস। নিজে ইতিহাস গড়েছেন, পেলের কল্যাণে ১০ নম্বর জার্সিও বনে গেছে বিশেষ কিছু। এমবাপ্পেও নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছেন সেই ১০ নম্বর জার্সি পরেই। সেই ১০ নম্বর জার্সি, যেটা পরে অভিষেক হয়েছিল ম্যারাডোনার, মেসির। পেলে ছাড়া তাদের কেউই এত কম বয়সে বিশ্বকাপে এতোটা আলো ছড়াতে পারেননি।
তরুণ বয়সেই ক্লাব মাতিয়ে জাতীয় দলে ঢোকা, প্রথম বিশ্বকাপ, ১০ নম্বর জার্সি, সময় গড়ানোর সাথে সাথে নিজেকে মেলে ধরা; এমবাপ্পের সবই তো মিলে গেছে পেলের সাথেই। লুঝনিকির ফাইনালটাও কি মিলবে ৬০ বছর আগের স্টকহোমের সাথে?