বঙ্গদেশের ফুটবল রঙ্গ
পোস্টটি ১২১৯৪ বার পঠিত হয়েছেস্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অমন উন্মত্ত পথচলার পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম খেলা ছিল থাইল্যান্ডের সাথে, ১৯৭৩ সালের ঐ ম্যাচে বাংলাদেশ ২-২ গোলে ড্র করেছিল। সত্তরের দশকটা বাংলাদেশ ‘অতটা’ ভালো কাটায় নি, হেরেছে-ড্র করেছে; কিন্তু জয় ছিল যেন দূরের কোন বাতিঘর- দেখা যায়, তবে স্পর্শ করা যায় না!
১৯৮০ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব- স্বাধীনতার ৯ বছর পর বাংলাদেশ পেল প্রথম জয়ের স্বাদ। আফগানিস্তানকে ৪-১ গোলে হারানো, সাথে বেশিরভাগ ম্যাচ ড্র করায় র্যাঙ্কিং এ খুব বেশি না পিছিয়ে থাকার সুবাদে বাংলাদেশ সুযোগ পেয়ে গেল এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলার!
পাঠক, আসলেই এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ খেলেছিল, স্বাধীনের মাত্র ৯ বছরের মাথায় এশিয়ার সেরা দশ ফুটবল পরাশক্তির মাঝে উড়েছিল লাল-সবুজের পতাকাটাও! উপমহাদেশ থেকে কেবলমাত্র বাংলাদেশই কোয়ালিফাই করেছিল ঐ টুর্নামেন্টে, উদ্বোধনী ম্যাচটাও খেলেছিল বাংলাদেশ, উত্তর কোরিয়ার কাছে অল্পের জন্য ৩-২ গোলে হেরে বার্তাও দিয়ে রেখেছিল অন্য পরাশক্তিদের কাছে যে ‘আমরা আসছি’! পরের ম্যাচে সিরিয়ার কাছে আবারো অল্পের জন্য ০-১ গোলে হার, আক্রমণাত্নক মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ লড়েছিল চীন এবং ইরানের সঙ্গেও।
একমাত্র সিরিয়া বাদে বাকি তিনটি প্রতিপক্ষ দেশই বিশ্বকাপ খেলেছে, আসলে ঐ আসরের অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে কেবল মাত্র সিরিয়া এবং বাংলাদেশই বিশ্বকাপে জায়গা করতে পারেনি এখনো। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ার ব্যাপারটা না হয় মানা গেল, কিন্তু বাংলাদেশ?
এরপরের ইতিহাস নিয়ে আসলে তেমন কিছু বলার নেই, এশিয়ান কাপের মূলপর্বে খেলা বাংলাদেশ এরপর কেবল পিছিয়েছে। একসময় যে মালদ্বীপকে বাংলাদেশ গুণে গুণে ৯-১০ গোল দিত সেই মালদ্বীপের সাথে এখন বাংলাদেশ ড্রয়ের উদ্দেশ্যে গিয়ে ৫-০ গোলে হারে; যে ভূটানের র্যাঙ্কিং একসময় ছিল ২০৪- সেই ভূটানের সাথেও এখন বাংলাদেশ জিততে পারে না। আফগানিস্তান-ভারত তো এখন অন্য মানদণ্ডে পৌঁছে গেছে, তাঁদের সাথে এখন বাংলাদেশ ‘লড়াই’ করে বেশি গোল না খেয়ে ম্যাচ হারার উদ্দেশ্যে!
বাংলাদেশ এখন এশিয়ার তলানির দেশগুলোর একটি, আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় শেষ কবে জয় এসেছে তা সম্ভবত ফেডারেশনের লোকেরাও বলতে পারবেন না। বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনকে অবশ্য এগুলো জিগ্যেস করার আগেই অজস্র অজুহাত চলে আসবে। অর্থসঙ্কটের কথা আসবে, মাঠ সঙ্কটের কথা আসবে, খেলোয়াড় সঙ্কটের কথা আসবে। তা আসতে থাকুক, এর মধ্যে কিছু স্মৃতিচারণ করে আসাই যায়!
এইতো মাসখানেক আগে বাফুফের নির্বাচন হল। ফুটবলে সালাউদ্দিনের দাপট কমানোর জন্যে তার বিরুদ্ধে দুই পক্ষ এই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে গেল। বাংলাদেশের অন্যান্য নির্বাচনের মত এখানেও আশার সলতে জ্বালানো হল, দেয়া হল অজস্র প্রতিশ্রুতি। ভোট টানার জন্যে চলল ভুড়িভোজ, চট্টগ্রামের র্যাডিসন ব্লুতে তে বসল সম্মোহনী রাত, ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে সেখানে গেলেন প্রার্থীগণ! নাহ, ওসব দেখে কখনোই মনে হয়নি যে দেশের ফুটবলে টাকার অভাব আছে, কখনো অভাব হতে পারে সেটাও মনে হয় নি!
দেশের ঘরোয়া ফুটবল লীগ যেন এক আশ্চর্য রঙ্গমঞ্চ! স্থানীয় ফুটবলারদের দলে ভিড়ানোর জন্যে এখানে টানাটানি চলে, এক ক্লাবে সাইনড হয়ে গেলেও বেশি টাকা পেয়ে অন্য ক্লাবে প্রায়ই স্থানীয় ‘তারকা’ খেলোয়াড়েরা সাইন করে ফেলেন। আইন ভঙ্গ নিয়ে অবশ্য তাঁদের চিন্তা করতে হয়না, ওসব তো ক্লাবের রাঘব-বোয়ালদের চাপে বাফুফে নিজে নিজেই ‘ম্যানেজ’ করে নেয়! এই স্থানীয় বাঘা বাঘা খেলোয়াড়, যাদের দলে নেয়া নিয়ে এত হইচই তারাই এরপর মৌসুম জুড়ে সাইডবেঞ্চ গরম করেন, কখনো কখনো কোচের কৃপায় হয়তো বদলি হিসেবে সুযোগ পান। ৩৫-৪০ লাখ টাকায় দলবদল করে সারা বছর না খেলা এসব খেলোয়াড়েরাই শেষমেষ জাতীয় দলের হয়ে খেলতে বিদেশ যান। সেখানে পর্যটকদের মত ঘুরে বেড়ান, পানশালায় যান, ছবি-সেলফি তুলেন। এরপর হালির উপরে গোল খেয়ে হতাশার বাণী আউড়িয়ে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে দেশে ফিরে আসেন। ক্ষমাশীল বাঙ্গালি জাতি এনাদের অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে তৎক্ষণাৎ ক্ষমা করেও দেয়!
ফুটবল লীগ যদি রঙ্গমঞ্চ হয়, তবে তার সেরা কুশীলব হচ্ছে ফুটবল ফেডারেশন নিজেই। ক্লাব দল গুছাতে পারে নি এমন হাস্যকর যুক্তিতে লীগ পেছানো কেবল এদেশেই সম্ভব! দল হেরেছে বলে ক্লাবের কর্মকর্তারা ফেডারেশন অফিস ভাঙচুরের নেতৃত্ব এদেশেই দিয়েছেন! পছন্দের লোককে ফেডারেশনে বসানো হয়নি, অমুক মাঠে খেলব না, অমুক রেফারি হলে লীগ বয়কট করব- ক্লাবের এমন ‘মামাবাড়ির আবদার’ এও এ দেশে অজস্রবার লীগ পিছিয়েছে। এদেশের জাতীয় ফুটবল স্টেডিয়াম প্রায়ই কমিউনিটি সেন্টারের মত কন্সার্ট করতে ভাড়া দেয়া হয়, এরপর মাঠকে খেলার উপযোগী করার সময় দেয়ার জন্যে লীগ পেছানো হয়!
এ দেশের কোন ক্লাবের যুব একাডেমি নেই, ফেডারেশনের পক্ষ থেকে একটা একাডেমি সিলেটে খোলা হয়েছিল- টাকার অভাবে সেটা বন্ধ করে দিতে হয়েছে দু’বছরের মাথায়। তবে ফেডারেশন নাকি প্রায়ই যুব-উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ফিফার কাছে থেকে টাকা আনে, প্রকল্পটা কি সেটা বুঝানোর জন্যে বিকেএসপিকে ফুটবল একাডেমি বলে চালিয়ে দেয়া হয়! ঐদিন নাকি অন্যসব খেলার কার্যক্রমও বন্ধ রাখা হয়। এরপর প্রকল্প পাস হয়, ফিফা থেকে অনুদান আসে, টার্ফ আসে। সেই টার্ফ এয়ারপোর্টে বছরখানেক আটকা পড়ে থাকে। কিন্তু একাডেমি আর আলোর মুখ দেখে না।
ভূটানের কাছে হেরে যাওয়ায় এজন্যেই অবাক হবার কিছু নেই। এই হারে আগামি তিন বছর বাংলাদেশ কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ পাবে না, র্যাঙ্কিং এ দুইশর বাইরে চলে যাওয়াটা তাই খুবই সম্ভব! ফুটবল কর্তাব্যক্তিদের মতো মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যাওয়াটাই তাই মঙ্গল, সেখানে ক্রিকেট দলের বিজয়োৎসব দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলাটাই যুক্তিযুক্ত।
যেটা রসাতলে যাবার সেটা তো যাবেই, এটার জন্যে এত রব তুলে কি হবে?
- 0 মন্তব্য