• ইংল্যান্ড-ভারত সিরিজ
  • " />

     

    একদিন এজবাস্টনে কোহলির দিন

    একদিন এজবাস্টনে কোহলির দিন    

     

    আণুবিক্ষণীক অথবা তারও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগত। অণু-পরমাণু, ইলেকট্রন-নিউক্লিয়াস। ইলেকট্রনকে সাধারণত কণা বলা হয়, কারণ তারা কণার মতো ভর বহন করে, চার্জ ধারণ করে। মডার্ন ফিজিক্সে ছুটন্ত ইলেকট্রনকে আবার তরঙ্গ বললেও ভুল হবে না, কারণ তাদের আচার-আচরণ তখনই সেরকমই। একই কথা কোনও তরঙ্গ, যেমন তাড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের ক্ষেত্রেও। তাদেরও দ্বৈত সত্তা আছে- কখনও কণার, কখনও তরঙ্গের। 

    ক্রিকেট জগত। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং। রান, উইকেট, ক্যাচ। ব্যক্তিগত উৎকর্ষ, দক্ষতা। ক্ষমতা। এরপর আবার ‘ভাগ্য’। কখনও প্রথমগুলো ছাপিয়ে যায় সর্বশেষটিকে। কখনও আবার সর্বশেষটি বড় হয়ে ওঠে, প্রথমগুলিকে ছাপিয়ে। আবার কখনও দ্বৈত সত্তা। দুইয়ে মিলে মাস্টারক্লাস! 

    বিরাট কোহলির ইনিংসটি যেমন। ইংলিশ সিমিং-সুইংয়ে ভরা কন্ডিশন। সামনে জেমস অ্যান্ডারসন। কোহলিকে সেই কবে থেকে তাড়া করছে এসব। এদিনও করলো, ভালভাবেই। কোহলি ভুগলেন। ধুঁকলেন। লড়াই চালিয়ে গেলেন। এরপর জয় করলেন সব। ক্যারিয়ারে এক ইনিংসে এতো বেশি আলগা বা ফলস শট কোহলি এর আগে খেলেননি (২২টি)। তবুও কোহলি এই এক ইনিংসেই ছাড়িয়ে গেলেন গত ইংল্যান্ড সফরের সব ইনিংসের মোট রানকে। চাইলে আপনি যে কোনো একটি ধরতে পারেন। চাইলে ধরতে পারেন দুটিকেই। 

    শুধু একটি জিনিস বদলাবে না। কোহলির এ ইনিংস ঐতিহাসিক। কোহলির এ ইনিংস অনন্য। কোহলির এ ইনিংসটি বিশেষ কিছু। 

    এজবাস্টনের দ্বিতীয় দিনটি ভারতের টপ অর্ডারে স্টিম রোলার চালানো স্যাম কারানের না। ভারতের মিডল অর্ডারে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া বেন স্টোকসের না। ভারত অধিনায়ককে নাস্তানাবুদ করে ছাড়া অ্যান্ডারসনের না। এ দিনটি ভারত অধিনায়কের। বিরাট কোহলির। 


    ****


    কোহলি হাসছিলেন। হয়তো আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে। হয়তো বেন স্টোকসের দিকে তাকিয়ে। খানিক আগেই ইশান্ত শর্মা এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেছেন, একরাশ হতাশা নিয়ে। শেষ ব্যাটসম্যান উমেশ যাদবের জন্য ওভারে দুইটি বল রেখে ফিরেছেন ইশান্ত, চাইলে রিভিউ নিয়ে বাঁচতে পারতেন, নিলেনই না! এজবাস্টনে এদিনটা আম্পায়ারদের জন্যও অদ্ভুত গেছে। বলের সিম-সুইং-স্পিন ঠাউর করে উঠতে পারেননি তারাও, কোহলি যেটা পেরেছেন! 

    ইশান্তের আউটের সময় কোহলির রান ৯৭। উমেশ সে দুটি বল খেলে দিতে না পারলে কোহলি আটকে যাবেন সেখানেই! 

    পরের ওভারে স্ট্রাইক পেয়েছেন, চারটি বল ডট, এর মধ্যে শেষেরটির পর কোহলির ওই হাসি। অফস্টাম্পের অনেক বাইরে, একদম রিটার্ন ক্রিজ ঘেঁষা ফুললেংথের বল। তাড়া করেও নাগাল পেলেন না কোহলি। সেই হাসিতে যেন বুঝাতে চাইলেন, তার সমস্যা তো অফস্টাম্পের এতোটা বাইরে না! ফিফথ, সিক্সথ, বা সেভেনথ স্টাম্পে! এতো বাইরে করে কী লাভ! 

    কোহলি ততক্ষণের নিজের ইনিংসের সেই ধাপে চলে গেছেন। যে ধাপে তিনি হাসবেন। যে ধাপে তিনি জানবেন, তার অনেক কিছু জয় করা হয়ে গেছে। অনেক কিছুই তখন তার নিয়ন্ত্রণে। 


    **** 


    ভারতের আগের ইংল্যান্ড সফরে নাকি মজা করে বলা হতো, ভারতের দ্বিতীয় উইকেটটা পড়লে জেমস অ্যান্ডারসন ওয়ার্ম-আপ শুরু করে দিতেন, তা তিনি মাঠের যেখানেই থাকুন না কেন। কোহলিকে অফস্টাম্পের বাইরে বল করবেন এরপরের ওভারে এসে, কোহলি খোঁচা দেবেন, ড্রেসিংরুমে ফিরে যাবেন। ব্যাপার ছিল এমনই। 

    সেই কোহলি ইংল্যান্ডের ভারত সফরে অ্যান্ডারসনের বলে পরাস্ত হলেন মাত্র তিনবার। মাত্র তিনবার ব্যাটে ঠিকঠাক লাগাতে পারলেন না অ্যান্ডারসনের বল। তবে ভারতের মাটিতে কোহলির দূর্বলতার তিনটি মাপকাঠি সমীকরণেই ছিল না। সিম। সুইং। ডিউক বল। 

    এ সিরিজের আগে থেকেও অ্যান্ডারসন বনাম কোহলি লড়াই নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। টেকনিকে সাম্প্রতিক সময়ে তার পরিবর্তনগুলো যেন এমন কন্ডিশন ঘিরেই। ক্রিজের বাইরে ব্যাটিং করেছেন, সুইংয়ের বিরুদ্ধে নিজেকে আরও প্রস্তুত করেছেন। তবুও সেই অ্যান্ডারসনের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রথম অধ্যায়ে কোহলি মুখোমুখি হওয়া ডেলিভারির শতকরা ১১ শতাংশ এজড হয়েছেন, ক্রিকভিজের ডাটা অনুযায়ী। ৮৭ শতাংশ বল ডট দিয়েছেন। একবার নিশ্চিতই আউট হতে পারতেন, স্লিপে মালান ‘লোপ্পা’ ক্যাচটা না ফেললে। বারকয়েক এজ গিয়ে পড়েছে স্লিপ বা গালির আগে। অ্যান্ডারসন কোহলিকে ছাড় দেননি একচুল। তবে কোহলি সেই ছাড়টা নিজের অধিকার হিসেবে নিয়েছেন। 

     


    কোহলির ইংল্যান্ডে প্রথম লড়াই জয়!

     

    টেকনিকে কোহলির আরেকটি পরিবর্তন হলো, অফসাইডে বেশি বেশি খেলা। ক্রিকভিজের পরিসংখ্যান বলে, ২০১৪ সালের সেই সফরের পর থেকে অফসাইডে কোহলির রান-স্কোরিংয়ের শতাংশ ধীরে ধীরে বেড়েছে। ফিফটির সময় কোহলি ৬৯ শতাংশ রান করেছেন অফসাইডেই। আর কোনও সেঞ্চুরিতেও এদিকে এতো স্কোরিং শট কখনও খেলেননি কোহলি। ইংলিশ বোলাররা অফস্টাম্প তাক করেই সুইং ছুড়ছিলেন। তবে কোহলি নিজেকে আড়াআড়ি খেলা থেকে দমিয়ে রেখেছেন। সুইংয়ের বিরুদ্ধে তার লড়াইটা ছিল অপেক্ষার। লড়াই ছিল প্যাডের ওপর, কোমর বা বুকের ওপর বল পাওয়ার অপেক্ষার। 

    ফিফটির সময় তার আক্রমণাত্মক শট ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। আর কোনও ফিফটিতে এতোটা রক্ষণশীল ছিলেন না কোহলি। তার যে কোনো সময় আউট হওয়ার কথা ছিল। আলগা শট, এমন কন্ডিশনে এমন রক্ষণাত্মক মানসিকতা বলছিল সেটাই। 

    কোহলি হননি। বরং হয়েছে উল্টোটা। ঘুমন্ত দানবের মতো করে জেগে উঠেছেন কোহলি। শেষ হওয়ার আগে শেষ করেছেন ইংলিশ বোলিং। 


    **** 


    ইংলিশ বোলারদের ধারাবাহিকতায় কোহলি ধৈর্য্যচূত হননি। ইংলিশদের পিচ্ছিল ফিল্ডিং কোহলির দানব সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছে, ধীরে ধীরে। 

    রবি আশ্বিনের উইকেটের পরই যেন চূড়ান্তভাবে জেগে উঠেছেন তিনি। 

    ৭ম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন আশ্বিন। এরপর কোহলিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ছিলেন শুধু নয়-দশ-গোলাম। পুরোদস্তুর ব্যাটিংয়ের লেজ। কোহলির তখন ‘সবকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার’ সময়। এসপার-ওসপার দেখার সময়। 

    আশ্বিনের উইকেটের আগে কোহলির আক্রমণাত্মক শট ছিল ৮ শতাংশ। এরপর সেটা বেড়ে হলো ৪৯ শতাংশ। এরপর ১১৬ বলে কোহলি করলেন ৯২ রান, যখন শেষ তিন উইকেটে ১১৫ রান করেছে ভারত।

    কোহলি ২১ রানে আউট হতে পারতেন। কোহলি ৫২ রানে আউট হতে পারতেন। কোহলি রান-আউটের সুযোগও দিয়েছিলেন। কোহলি আউট হননি, ১৪৯ রান করার আগে। ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম ও ক্যারিয়ারে ২২তম সেঞ্চুরি ছাপিয়ে আরও অনেকদূর যাওয়ার আগে ছেড়ে দেননি কোহলি। লড়াই চালিয়ে গেছেন, সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন। করেছেন ড্রাইভ, ফ্লিক, পুল। 

    ভাগ্যকে পাশে পেয়েছিলেন তিনি। অথবা বলা যায়, ভাগ্যকে জয় করেছিলেন তিনি। 


    ****

     

    কোহলির উদযাপন এমনই। নিতে পারলে খুব প্যাশনেট ক্রিকেটার মনে হবে তাকে। না নিতে পারলে আপনি অস্বস্তিতে ভুগবেন। বেন স্টোকসকে চার মেরে সেঞ্চুরি পূরণের পর তেমন উদযাপনই করলেন। বুনো উল্লাস, ক্ষিপ্র মনোভাব। শার্টের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লকেট জাতীয় কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছিলেন। প্রথম দফায় হলো না, একটু হাসি দিলেন। এরপর বের করে চুমু খেলেন। চেইনে বাঁধা বিয়ের আংটি। হয়তো কোহলির সৌভাগ্যের প্রতীক সেটা। 

    যে এজবাস্টন তাকে দুয়ো দিয়েছিল শুরুতে, সেই এজবাস্টন অভিবাদন জানালো। যেন চ্যাম্পিয়নস লিগে সেই অসাধারণ বাইসাইকেল কিকে গোল করার পর জুভেন্টাসের কাছ থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পাওয়া করতালির মতো।

    কোহলির ইনিংসে এদিন দ্বৈত সত্তা ছিল। কোহলির পাশে এদিন ভাগ্য ছিল। অথবা কোহলি ভাগ্যকে জয় করেছিলেন। 

    কোহলি একজন 'স্পেশাল' ব্যাটসম্যান। এজবাস্টনে কোহলির ইনিংসটি এদিন ছিল 'স্পেশাল'। এজবাস্টনে এ দিনটি ছিল কোহলির।