আজহারঃ একটি চলচ্চিত্রের 'ক্রিকেটীয়' ময়নাতদন্ত
পোস্টটি ৩৫৬৩ বার পঠিত হয়েছেডিসক্লেইমারঃ আমি কোন চলচ্চিত্র সমালোচক নই, এক্ষেত্রে আমার ধারণাও আর আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত। ক্রিকেটমোদী হিসেবে ক্রিকেটারকে নিয়ে বানানো একটি চলচ্চিত্র নিয়ে তবুও কথা বার্তা বলার চেষ্টা করলাম। এখানে যা বলেছি সেটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। মানুষের রুচির তফাৎ থাকবেই, কাজেই আমার চিন্তাভাবনা আপনার ভাল লাগতেও পারে, আবার নাও লাগতে পারে। এটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার।
সূচনা
শত টেস্ট না খেলতে পারার আফসোস নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা, অথবা বলা ভাল করতে বাধ্য হওয়া মোহাম্মাদ আজহারউদ্দিনকে নিয়ে চলচ্চিত্র বের হয়েছে। এমরান হাশমি, আজহারউদ্দিনের নাম ভূমিকায়। সাথে প্রাচী দেশাই, লারা দত্ত, নার্গিস ফখরির মত বলিউড গ্ল্যামার গার্লসরা। ভাল প্রিন্ট বের হবার আগেই তাই টরেন্ট থেকে হল প্রিন্ট নামিয়ে দেখে ফেললাম।
যেকোন খেলাধুলার প্রতিই আমার বিপুল আগ্রহ, আর একজন বাংলাদেশী মাত্রই ক্রিকেট ফ্যান। তাছাড়া চলচ্চিত্রটার প্রেক্ষাপট নব্বইয়ের দশক, আমার হিসাবে ওটা ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ। চলচ্চিত্রটা না দেখার কোন কারণ এজন্যেই নাই। যা হোক কথা না বাড়াই।
‘দ্য গুড’
ছবির কাহিনী বেশ জমজমাট, কোথাও ‘ঝুলে’ যায়নি। ছবির শুরুই হয়েছে আজহারউদ্দিনের নিষিদ্ধ হবার ঘটনা ধরে। যেহেতু এই কাহিনী সবারই জানা তাই আমি এখানে দেয়া কথা গুলোকে ‘স্পয়লার’ হিসেবে বলতে রাজি নই। তবে এই জানা কাহিনীকেই গতিময়তার সাথে সেলুলয়েডে ধরে রাখার মুন্সিয়ানা পরিচালক দেখাতে পেরেছেন। বর্তমানকে উপস্থাপন করেছেন, তাঁর সাথে সাথে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখিয়েছেন অতীত কাহিনী। সমান্তরাল ভাবে চলা ঘটনাপ্রবাহ শেষে এসে একত্রে মিশে গেছে এবং পুরো চলচ্চিত্রটার কাহিনীই মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে। কোথাও কোন আদিখ্যেতা দেখা যায়নি, ঘটনার উপরিপাতন হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো ‘পরে কি হল, পরে কি হল’ এমন টেনশনের মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে! পুরো ছবিতে গতানুগতিক বলিউডি মশলা নেই, প্রচলিত ঘরানার আর্ট ফিল্মের মত আবার ধীরগতিও নেই। বেশ মসৃণভাবে কাহিনী টানার জন্যে চিত্রনাট্যকারের অবশ্যই করতালি প্রাপ্য।
ছবির কিছু কিছু সংলাপ বেশ প্রশংসার দাবিদার। ভারতের অধিনায়কের উপর থাকা পর্বতসম চাপ প্রধান নির্বাচকের মুখ দিয়ে অসাধারণভাবে শোনানো হয়েছে। শেষের দিকে স্পন্সরের মুখের উপর কথা বলে এসে জীবন সম্পর্কে দেয়া আজহারের কিছু সংলাপও কানে লেগে থাকার মত। চলচ্চিত্রের শুরুটাও হয়েছে বেশ চটকদার সংলাপ দিয়ে। বাকি অংশের সংলাপগুলোও পরিশীলিত, কোথাও বেশি চটকে যাবার মত ঘটনা ঘটেনি।
নেতিবাচকভাবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও এমরান হাশমি যে জাত অভিনেতা তা এই ছবিতে আবার প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। আজহারউদ্দিনের চরিত্রে তিনি চমৎকার উতরে গেছেন। যদিও উচ্চতার ঘাটতি ছিল; তবে হাঁটাচলা, মাঠে নামার সময় আজহারউদ্দিনের ভাবভঙ্গি মোটামুটি নিখুঁতভাবেই নকল করতে পেরেছেন বলা যায়। লারা দত্তের উকিল হিসেবে অভিনয়ও দুর্দান্ত ছিল।
কারিগরি দিক এবং সিনেমাটোগ্রাফি বলিউডি ঘরানারই। অতএব এখানে ভাল-খারাপের কিছু নেই। তাই কিছু বলার প্রয়োজনও বোধ করছি না।
‘দ্য ব্যাড’
চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে আজহারউদ্দিন নিশ্চিতভাবেই নিজেকে ‘ক্লিন’ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে চেষ্টার এই বহিঃপ্রকাশটা বেশ উগ্র লেগেছে। ড্রেসিংরুমে সিনিয়র খেলোয়ারদের সাথে উগ্র আচরণ দেখানোর দৃশ্যগুলো আজহারের সত্যিকারের সতীর্থরা চলচ্চিত্র মুক্তির পর কিভাবে নিয়েছেন তা বেশ কৌতুহল জাগানিয়া। কপিল দেবকে চলচ্চিত্রের শুরুর এবং শেষের দিকে আজহার মহান করে দেখিয়েছেন। তবে মাঝে কেন কপিল তাঁর সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন, আবার কিসের জন্যেই বা সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে এনেছেন সেটার কোন পরিষ্কার বর্ণনা চোখে পড়েনি। কাহিনী বেশ জমজমাট থাকলেও শেষে এসে মনে হয়েছে পরিচালক হটাত করে সৌভাগ্যের প্রশস্ত দরজা উন্মুক্ত করে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ ঘটাতে চাচ্ছেন। কোর্টে নওরিন এবং সঙ্গীতার বিনা নোটিশে উপস্থিত থাকা অথবা একসাথে প্রবেশ করার দৃশ্যগুলোও অতি নাটকীয় লেগেছে। ‘বায়োগ্রাফি’ হিসেবে যেহেতু এই চলচ্চিত্রকে বাজারজাত করা হয়েছে, অতএব এই নাটকীয়তাগুলো এড়ানো উচিৎ ছিল।
চলচ্চিত্রের কাহিনীর সবচাইতে দুর্বল দিক হচ্ছে মামলার সমাধান! আজহারের পক্ষের উকিল আট বছর সাধনা করে যে যুক্তি উপস্থাপন করে মামলা জিতল, আদৌ এভাবে কোন মামলা জিতা যায় কিনা সেটা আইনজীবিরাই ভাল বলতে পারবেন! তার চাইতেও হাস্যকর এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই যুক্তি বের করতে দীর্ঘ আট বছর লাগার বিষয়টা! পাঠক, চলচ্চিত্রটি দেখলেই ব্যাপারটা বুঝা যাবে। মামলার ব্যাপারটি পুরো চলচ্চিত্রে যেভাবে 'ফোকাসড' হবার কথা ছিল সেভাবে হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি।
আজহার তাঁর দিক থেকে বুকির আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু বুকিরা যে এভাবেই তাঁকে ঘিরে প্লট সাজিয়েছে এটা তিনি কিভাবে জানলেন? বুকিরা তাঁকেই কেন ফিক্সিং এর জন্যে ‘টার্গেট’ করেছে সেটাও পরিষ্কার নয়। হান্সি ক্রনিয়ের বক্তব্য থেকে আজহারের প্রতি অভিযোগ আনা হয়েছে কিন্তু হান্সি কেন এমন বলেছিলেন অথবা কিসের প্রেক্ষিতে বলেছিলেন তাও পরিষ্কার নয়। অথচ একথা আজ প্রমাণিত যে হান্সিকে বুকির সাথে এই আজহারউদ্দিনই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অজয় জাদেজাও আজহারের সাথে ঐ একই সময়ে একই কারণে নিষিদ্ধ হন, ফিক্সারদের তালিকায় এমনকি হার্শেল গিবসেরও নাম আসে! জাদেজার নাম মাত্র একবার এই চলচ্চিত্রে এসেছে, আরো আসা উচিৎ ছিল। সমসাময়িক আরো অনেক ঘটনাই চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, অথচ সেগুলো আজহারের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো ছিল। আমার ধারণা এইসবক্ষেত্রে কল্পনার আশ্রয় বেশি নেয়া হয়েছে, ‘বায়োগ্রাফি’ তে এমন কিছু মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
সঙ্গীতার সাথে প্রণয়টা যে ভুল পুরো ছবিতে কেবলমাত্র এই একটা জায়গাতেই আজহার তাঁর দোষ স্বীকার করেছেন! এটার বাইরেও তাঁর ক্যারিয়ারে আরো অনেক বিতর্ক ছিল, সেগুলা গোটা চলচ্চিত্রে একেবারেই আসেনি। রাতভর পানশালায় গিয়ে আড্ডা, ক্যাসিনোতে প্রচুর সময় কাটানো, প্লেবয় ইমেজ- তিনি অধিনায়ক থাকাকালীন পত্রিকার পাতায় এ সংবাদগুলো ছিল নৈমিত্তিক। চলচ্চিত্রটি দেখলে অবশ্য এসব আপনার কিছুই মনে হবে না! সৌরভ গাঙ্গুলির আগে তিনি যে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ছিলেন সেটাও এই চলচ্চিত্র দেখে বুঝা কঠিন। খেলার যেসব দৃশ্য দেখানো হয়েছে তাঁর সবই মোটামুটি ওয়ানডের। অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে তাঁর নৈপুণ্য অবশ্যই আরো ভাল মত দেখানো যেত।
‘দ্য আগলি’
আজহারের পক্ষের উকিলের অভিনয় একেবারে জঘন্য। সঙ্গীতার চরিত্রে নার্গিস ফখরিও তাই। বিদেশ সফরে গিয়ে হোটেল রুমে নায়িকাদের সাথে খেলোয়াড়দের অনৈতিক কার্যক্রমের ঘটনাগুলোকেও বেশ স্থূলভাবে দেখানো হয়েছে। সামাজিকভাবে ক্রিকেটারদের প্রতি এটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে নিশ্চিত।
এমরান হাশমি ভাল অভিনেতা হতে পারেন, কিন্তু ভাল ক্রিকেটার তো আর নন। তবুও ক্রিকেটারের চরিত্রে অভিনয়ের আগে ব্যাট হাতে শট খেলার তালিম নেয়া উচিৎ ছিল। ড্রাইভ, ফ্লিক অথবা কাট করার দৃশ্যগুলো রীতিমত হাস্যকর লেগেছে। সেই সাথে ছয় মারার দৃশ্যগুলোও। ‘কাভি খুশি কাভি গম’ এর মত খেলার সময় চোখ বন্ধ করে নানার উপদেশমালা মনে করার দৃশ্যটা গোটা চলচ্চিত্রের মধ্যে যেন ক ফোটা গো চনা! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এত সস্তা না, মাঠে নামলে নিশ্চিতভাবেই কারো মনে 'ব্যক্তিগত' অতীত ইতিহাস মাথা চাড়া দেয় না!
নাদুস নুদুস কপিল দেবের জায়গায় শুটকো এক ভদ্রলোককে অভিনয় করতে নামিয়ে দেয়াটা চরিত্র বাছাইকারীর ক্রিকেট-মূর্খতার পরিচায়ক। কাহিনী বলছে বিশ্বের বিভিন্ন মাঠে খেলা হচ্ছে কিন্তু দৃশ্যপট বারবার একই মাঠ দেখাচ্ছে। ক্রিকেটারের জীবন নিয়ে ছবিতে মাঠ, ক্রিজ, সতীর্থ, ক্রিকেট শট নিয়ে আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। পরিচালক এখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন!
সারাংশ
সময় কাটানোর জন্য চলচ্চিত্রটি বেশ আদর্শ একটি উপকরণ হতে পারে যদি আপনি ক্রিকেটপ্রেমী হন এবং ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে আপনার আগ্রহ থাকে। তবে ‘বায়োগ্রাফি’ হিসেবে এতে কতটুকু সত্যের ছোঁয়া আছে তাতে আমি নিজেও সন্দিহান! সবকিছু মিলে আমি ছবিটিকে দশ এ ছয় দিব। আপনি কত দিবেন সেটা আপনি দেখেই ঠিক করুন!
- 0 মন্তব্য