• ফুটবল

মেসি যেখানে হারছে

পোস্টটি ২৩০৪৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

দুই যুগ পরে ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জেতার হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে এসেছিলো লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। এবং ব্যর্থ হয়েছিলো মারিও গোটজের এক্সট্রা টাইমের গোলে। পুরো বিশ্বকাপে সাবেলা কোম্পানী প্রতিপক্ষের চেয়ে পিছিয়ে ছিলো ওই একবারই, কিন্তু সে পরিসংখ্যান মনে রেখে সান্ত্বনা বোধ করি কোনো আর্জেন্টিনা সমর্থকই খুঁজবে না। মেসি ব্যর্থ হলেন, লোকে মনে রাখবে এটাই।

কোপা আমেরিকার ফাইনালে এবারও ব্যতিক্রম হলো না। টানা দ্বিতীয়বারের মতো কোপার শিরোপা জিতলো চিলি, গতবারের মতো এবারও টাইব্রেকারেই। গতবার লক্ষ্যভেদ করলেও পেনাল্টি শ্যুটআউটে আর্জেন্টিনাকে লিড দিতে ব্যর্থ হওয়া শ্যুটারটি ছিলেন মেসি স্বয়ং। লোকে মনে রাখবে এই কথাও।

বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে শুন্য দৃষ্টিতে বিশ্বকাপ নামের অমরত্বের দিকে মেসির চেয়ে থাকার দৃশ্যটি,খুব সম্ভব আজীবনের জন্যে লেখা হয়ে গেছে ফুটবল দুনিয়ার। তবে এর চেয়েও তাৎপর্যময় ব্যাপার, হয়তো সেই দৃশ্যটিই ফুটবলের ইতিহাসে মেসির জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

আর আজ যখন জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা এসেছে হতাশায়, বিশ্বকাপ আর মেসির মাঝে দূরত্ব কমে যাবার শেষ সম্ভাবনাও হয়তো উড়ে গেলো বারের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারা এল-এম-টেনের পেনাল্টি কিকের মতোই।

 

1467018517358

 

মেসি হেরেছে। আর সেই হার এমনই, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে মেসির পক্ষে জেতাটা সম্ভব ছিলো না আসলে। যেমনটা হয়েছিলো বিশ্বকাপের পুরোটা জুড়েও। কোনো দল বা কোনো মার্কার নয়, লিওনেল আন্দ্রেস মেসিকে আসলে লড়তে হয়েছে দিয়েগো ম্যারাদোনা নামের এক ছায়ার সঙ্গে, যে ছায়াকে আর্জেন্টাইনরা স্থান দিয়েছে তাদের জাতীয় পুরাণে। মারাকানায় যদি বিজয়ী হয়ে মাঠ ছাড়তো মেসি, ফুটবল দুনিয়ার একটা বিশাল অংশ নিশ্চিতভাবে তাকে বসিয়ে দিতো অমরত্বের রথে, ম্যারাদোনা যেখানে বসে আছেন ১৯৮৬ থেকে।

লিওনেল মেসি অনন্য, এই উপপাদ্য প্রমাণে বিশ্বকাপ অথবা কোনো মহাদেশীয় শিরোপা না জিতলেও চলে। তবুও যে বারবার মানুষের কল্পনার শেষ সীমাটা পেরিয়েও মেসিকে মাথা ঠুকতে হয় অমরত্বের দরজার চৌকাঠে,আফসোস-কোনো অভেদ্য ডিফেন্স বা কোনো মাস্টারমাইন্ড ট্যাকটিকাল জিনিয়াস - এর মূল কারণ নয়। মেসি আসলে বারবার দাঁড়ায় স্পর্শের বাইরের কিছু মানুষী স্মৃতির সাথে।

যখন ম্যারাদোনা নামটা সামনে আসে- আমরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার ঐ অসম্ভব গোলটাকে মনে করি,আমাদের চোখে ভাসে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরা দিয়েগোর ছবি। ইতিহাস আমাদের সামনে ম্যারাদোনার এমন একটা ভাবমূর্তি তৈরি করেছে,যেখানে তিনি দশে দশ। ম্যারাদোনা ঈশ্বর, দলকে সে একাই বিশ্বকাপ জেতাতে পারে।

অথচ একটু ভাবলেই দেখবো, ম্যারাদোনা (কিংবা পেলে)’র সবটাই আমাদের চোখে দৃশ্যমান না। আমরা ম্যারাদোনাদের নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখি, আমরা ইউটিউব ঘেঁটে পেলের সেরা গোলগুলোর হাইলাইটস দেখে হাততালি দেই। তাদের যত অন্ধকার, তাদের যত বিস্মরণীয় ম্যাচ আমাদের দেখা হয় না। কিন্তু লিও মেসি? তার চুলের ড্যানড্রাফ থেকে বুটের ধূলো পর্যন্ত সমস্তটাই পড়ে থাকে আমাদের সূক্ষাতিসূক্ষ্ণ বিশ্লেষণের জন্যে।

গত কয়েক বছরে মেসির খেলা দেখতে দেখতে সয়ে গেছে,আমাদের চোখজোড়া তাই এখন আর ঝলসে ওঠে না অভিভূত হয়ে। মাউসের এক ক্লিকে লিও’র যত অবাস্তব গোল,যত অদ্ভূত কারিকুরির সবটাই আমাদের সামনে আসে ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি নিয়ে।

এবং আরো একটা ক্লিকে আমাদের সামনে চলে আসে মেসির যত মানুষী মুহুর্তও।

দিয়েগো ম্যারাদোনা ভুলে যেতে চাইবেন, এমন ম্যাচও কিন্তু ছিলো। কিন্তু পুরাণ সেইসব মনে রাখে না। সমালোচনার যে জমাট ডিফেন্স বার্সেলোনার মেসিকে ভাঙতে হয় প্রতি সপ্তায়, ফুটেজ অ্যানালিসিসের যে যান্ত্রিক ট্যাকল আর্জেন্টিনার মেসিকে সইতে হয় প্রতি বছর- ম্যারাদোনার কালে কোথায় ছিলো সেই সব?

ম্যারাদোনা যদি খেলতেন মেসির যুগে, ভাবি, তখন কী হতো। যদি প্রতি মুহুর্তে ফুটেজে ধরা থাকতো আপনাকে,যদি ফেসবুক আর টুইটারে আপনাকে ট্রল করে যেতাম আমরা কোকেন কী নারী কী অফুটবলীয় মন্তব্যের খাতিরে,অলিম্পাসের চূড়া ছুঁয়ে আসা হে ম্যারাদোনা,বছরের পর বছর- সপ্তার পর সপ্তা- দিনের পর দিন,আপনি কি ভালো করতে পারতেন লিওনেল মেসির চেয়েও?

কিন্তু মেসির জন্ম স্মার্ট ফোন আর থ্রি জি’র যুগে। আফসোস যে আমরা মেসির সব কিছুই দেখি। বার্সার হয়ে গোল,আর্জেন্টিনার হয়ে গোল,মেসির টিম গোল,মেসির নিজের আলোয় আলোকিত গোল। এটুকু তাই বলা যায় নির্দ্বিধায়, মেসি জন্ম দিয়েছে সবচেয়ে বেশি হিটখোর ভিডিওফুটেজের। তর্কসাপেক্ষে,এইখানে অন্তত মেসি পেছনে ফেলতে পারে ম্যারাদোনাকে।

ঘুম ঘুম চোখে রাতে লা লিগার ম্যাচ অথবা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ বাছাই দেখতে বসে (দ্বিতীয়টি নাও হতে পারে আজ থেকে আর) আমরা হয়তো মেসির পা থেকে আসা আরো অনেক অলৌকিক দৃশ্য দেখবো। হয়তো হাততালিও দেবো অজান্তে। তবু মনে হয়, আমরা বোধ করি মনে রাখবো মেসির খেলা বিশ্বকাপের এই ম্যাচগুলোকেই। হয়তো কেবল মারাকানার ফাইনালটাকেই। যে ফাইনালে, মারাকানা রিক্ত হাতে ফিরিয়েছে মেসিকে। হয়তো কোপার এই ফাইনলাটাকেই। লিওনেল মেসি যেখানে আর্জেন্টিনাকেই উড়িয়ে মেরেছে বারের ওপরে।

মেসির অর্জন কতটা,খুব সম্ভব আমরা এখনো সেটাকে পুরোপুরি মাপতে অক্ষম। মিডিয়া,দর্শক,ফেসবুক সমালোচকেরা তাকে মার্ক করে রাখে প্রতিটা ম্যাচে। প্রতি মুহুর্তে ফুটবল শো, প্রতি সেকেন্ডে টুইটার থ্রেডগুলো চায় মেসিকে কড়া ট্যাকল করতে। সচরাচর মেসি ডাইভ দিতে চায় না বলেই বোধহয়,মাটিতে নামাই তার পরিণতি। মেসি মাঠে কম দৌড়ায়। হ্যাঁ, ম্যারাদোনা শেষ বয়েসেও মাঠে দৌড়তেন ভুঁড়ি নিয়ে- ফুটবল পুরাণ বলে। পুরাণ চেপে যায় দিয়েগোর কোকেন নেয়ার কথা। সেটা বরং তার বোহেমিয়ান,ছিটগ্রস্ত প্রতিভাবান ইমেজে আরেকটু মশলার যোগান দেয় ট্যাবলয়েডগুলোকে। মেসি বরং যতই করুক, তার সাথে মার্কার হয়ে থাকে ‘হ্যাঁ, কিন্তু...’ শব্দ জোড়া।

-‘হ্যাঁ,মেসি দলকে ফাইনালে তুলেছে,কিন্তু নকআউট রাউন্ডে গোল তো পায়নি।'

-‘হ্যাঁ,মেসি বার্সেলোনায় প্রচুর গোল করে, কিন্তু ওখানে তো ইনিয়েস্তাই তাকে বল দেয়... 

দুনিয়ার সবচেয়ে সমালোচিত ফুটবলার মেসির ট্রফি কেসের সম্বল লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ, অলিম্পিক স্বর্ণ, অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ, ব্যালন দি অঁর, ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু। গোলস্কোরিং এর যাবতীয় রেকর্ড পায়ে লুটাচ্ছে রোজারিও থেকে উঠে আসা ওই ছোটোখাটো মানুষটার পায়ে। তবু, তবুও, মেসির সংজ্ঞা আমাদের দিতেই হবে বিশ্বকাপ দিয়ে।

কয়েকশো ম্যাচের মাঝখান থেকে আমরা বেছে নিবো শুধু সাত ম্যাচের ঐ বিশ্বকাপ টুর্ণামেন্টকেই। 

কোনো একদিন, যখন ব্যাগ পিঠের থিয়াগোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নিজের স্মৃতির ধূলো মাখা বুটজোড়া মুছবে তার বাবা, তখন হয়তো এক অলস দুপুরে ইউটিউবে চোখ রেখে আমরা চমকে উঠবো। আরেকটু আগ্রহী হয়ে হয়তো দেখবো মানুষটাকে নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারিগুলো। হয়তো তখনই, কেবল তখনই আমাদের মনে হবে- শালা তো জিনিসই ছিলো একটা !

আর সেই অলস দুপুর বা ফুটবল রাতে আমরা হয়তো বুঝবো,আমরা বেঁচে ছিলাম লিওনেল মেসির সময়ে। হয়তো তার চেয়ে অবিশ্বাস্য কিছু আমরা আর কখনো দেখিইনি। হয়তো।

একটা মরীচিকা গোলপোস্টকে লক্ষ্য করেই ছুটছে সে, ড্রিবলিং এর চূড়ান্ত কারিকুরিতেও ম্যারাদোনার অশরীরী ছায়ার মার্কারকে পেছনে ফেলা হচ্ছে না তার। ইতিহাসে তাই লিও মেসি ব্রাত্য। মেসি এখানে হারছে,হয়তো মেসি এখানে হারবেই কেবল। 

কিন্তু ফুটবল যারা সত্যি করে ভালোবাসে, মেসি আর তার পা জোড়া,তাদের কেবল দিয়েই যাচ্ছে। মেসি হারছে, মানবীয় সীমার সর্বোচ্চটা স্পর্শ করেও সাধারণ এক পেনাল্টি কিকে বল জালে জড়াতে না পারায়। মেসি হারছে, রেফারির রক্তচক্ষু এড়িয়ে তার পায়ে তেড়ে আসা ভাগ্যের অনন্য ট্যাকলগুলোকে এড়াতে না পেরে। মেসি হারছে, জিতে যাচ্ছে দৈব। 

মেসি হারছে, ফুটবলকে জিতিয়ে দিয়েই।

 

[ইনসাইড স্প্যানিশ ফুটবল ডট কমের বিশ্লেষক, জেন ইভলিনের The Great Paradox that will unfairly define Lionel Messi প্রবন্ধের ছায়া অবলম্বনে]