• ক্রিকেট

বাবলি আর তেন্ডুলকার

পোস্টটি ৪২০৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

দরজাটা যে বাইরে থেকে আটকানো, বাবলি প্রথমে বুঝতে পারে নি সেটা। চারবারের চেষ্টায়ও যখন সেটা টেনে খোলা গেলো না, হঠাৎ করেই তখন বাবলি কীভাবে যেন জেনে যায়-ওটা আর খুলবে না সহসা। বাবলি তখন সত্যিই ভয় পেয়ে গেলো।

স্কুল ছুটির পর বাবলিকে বাসায় দিয়েই কোথায় যেন চলে গেছে ছোট মামা, আর মা সকালে অফিসে যাবার আগে নাস্তার টেবিলেই বলে গেছে থেকে আজ ফিরতে দেরি হবে তার। বাসায় আজ বাবলির সাথে ছিলো কেবল আমেনা বুয়া। স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাবলি যখন বিছানায় গেছে, অন্ততঃ তখন পর্যন্ত আমেনা বুয়া কিচেনেই কাজ করছিলো- বাবলি দেখেছে। ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকেই বুয়াকে খানিক ডাকাডাকি করেছে বাবলি, এরপরেও কোনো সাড়া না পেয়ে সে গেছে কিচেনে। কিন্তু সেখানেও নেই বুয়া। কিচেন তো কিচেন, পুরো বাসাতেই কোথাও আমেনা বুয়াকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। আর এখন বারান্দায় এসে বাবলি দেখছে, দরজাও বাইরে থেকে আটকানো।

বাবলি এক ছুটে ভেতরে চলে গেলো আবারো। বাসার মোবাইল ফোনটা থাকে টিভির পাশে। বাবলি সেটাকে হাতে নিয়েই মায়ের নাম্বারে ফোন করে। আর ফোন কানে ঠেকিয়েই আরেকটা ধাক্কা খায় বাবলি, মসৃণ নারী কণ্ঠ সেখানে বলে যায় বাংলা আর ইংরেজিতে- ব্যালেন্স নেই এই ফোনে। বাবলির আবছা আবছা মনে পড়ে, গতকালই ছোট মামা মনে হয় রাতের খাবার টেবিলে বলছিলো যে ফোনে টাকা ভরতে হবে।

ধীর পায়ে বাবলি আবার আসে বারান্দায়। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে আবার দরজার পাল্লা ধরে টানে, মনে মনে একটা অসম্ভব আশা তার- যদি কোনোভাবে খুলে যায় দরজা! কিন্তু দরজা খোলে না। বাইরে থেকে সেটা বোধ হয় তালা দেওয়া। সে এবার ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না চাপতে। বাবলি আসলে কেঁদেই ফেলতো, কিন্তু মামার কাছে গত জন্মদিনেই সে প্রমিজ করেছে- ক্লাস ফাইভে ওঠার পরে আর কান্না করবে না। প্রমিজ ভেঙে ফেলা খুব লজ্জার কাজ, বাবলি জানে। আর এতো বড় হয়ে যাবার কেউ কান্না করলে তো সেটা আরো লজ্জার!

ঠোঁট কামড়ে ধরেই বাবলি ভেবে দেখার চেষ্টা করে, এখন কী করবে সে। মা অফিসে, ছোট মামা বাইরে, আমেনা বুয়া হারিয়ে গেছে- কী করার আছে এখন তার? ... হুট করে আরেকটা কথা মনে পড়তেই বাবলির পেটের ভেতরে একটা কেমন ভয়ের ঢেউ উঠলো এসময়। আচ্ছা, ঐ লোকটা কি এখনো বাসার বাইরে দাঁড়ানো? চোখ রাখছে ওদের বাসার ওপর?

সপ্তাহখানেক আগে ছোট মামাই প্রথমে খেয়াল করেছিলো লোকটাকে। তারপর এক দুপুরে বাবলিকে বেডরুমের জানালা থেকে আঙুল দেখিয়ে মামা বলেছিলো, ‘বাবলি, ওই লোকটাকে দেখছিস তুই আগে? ... দেখিস নাই, না? আমি খেয়াল করসি, গত তিনদিন ধরে লোকটা ওই গাছের তলায় দাঁড়ায়ে সিগারেট খায় আর আমাদের বাসার দিকে চোখ রাখে।’

মামা নিজেই এরপর মা’কে বলেছিলো লোকটার কথা, ‘একটু সাবধানে থাকিস তো আপা- আজকাল যা হচ্ছে! ডাকাত, কিডন্যাপার- অনেক কিছুই তো হইতে পারে। তুই একটু সাবধানে অফিস যাইস। আর বাবলি, বি কেয়ারফুল। একদম সাবধান। ভুলেও অপরিচিত কেউ রাস্তা থেকে ডাক দিলে বাইরে যাবি না!’

... ঘটনাগুলো মনে পড়তেই বাবলির মাথায় চিন্তাটা আরেকটু ভারি হয়ে যায়। আলগোছে একবার বাইরে চোখ ফেলে সে সতর্ক হয়ে। আর চমকে ওঠে।

আছে, লোকটা আছে! গত এক সপ্তায় প্রায়ই ছোট মামার দেখানো জায়গাটায় জানালা দিয়ে চোখ রেখেছে বাবলি, এর মাঝে চারদিন সে দেখতে পেয়েছে লোকটা ওদের বাসার দিকেই থাকে। চোখে চোখ পড়লে লোকটা সরে যায়। কিন্তু আজকে লোকটা এমন কী নিজেকে লুকানোর চেষ্টাও করলো না। সরাসরি বাবলির দিকে তাকিয়ে থাকলো। খানিক পর সিগারেট নিভিয়ে ফেলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন দিলো লোকটা।

বাবলি কাঁপতে কাঁপতে রেলিং ছেড়ে পিছিয়ে এলো কয়েক পা। ওদের দোতলা বাড়িটার সামনেই একটা ছোট মাঠ, তার ওপারে একটা ছোট্ট চা-বিস্কুটের টং দোকান, দোকানের সামান্য পশ্চিমে একটা ছাতিম গাছতলায় দাঁড়িয়েই লোকটা ওদের বাসায় নজর রাখে। বাবলিদের ভাড়া বাড়ির পেছনে একটা ডোবা, বাকি দুই দিক ফাঁকা- টঙ্গীর এই ভেতরের দিকে এখনো বড় বড় বিল্ডিং উঠে যায় নি। একতলায় থাকেন বাড়িওয়ালা আঙ্কেল, তার ছেলে মিশুকের সাথে বাবলির খুব ভাব। কিন্তু মিশুকের নানুমণির অসুখ বলে গত কয়েকদিন হলো ওরা সবাই খুলনা গেছে, একতলা তাই ফাঁকা। বাবলির দুই চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছে, আজকে তো সে একদম একা! দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে মাটিতে বসে সে ভাবে, ওই ছেলেধরাটা এখন তাকে ধরতে এলে সে নিজেকে বাঁচাবে কীভাবে? মরে যাবে, বাবলি নিশ্চিত মরে যাবে আজ!

দুম করে আবারো ছোট মামার কথা মনে পড়ে বাবলির। মনে পড়ে, খেলা দেখতে দেখতে মামা কণ্ঠে মুগ্ধতা নিয়ে বলেছিলো, ‘একটুর জন্যে বারবার বেঁচে গিয়েও লোকটা কী রকম ক্লাস চিনালো, দেখলি?’

বাবলির ছোট মামা ক্রিকেটের দারুণ ভক্ত। স্কুল থেকে ফিরে এসে অনেকবার বিকাল আর সন্ধ্যা বাবলি তার মামার সাথে ক্রিকেট দেখে কাটিয়েছে। একদিকে বাবলি হয়তো হোমওয়ার্ক করছে, আর মামা তাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেবার ফাঁকে ফাঁকে চাপা চিৎকার দিয়ে বলেছে, ‘শ-অ-ট! সাঙ্গাকারার ড্রাইভটা দেখলি বাবলি! ক্লাস, ক্লাস- এটাকে বলে ক্লাস! এই টি-টোয়েন্টি খেলা ধাওয়ান আর গেইলরা পারবে কোনোদিন এরকম, বলতো?...’।  অন্যদিন হয়তো মামা প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে শুয়ে আছে টিভির সামনে, হাতে তালি দিয়ে বাবলিই চেঁচিয়ে উঠেছে তখন সাকিবের আর্মার দেখে, ‘আউট! এবার তো বাংলাদেশ জিতে যাবে, তাই না মামা?’

সেই বাবলি এই মুহুর্তে মামার কথা মনে করে চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড ভাবে কী হয়েছিলো সেদিন, কাটা কাটা ছবির মতো তার মাথায় আসে জ্যাক ক্যালিসের সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সাড়ে তিনশো পার করেছে, দ্বিতীয় দিন শেষে শচীন তেন্ডুলকার অপরাজিত ঊনপঞ্চাশ রানে। এক জমাট টেস্ট লড়াইয়ের মঞ্চ প্রস্তুত পরের তিন দিনের জন্যে।

বাবলি চোখ খুলে এবার, কামড়ে ধরা ঠোঁটটা কখন যেন ছেড়ে দিয়েছে সে- এবার সে উঠে দাঁড়ায় কিছু একটা সংকল্প নিয়ে।

শচীনের সেরা ইনিংস? অনেকের মতেই তাই, তেন্ডুলকারের নিজের কাছেও ওই ইনিংস বিশেষ কিছু- পত্রিকায় খেলার খবর গিলে খাওয়া বাবলি পড়েছে এটা কোনো একটা সাক্ষাৎকারে। দুনিয়ার সেরা ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইন, সেও স্বীকার করে নিজের সেরা ফর্মে ওইদিন বল করেছিলো সে, আর তৃতীয় দিনে দুই স্পেলের সেই অবিশ্বাস্য এগারো ওভারে স্টেইন গুড লেংথ ছাড়া একটাও হাফভলি কী ফুল পিচ ডেলিভারি করেনি।

দ্রুত পায়ে ভেতরে গিয়ে বাবলি সবগুলো ঘরের বাতি জ্বালিয়ে আসে। দুটো বাথরুমের দরজায়ই ছিটকিনি দেয় সে। এরপর প্রায় পনেরো মিনিট ধরে সে জানালাগুলো আটকায় বসার ঘর আর বেডরুমগুলোর। সবচেয়ে পূর্বদিকের জানালাটার পাল্লা নড়বড়ে অনেকদিন ধরে, মামার যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে খানিক নাইলনের দড়ি বের করে সেটাকে বেঁধে দেয় বাবলি, যত শক্ত করে পারে। এরপর সে আবারো বেরিয়ে আসে বারান্দায়, সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা আঁধারের মাঝে বাবলি দ্রুত জ্বালিয়ে দেয় বারান্দার ফ্লুরোসেন্ট বাতিটা।

আর সে অপেক্ষা করে। তখন তেন্ডুলকার, বাবলির মাথার ভেতরে ফিসফিসিয়ে নিজের ইন্টারভিউতে বলে যায়, ‘মাঝেমাঝে আসলে মাঠে সবকিছু ঠিকঠাক চলে না। সেসব ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানকে বের করতে হয় কোনো নতুন কিছু। অপ্রত্যাশিত কিছু করেই একমাত্র বোলারের লাইন-লেংথ নষ্ট করা যায়। ... স্টেইন সেদিন যে রকম বল করছিলো, একটু সচেতনভাবেই আমি লেগস্টাম্পের দিকে এক হাত সরে গিয়ে স্টান্স নিয়েছিলাম। ওরকম সুইং করতে থাকা বলের সামনে আমার আসলে অন্য কোনো উপায় ছিলো না!’

বাবলি তাই খারাপ কিছুর জন্যেই প্রস্তুত থাকে। চারপাশে এখন বেশ অন্ধকার, সন্ধ্যার আজানের শব্দ মিলিয়ে গেছে, সামনের মাঠের ওপারে টং দোকানটা অস্পষ্ট- সেটার কেবল অবয়বটা বোঝা যায় দোকানের ভেতরের হ্যাজাক বাতির আলোয়। ব্যালেন্সহীন মোবাইল ফোনটা বাবলি এখন ব্যবহার করছে ঘড়ি হিসেবে, সেটা হাতে নিয়ে দরজার উপরে নিচে দুটো ছিটকিনি আটকে দিয়ে মাঠের দিকে চেয়ে স্টান্স নেয় বাবলি। সুযোগ দেয়া যাবে না কিছুতেই।

আর সন্ধ্যার মুখে দিনের খেলা শেষ হবার আগের দশটা মিনিট যেমন বাড়তি সতর্ক থাকে ব্যাটসম্যানেরা, বাবলিকে এবার হয়ে উঠতে হয় সেরকম সাবধান। কারণ সে দেখতে পায় ছাতিম গাছটার তলা থেকে একটা অবয়ব হঠাৎ হাঁটা শুরু করেছে তার বাসার দিকে।

বাবলি নিজেকে যথাসম্ভব গোপন রেখে চোখজোড়া সেঁটে দেয় বারান্দার গরাদের পেছনে আর অবয়বটা ধীরে ধীরে আকার পায় ওই লোকটার। বাবলি খানিক এলোমেলো হয়ে পড়ে এবার। সত্যিই লোকটা যদি তার বাসায় ঢুকে পড়তে চায়, তাহলে কী করবার আছে তার? এতোদিন টিনটিন আর তিন গোয়েন্দার বই পড়তে পড়তে সবার মতোই বাবলি অনেকবার ভেবে ফেলেছে ডাকাত সর্দার আব্রাহাম অথবা রাস্তাপপুলসের মতো ভিলেন কেউ তাকে আটকাতে চাইলে কীভাবে বুদ্ধির জোরে বোকা বানাবে তাদের- কিন্তু এখন, সমস্যা যখন ছাতিম গাছটার মতোই বাস্তব, তখন কি করতে হবে, সেটা বাবলির মাথায় আসে না ঠিকমত।

লোকটা এদিকে ধীর অথচ নিশ্চিত পায়ে এগোতে থাকে বাবলিদের বাসার দিকে, মাঝে মাঝে থেমে পড়ে চারিদিকে তাকাবার ছলে দেখে নেয় কেউ আছে কি না, তারপর আবার হাঁটে। মোমেনাবাদ হাউজিং এর বাইরের মাঠ সংলগ্ন দোতলা বাড়ির বারান্দায় তখন বাবলি যেন ব্যাট সরাতে চায় একের পর এক ডেলিভারিতে, নিউল্যান্ডসের মাঠে তেন্ডুলকার যেমন ক্যারিয়ারে মনোযোগের তীব্রতম পরীক্ষায় পরখ করে ডেল স্টেইনের হাত থেকে ছুটে আসা গোখরোর মতো বিষাক্ত সুইং। বাবলি পরাস্ত হয় বারবার, অফ আর মিডল স্টাম্পের লাইনে পিচ করে বল বেরিয়ে যেতে থাকে তার বুক সমান উচ্চতায়- বাবলি তখন বুক ধুকপুক করে আবার চেষ্টা করে করণীয় ঠিক করতে। আর একসময় ডেল স্টেইন ঠিকঠাক খুঁজে পায় শচীনের ব্যাটের কানা।

নিচতলার কলাপসিবল গেটটার ভেজানো দরজাটা খুলে লোকটা উঠে আসে বাবলিদের দোতলার বাসার ল্যান্ডিং-এ। দরজায় সজোরে ধাক্কা প্রথমে, এরপরে কলিং বেল। ‘দরজা খুলেন! কে আছেন, দরজাটা একটু খুলেন!’

ভারী গলাটা শুনবার পরেও বাবলি প্রায় মিনিট খানেক অপেক্ষা করে। লোকটাকে বোঝাতে চায়, সে বাসার ভেতর থেকেই এসেছে শব্দ শুনে- বারান্দাতে কান পেতে অপেক্ষা সে করছিলো না। আগন্তুক কিন্তু বিশ্রাম নেয় না এই অবসরে, সে কলিং বেলে চাপ দেয় আরো দুবার।

‘কে? কাকে চাচ্ছেন?’, বাবলি চেষ্টা করে গলাটাতে নির্ভীক একটা ভাব আনতে।

‘আমার নাম আনিস। বাবলি নাকি?... দরজাটা একটু খোলোতো বাবলি, তোমার সাথেই কথা বলতে আসছি।’ লোকটা বলে।

তেন্ডুলকারের মতোই পা’টা কোথায় যেন আটকে যায় বাবলির, বেরিয়ে যেতে থাকা বলে হালকা খোঁচাও লেগে যায় যেন। আনিস? আনিস নামের কাউকে তো সে চেনে না! ‘বাসায় তো এখন কেউ নাই, আপনি পরে আসেন।’

‘বাসায় কেউ না থাকলে সমস্যা নাই, তুমি তো আছো! দরজাটা খোলো বাবলি, কথা আছে তোমার সাথে!’ লোকটা বলে।

‘কেউ নাই বাসায়’, বাবলি আবার বলে, অনাবশ্যক জোর দিয়ে। ‘আপনি পরে আসেন!’

‘দরজা খোলো বাবলি। দরজা খোলো!’ লোকটা যেন পাত্তাই দেয় না বাবলিকে। দরজায় সে টোকা দিতেই থাকে বারবার।

আর বাবলি তখন দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করে যায় একসময় দরজা ধাক্কানোর শব্দটা থেমে যাবে বলে। সে অপেক্ষা করে, পিঠ তার ঠেকানো থাকে দরজার, চোখের দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে বারান্দা আর মাঠের মাঝে। তৃতীয় দিন সকালের ডেল স্টেইন আর মরনে মরকেলের দুর্দান্ত বোলিং যেমন ছাপ্পান্ন মিনিট ধরে প্রান্ত বদল করতে দেয়নি শচীন তেন্ডুলকার ও গৌতম গম্ভীরকে, তেমনি একের পর এক জোরালো দরজায় আঘাত বাবলিকে নিশ্চল বসিয়ে রাখে ওই পিঠ ঠেকানো ভঙ্গিমাতেই।

তারপর থেমে যায় আওয়াজ। পদশব্দ ধীরে ধীরে দূরে সরে যায় যেন, বাবলি দরজার সাথে কান ঠেকিয়ে বুঝতে চায়। লোকটা বোধহয় মোবাইলে কাউকে জানায় যে সে আবার আসবে, দরজা খোলে নি। বাবলির মনে পড়ে, স্টেইনের ভেতরে ঢোকা বল তেন্ডুলকারের ব্যাটের ইনসাইড এজ ছুঁয়ে ফাইন লেগ দিয়ে চলে যায় সীমানার বাইরে। লাইফ!

ঘড়িতে বাজছে সাত, বাবলি দেখে নেয় একপলক। যেদিন দেরি হয়, সেদিন ফিরতে ফিরতে মায়ের আটটা পর্যন্ত বেজে যায়। তারমানে আরো এক ঘন্টা, কমপক্ষে! ছোটমামাও যে কোথায় গেলো আজকে ...

কয়েক মিনিট আক্ষেপের পরে, নিজেকে সামলাতেই, সে মন স্থির করে নেয়। কাজ ছাড়া এভাবে অপেক্ষা করতে থাকলে সময়টা মোটেই কাটবে না, বাবলি ভাবে। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা না করে সে সন্ধ্যার নাস্তাটা খেয়ে নিলেই পারে। ক্ষতি তো আর নেই কোনো, কিছু সময় তো পার হবে!

এইসব ভেবেই বাবলি ফ্রিজের দিকে চলে যায়। এক কান খাড়া করে রেখেই ফ্রিজ থেকে পাউরুটি বের করে সে। চুলা ধরানোটা কঠিন কিছু নয় মোটেই, সেটা বাবলি প্রতিদিনই করে দুয়েকবার। পাউরুটি সেঁকাটাও সহজেই হয়ে যায়। মিনিট দশেক পরেই বাবলিকে তাই দেখা যায় পাউরুটির টোস্ট আর একগ্লাস গরম ওভালটিন নিয়ে ধীরপায়ে বারান্দার দিকে যেতে। বিগত ঘন্টার অসহ্য চাপ থেকে খাবার তৈরির অবসরে খানিক মুক্তি পেয়ে বাবলির নিজেকে বেশ সতেজ লাগে। ভেজানো পাউরুটি মুখে দিয়ে দ্রুত চিবোতে চিবোতে বাবলি আবার একবার নজর দেয় বারান্দার গরাদের ওধারে। আছে, লোকটা এখনো আছে। তার সাদা লাল ডোরাকাটা শার্টটা এতো দূর থেকেও চিনতে অসুবিধা হয় না বাবলির।

খাওয়া শেষ করে রান্নাঘরেই প্লেটটা রেখে আসে বাবলি, ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খায় সেখানে দাঁড়িয়েই। একবার ঘড়ি, মানে মোবাইল দেখে নেয় সে। সাতটা বিশ। খেয়েদেয়ে সময় কাটানোর বুদ্ধিটা চমৎকার কাজ দিয়েছে, বাবলি ভাবে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় যাবার আগে বাবলির চট করে মনে হয়, ঘরটা গুছিয়ে ফেললে কেমন হয়? ডাইনিং রুমটা কেমন অগোছালো! আমেনা বুয়া একেবারেই গোছগাছ করেনি খাবার টেবিলটা, আর শোবার ঘর দুইটাও খুব এলোমেলো হয়ে আছে। মা আর ছোটমামা এসে যদি শুনতে পায় আমেনা বুয়া কোথাও হারিয়ে গেছে কিন্তু বাবলিই পরিষ্কার করে রেখেছে সব- তাহলে তাদের খুশি না হয়ে উপায় কি? একটু আবদার করলে দুয়েকটা আইসক্রিমও কি পাওয়া যাবে না তখন!

যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। আরো একবার বারান্দায় গিয়ে লাল-সাদা ডোরা শার্টের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে আসে বাবলি। এরপর সে চলে আসে ডাইনিং রুম গোছাতে।

দ্রুত হাতে এঁটো হয়ে থাকা খাবার বাটিগুলো কিচেনের সিংকে নিয়ে আসে বাবলি। এরপর শুরু করে ভিম দিয়ে পরিষ্কার করা। টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপনে থালা পরিষ্কারের দৃশ্যগুলো ভাসতে থাকে বাবলির চোখে, আর সে কাজ করে যায়। সে ঘষে চকচক করে তোলে প্লেটগুলোর প্রতিটা অংশ, দূর করে দেয় মাংস আর ঝোলের দাগ। কিচেনপর্ব শেষ করে সে চলে আসে টেবিল পরিষ্কারে। রান্নাঘরের দরজায় ঝোলানো কাপড়টা দিয়ে সে টেবিল মোছে, সকালের প্রথম দেড়ঘণ্টা নিজেকে কেবল রক্ষা করে যাওয়া তেন্ডুলকার তার ব্যাটের ছোঁয়ায় বলকে পাঠাতে থাকেন যত্রতত্র। স্টেইন আক্রমণ থেকে সরতেই হুক করে বেঁটে ফাস্ট বোলারটাকে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগের ওধারে পাঠালো শচীন, বাবলি এদিকে নিপুণ হাতের ফ্লিকে উচ্ছিষ্ট খাবারের শেষ কণাটাও সরিয়ে নেয় টেবিল থেকে।

কাজ করার নেশায় পেয়েছে যেন বাবলিকে, ডাইনিং রুম পর্ব শেষ হতেই সে হানা দেয় ড্রয়িংরুমে। সোফার এলোমেলো হয়ে থাকা কুশন, টিভির উপরে নড়ে যাওয়া ডাস্টকভারটা, টি-টেবিলেরওপর জমে থাকা ধুলো- কিছুই নিস্তার পায় না বাবলির হাত থেকে। লাঞ্চের পর তেন্ডুলকার তখন নিউল্যান্ডসের মাঠে মরিয়া, টেলএন্ডারদের নিয়ে যতটা সম্ভব কমাতে হবে প্রতিপক্ষের সাথে রানের ব্যবধান। বাবলিও থামে না মোটেই, ড্রয়িংরুম শেষ করেই শোবার ঘরে যাবে বলে ঠিক করে সে। দ্রুত গতিতে রান তোলার আনন্দে, কাজের আনন্দে ডুবে গিয়ে ‘সবকিছু ঠিক আছে’ বিশ্বাসে এখন ফুরফুরে।

আর ফুরফুরে মেজাজের সেই বাবলিকে আচমকা জমিয়ে দেয় একজোড়া আওয়াজ। প্রথমটা তীক্ষ্ণ, কলিংবেলের। দ্বিতীয়টা ভোঁতা, মানুষের গলার। ‘বাবলি, এই বাবলি, দরজা খোলো। বাসায় কেউ নাই, সেটা আমি জানি। দরজা খোলো!’

সেই লোকটা, ফিরে এসেছে আবারো!

বাবলি একছুটে দরজার কাছে পৌঁছে যায়। বিমুঢ় হয়ে সে দেখে- কেবল শব্দ করে হাঁক দিয়েই শান্ত হচ্ছে না লোকটা, প্রচণ্ড জোরে সে ধাক্কা দিচ্ছে দরজার গায়েও। পুরোনো দরজা, লোকটা মিনিট দশেক চেষ্টা করলে ভেঙে ফেলতে পারবে নিশ্চয়ই! বাবলি ভাবে, জোরে চেঁচালে কেমন হয়! কিন্তু পরক্ষণেই ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখে, মাঠের ওধারের টং দোকানটা কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে আজ, চীৎকার করে লাভ কী!

‘বাবলি, দরজা খোলো বলছি! অনেকক্ষণ ওয়েট করসি, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! দরজা খোলো!’ লোকটা এবার আরো জোরে ধাক্কা দেয় দরজাতে, যেন তার মাঝেও বাবলির চিন্তাটাই সংক্রামিত হয়ে গেছে এতক্ষণে, যে চেষ্টা করলেই ভেঙে ফেলা যাবে দরজাটা। তৃতীয় দিনের প্রথম দেড় সেশনে ডেল স্টেইনের করা ছেষট্টি বলের আটল্লিশটাই নিরাপদে কাটিয়ে দিয়েছিলো তেন্ডুলকার, কিন্তু বাকি আঠারো ডেলিভারিতে মহেন্দ্র সিং ধোনি আর চেতেশ্বর পূজারাকে তুলে নিয়ে স্টেইনও কি জাত চেনায় নি?...

চিন্তার অবসর নেই বাবলির, সে দৌড়ে নিয়ে আসে বিছানার নিচে অযত্নে ফেলে রাখা মশারী টানানোর স্ট্যান্ডটা। শেষ চেষ্টায় হয়তো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে সেটাকে। কী করে, সেটা অবশ্য তার জানা নেই।

দরজাটা এখন আঘাতে জর্জরিত। ওপাশ থেকে প্রায় বিনা বিরতিতেই থাবা দিচ্ছে লোকটা। আর বাবলিকে ভয় পাইয়ে দেয়া নিচু অথচ নিশ্চিত গলায় লোকটা বলে যাচ্ছে, ‘ভয় পাচ্ছো নাকি বাবলি?... ভয় পাবার কিচ্ছু নাই। এই দরজাটা আগে খুলে নেই, তারপর মন খুলে আলাপ করবো, ঠিক আছে?’

পিঠটা দরজার সাথে ঠেকিয়ে দেয় বাবলি, উদ্দেশ্য- দরজার আবরণটাকে আরেকটু দুর্ভেদ্য করা লোকটার কাছে। কিন্তু সেকেন্ড বিশেক পরেই বাবলি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে, দরজায় আঘাত করা থেমে গেছে ওপাশ থেকে। বরং মনে হলো, কী-হোলে চাবি ঢুকানোর আওয়াজ শোনা গেলো যেন।

একলাফে দরজা থেকে সরে গিয়ে বাবলি মুখ ফেরায় দরজার দিকে। দেখতে পায়, তার সন্দেহকে ঠিক প্রমাণ করে দিয়ে দরজার লকটা খানিক নড়াচড়াই করছে। ওপাশ এখন একদম নীরব, তালা খোলার ব্যস্ততায় নিশ্চয়। লোকটা চাবি কোথায় পেলো, এরকম একটা প্রশ্ন মগজের ভেতরের কোথাও যেন স্থান নেয় বাবলির। কিন্তু এও সত্য, এমন সংকটের মুহুর্তে কেবল অদূর ভবিষ্যতের আশঙ্কা ছাড়া কিছুই খেলা করতে চায় না তার ছোট্ট মাথায়। একটা সময় তো থামতে হয়েছিলো তেন্ডুলকারকেও! লোকটা দরজা খুলে ফেললে কী হবে?

দুই হাতে চেপে ধরা মশারীর স্ট্যান্ডটা যেন অনেক ভারি হয়ে গেছে এখন। কাঁপতে কাঁপতে ভীত বুকে বাবলি কোনোরকমে তার অস্ত্রটা দুই হাতে তুলে রেখে প্রস্তুত হয় চরমতম মুহূর্তের জন্যে। আর যা হয় হোক, একটা অন্ততঃ শক্ত আঘাত সে করেই ছাড়বে লোকটাকে।

খুট করে একটা শব্দ হয় এ সময়। সেকেন্ড পরেই ওপাশের ধাক্কা খেয়ে খুলতে থাকে দরজাটা। বাবলি অনভ্যস্ত হাতে মশারীর স্ট্যান্ডটাকে ধরে মানসাঙ্ক কষে বের করতে চায় ঠিক কখন সে নামিয়ে আনবে অস্ত্রটা। সেই অঙ্ক করার ফাঁকেই দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে গেলে ওপাশে দেখা যায়...

‘মামা! তুমি!’

ছোটমামা হাসতে হাসতে এক পা এগিয়ে এসে বলেন, ‘কী রে, বেশি ভয় পাইছিলি? একদম তো ডাণ্ডা নিয়ে রেডি হয়ে আছিস দেখি!’

হাত থেকে অস্ত্রটাকে ছেড়ে দেয়ার অবসরে বাবলির চোখ চলে যায় ছোটমামার পেছনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সাদা লাল ডোরাকাটা শার্ট। বাবলি ছোটমামার হাত চেপে ধরে শক্ত করে।

ছোটমামা তখনো হাসছিলেন। বাবলির দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে তিনি আরো একবার হেসে ওঠেন। বলেন, ‘আরে ভয় পাইস না! আনিস আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু!আপাকে একদিন বলছিলাম যে বাসায় একা থাকলেও তুই ভয় পাবি না। আপা উলটা বললো যে তুই ভীতুর ডিম। তাই একটা বাজি ধরে ফেললাম আর কী! ... তুই ঘুমানোর পরে আমেনাকে আপাই বাসার বাইরে নিয়ে গেছে। আমি আর আনিস অবশ্য সারাক্ষণ ঐ চায়ের দোকানে বসেছিলাম, যদি তোর কোনো সমস্যা হয়! কিন্তু তুই তো দেখি বিশাল সাহসী!’

পেছনের আনিস নামের লোকটা এগিয়ে আসে তখন। একটা লাল প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘এই নাও বাবলি, একটা ছোট্ট গিফট। কিটক্যাট নাকি তোমার খুব পছন্দ!  ...তোর ভাগনির কিন্তু আসলেই অনেক সাহস!’ আনিস হাসতে হাসতে এরপর বন্ধুকে বলে। ‘আমি ওকে ভয় পাওয়ানোর জন্যে অনেক ড্রামাটিক ডায়ালগ দিলাম, লাভ হয় নাই কোনো!’

মামা হাসতে হাসতে জোরে জড়িয়ে ধরেন বাবলিকে। বাবলির তখন দুই চোখ একটু একটু ঝাপসা। সদ্য পাওয়া কিটক্যাটটাকে আলতো করে ধরে রেখে বাবলি ভাবে, সে এতো বোকা কেনো! এভাবে তাকে বোকা বানালো সবাই মিলে!

বাবলির হাতে হাত রেখে মামা আনিসকে কিছু একটা বলতে বলতে ভেতরে যান। আর ভেতরে ঢুকেই একদম অবাক হয়ে যান মামা। সবকিছু পরিপাটি করে গোছানো। ড্রয়িংরুম, ডাইনিং স্পেস ঝকঝক করছে।

‘ওরে বাপরে!’ ছোটমামা মুগ্ধস্বরে বলেন। ‘তুই তো ঘর একদম রাজবাড়ি বানায়ে ফেলছিস বাবলি! এতো কাজ তুই কখন করলি!’

বাবলি এবার নিউল্যান্ডসের মাঠে, দুইশো তেরো বল খেলে তিন অঙ্কে পৌঁছে সে সদ্য হেলমেট খুলছে। গ্যালারি জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়া হাজারো দর্শকের হাততালিতে কানে তালা বাবলির, ব্যাটটাকে উঁচু করে তাদের অভিনন্দনের জবাব দেবার অবসরেই সে খুলতে থাকে কিটক্যাটের প্যাকেট।