• ক্রিকেট

কেপটাউনের কলোসাস

পোস্টটি ৮৩৬৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৯৯৮এ ঢাকার আইসিসি নকআউট ট্রফি, ওরফে মিনি ওয়ার্ল্ডকাপ দিয়ে আমার সত্যিকারের ক্রিকেট দেখা শুরু। '৯৬ বিশ্বকাপের লারা-কাহিনী, ভারতের ইডেন-লজ্জা বা শ্রীলঙ্কার রূপকথার যতটা না দেখা তার চেয়ে অনেক বেশি শোনা- আর বাংলাদেশের কুয়ালালামপুর কাব্যের পুরোটাই রেডিও আর পত্রিকার বদান্যতা- তাই সত্যিকারের দেখা শুরু সেই '৯৮র মিনি ওয়ার্ল্ডকাপ দিয়েই। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি আকর্ষণটা তখন থেকেই শুরু- যেটায় প্রায় একক অবদান ঝাড়া সোয়া ছয় ফুটি এক দানবের।

 

 

ক্লাস ফোরে পড়ি তখন, অলি-গলি ঘুরে ক্রিকেট খেলার জন্য একেবারে পারফেক্ট বয়স। চার-পাঁচজনের টিমে সবাই ব্যাটসম্যান, সবাই বোলার- সব দলে অলরাউন্ডারের ছড়াছড়ি। কাজেই টিভিতে সত্যিকারের একজন অলরাউন্ডারের খেলায় চোখ লেগে যাবে সে আর বিচিত্র কী? সেই লেগে থাকা চোখ ছুটল ষোল বছর পরে- যখন জ্যাক ক্যালিস বিদায় বললেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। এই ষোল বছরে তার চওড়া কাঁধ আরও চওড়া হয়েছে, শেষের বছরগুলোতে বলের পেস কমেছে নিয়মিতই, কব্জির মোচড়ের ফ্লিক বা কাভার দিয়ে ইনসাইড আউট খেলা শটগুলোতে জোর কমেছে- দর্শক হিসেবে আমারও বয়স বেড়েছে, বোধবুদ্ধিও বেড়েছে- কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়ান্ট জ্যাকের খেলা দেখে গেছি সেই নয় বছরের বালকের উত্তেজনা নিয়েই।

 

 

আমার শৈশব-কৈশোরে ক্রিকেটীয় নায়কের অভাব ছিল না কোন হিসেবেই- গলি ক্রিকেটে তক্তা দিয়ে ওপেন করতে নামা অনেকেই তাদের অদৃশ্য এবডোমেন গার্ড এডজাস্ট করত শচীনের মত, ওয়াসিমের মত এক হাত দিয়ে আরেক হাতে ধরা বল লুকিয়ে হুট করে বল করত কত ওপেনিং বোলার, ব্রায়ান লারার মত শাফল করার চেষ্টায় কতজন যে ডানহাতি থেকে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হয়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই কোন। এম্ব্রোস, আনোয়ার, ওয়ার্ন, ক্লুজনার, গাঙ্গুলির পোস্টার বিকোত সব মোড়ের দোকানে, সবাই হতে চাইত একেকজন জয়সুরিয়া নাহলে মুরালিধরন- আমি হতে চাইতাম জ্যাক ক্যালিস। ব্যাটসম্যান ক্যালিস না, বোলার ক্যালিস না, ফিল্ডার ক্যালিসও না- ক্রিকেটার ক্যালিস।

 

 

এখানেই সম্ভবত ক্রিকেটে ক্যালিসের সবচেয়ে বড় অবদান- দলের বাঁধাধরা ক্রিকেটীয় রোলের চেয়ে অনেক বড় যার উপস্থিতি। যার টেস্টে ব্যাটিং গড় পঞ্চান্নের ওপর, সবরকম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ষাটটার ওপর সেঞ্চুরি, পঁচিশ হাজারের বেশি রান, তাকে আপনি নিঃসন্দেহে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে চোখ বন্ধ করে মেনে নেবেন। আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব মিলিয়ে পৌনে ছয়শ উইকেট একজন বোলারের, ওয়ানডে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগেও যার ইকোনমি পাঁচের বেশ নীচে, এবং টপ অর্ডারের বদান্যতায় শক্তভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া কোন দলের মিডল অর্ডারে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বলে কোমর ভেঙ্গে দেয়া যার কাছে ডালভাতের মত রেগুলার ব্যাপার, তাকে দলের যেকোন প্রয়োজনে বল ছুঁড়ে দেবেন আপনি পরম নির্ভরতায়। এবার এই দুটোকে একসাথে মেলান- তার সাথে যোগ করুন কয়েকশো ক্যাচ- যা পাবেন সেটাকে তথাগত ক্রিকেটীয় রোলে ফেলার ক্ষমতা নেই কারো- এমন খেলোয়াড় একটা জেনারেশনে একজনও আসে কিনা সন্দেহ। অলরাউন্ডার শব্দটাও যায় না ঠিক তার সাথে- ক্রিকেটের অলরাউন্ডাররা প্রায় সময়েই "জ্যাক অফ অল ট্রেডস"- সব কিছুই কিছু কিছু করতে পারেন, কিন্তু মাস্টার? একটাতেও না। কাজেই খেলার প্রতিটা রোলে যিনি মাস্টার তাকে স্রেফ অলরাউন্ডার বলে হাত মুছে ফেলবেন? কভি নেহি। টেস্ট ক্রিকেটের দেড়শ বছরের ইতিহাসে তার সাথে এক ব্র্যাকেটে রাখবেন এমন খেলোয়াড় যখন আপনি তিন চারজনের বেশি পাবেন না, তখনই বুঝবেন আপনি একজন কিংবদন্তিকে দেখছেন চোখের সামনে।

 

 

জ্যাক ক্যালিসকে নিয়ে সমস্যাটা হল তাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে সবাই শুধু নাম্বার নিয়ে আসে। কিছু করার নেই- যে ফ্লেয়ারের জন্য মানুষ ক্রিকেট দেখতে বসে, সেটা ক্যালিসের কখনও ছিল না। তার ব্যাটিং একশভাগ টেক্সটবুক- চোখের আড়ালে আড়ালে থেকেই তাই দুই ধরণের ক্রিকেটে দশ হাজারের ওপরে রান তার। সেই ব্যাটিং চোখ ধাঁধায় না, কিন্তু রান আনে প্রচুর। বোলারের রাতের দুঃস্বপ্নে হানা দেওয়ার মত ব্যাটিং নয় তার, কিন্তু তার সময়ের যে কোন বোলারকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন কতটা প্রাইজড ছিল তার উইকেট। বোলিংও ছিল বেশ সাদামাটা- টিপিক্যাল ফাস্ট মিডিয়াম বোলারের দীর্ঘ রানআপ, সাধারণ একশন, সুবোধ গতি, সামান্য সুইং আর হঠাৎ একটু বাউন্স- এই। কিন্তু যন্ত্রের মত ওভারের পর ওভার এক জায়গায় বল ফেলে যাওয়ার স্ট্যামিনা তাকে এনে দিয়েছে দুই ধরণের ক্রিকেটে আড়াইশোর ওপরে উইকেট। এককভাবে এই চারটা এচিভমেন্টের যে কোন একটাই নেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের- সেখানে তিনি একাই চারটা নিয়ে বসে আছেন। ফলাফল- জ্যাক ক্যালিসের ক্যারিয়ার বুঝি তাই স্রেফ কিছু সংখ্যাই। তার ফ্লেয়ার নেই, ক্যারিশমা নেই, দক্ষিণ আফ্রিকাকে বলার মত কিছু জেতাতে পারেন নি তিনি কখনই। তাই সর্বকালের সেরা টেস্ট বা ওয়ানডে টিমে তার নাম আসে না, ক্রিকেট এফিশিয়োনাডোদের রোমান্টিসিজমে তার জায়গা হয় না, তার নাম বাজারে বিকোয় না কোটি টাকা দামে। কিন্তু মনে রাখবেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলতে পারতেন কারণ তারা জানতেন উল্টো দিকের ক্রিজে ঝামেলা সামলানোর জন্য আছেন জ্যাক ক্যালিস। ক্যাপ্টেনরা পোলক-ডোনাল্ড-এনটিনি বা হালের স্টেইন-মরকেলকে মাথায় রেখে এটাকিং ফিল্ডিং সাজাতে পারতেন কারণ তারা জানতেন রানের চাকায় বাঁধ দেয়ার জন্য ক্যালিস আছেন। ডোনাল্ড-এনটিনি-স্টেইনরা ফুলকি ছোটাতে পারতেন কারণ তারা জানতেন স্লিপে বিশাল দুটো হাতের নির্ভরতা দেবেন ক্যালিস। এই জিনিস আপনি নম্বরের খেরোখাতায় দেখবেন না, দেখবেন না ক্রিকেট সাংবাদিকদের স্তুতিতে- এটা দেখার জন্য আপনাকে জ্যাক ক্যালিসের খেলা দেখতে হবে- একটা ম্যাচ না, দশটা ম্যাচ না- পুরো ক্যারিয়ারটা দেখবেন আপনি- তখনই কেবল আপনি বুঝবেন জ্যাক ক্যালিসের মাহাত্ম্য।

 

 

আজকে থেকে তিন বছর আগের এই দিনে শেষ হয়েছিল ক্যালিসের সাদা পোশাকের ক্যারিয়ার। শেষ টেস্টেও সেঞ্চুরি ছিল তার, হয়ত আরো কিছুদিন খেলে যেতে পারতেন- কিন্তু মাঠ থেকে শেষবারের মত নায়ক হিসেবেই বিদায় নিয়েছিলেন। সুদূর বার্মিংহামে বসে সেই ল্যাপ অফ অনার দেখেছিল নয় বছরের সেই ক্ষুদে ভক্ত- পঁচিশ বছরের খোলসে বসে।

ভাল থাকবেন কেপটাউনের কলোসাস- আমার দেখা ক্রিকেটের একমাত্র সব্যসাচী।

(সব ছবি গুগলের সৌজন্যে পাওয়া)