মহাকাব্যের শেষ ছত্র?
পোস্টটি ৪২০৬ বার পঠিত হয়েছে১।
অন্য অনেক কিছুর মতই, আমার টেনিস খেলা দেখা শুরু নানাবাড়িতে। আমার নানাভাই খুব খেলাভক্ত মানুষ, চাকরি থেকে অবসরের পর তার বিনোদনের প্রধান উৎস ছিল তাই টিভিতে খেলা দেখা। তাঁর সাথে বসেই আমার দেখা প্রথম টেনিস ম্যাচ; কোন ম্যাচ খুব স্পষ্ট মনে আছে এখনও- ২০০১ উইম্বলডন ফাইনাল- গোরান ইভানিসেভিচ বনাম প্যাট রাফটার; পাঁচ সেটের ধ্রুপদী সেই ম্যাচ জিতে ইভানিসেভিচ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন একমাত্র ওয়াইল্ড কার্ড হিসেবে উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হয়ে।
কথা হল, এই সাড়ে পনেরো বছর পরে, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালের আগে দিয়ে উইম্বলডনের গান গাচ্ছি কেন? আমি কোন ক্ষেতের মূলা যে আমার টেনিস খেলা দেখা শুরুর ইতিহাস পড়বে মানুষ বসে বসে? ধান ভানতে এই শিবের গীত গাওয়ার কারণ একটাই- ওই উইম্বলডন কিন্তু ইভানিসেভিচের জেতার কথা ছিল না- জেতার কথা ছিল পিট সাম্প্রাসের- কারণ ভদ্রলোক আগের আটবারের সাতটা ট্রফিই হেসেখেলে পকেটে পুরেছেন। সেবারও পুরতেন, যদি ফোর্থ রাউন্ডে এক টিনেজার বাগড়া না দিত। টিনেজারের নাম? রজার ফেদেরার।
২।
বাংলাদেশ তখন সবেমাত্র খুব জোর লাগিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে, খেলা দেখা বলতে ঘরে ঘরে শুধু ক্রিকেট তখন। সপ্তাহান্তে বড়জোর ঘন্টা দুয়েকের ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ বাদে বাকি টিভি-টাইমের পুরোটাই ক্রিকেটের দখলে, পত্রিকার খেলার পাতার নব্বই ভাগেও তাই। ২০০৫ সালের কথা বলছি- বছরে চারটা টেনিস গ্র্যান্ড স্ল্যামের এক দুইটা ম্যাচ দেখাই তখন অনেক কিছু। ২০০১এর টিনেজার ফেদেরার ততদিনে বেশ বড়সড় চ্যাম্পিয়ন, রডিক-হিউয়িটের নামও বেশ জানা। এর মধ্যে থেকে কিনা আরেক টিনেজার এসে ফট করে ২০০৫এর ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে ফেলল- তাও কিনা সেমিতে রজারকে হারিয়ে! সত্যি কথা স্বীকারে লজ্জা নেই, এই সেমিফাইনালের আগে আমি সেই গাট্টাগোট্টা স্প্যানিশ ছেলেটার- যার বয়স খুব বেশি হলে আমার চেয়ে বছর দুয়েক বেশি হবে- নামও শুনিনি, খেলা দেখা ত বহুদূর। এবারের টিনেজারের নাম? রাফায়েল নাদাল।
৩।
সেই শুরু- তার পরের প্রায় বারো বছর ধরে আমি নাদালের ভক্ত। ভক্ত হওয়ার কারণটা খুব হাস্যকর- সেও বাঁহাতি, আমিও বাঁহাতি। টেনিস খেলাটাতে বাঁহাতির ছড়াছড়ি নেই একেবারেই, সেই শুরুতে বলা গোরান ইভানিসেভিচের পর আর কোন বাঁহাতির খেলা দেখে মুগ্ধ হওয়াটা তাই সহজ কাজ ছিল না মোটেও। এমনিতে নাদালের খেলাতে শিল্পীর তুলির ছোঁয়া নেই অমন, বরং তাতে ভাস্করের অধ্যবসায়ই বেশি। অন্যদিকে রজার ফেদেরারের মত শৈল্পিক খেলোয়াড় টেনিসের ইতিহাসেই আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ- কাজেই ফেদেরারের ভক্ত সংখ্যা শুরু থেকেই বেশি। সাথে প্রতি বছর গন্ডা গন্ডা শিরোপা আর সপ্তার পর সপ্তা র্যঙ্কিংয়ের চূড়ায় বসে থাকা- ফেদেরারের ভক্ত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। সেই অস্বাভাবিক কাজটাই করে ফেললাম ২০০৫এ- বারো বছর পরেও সেটা গ্যাঁট হয়ে বসে আছে মাথায়।
৪।
যত সময় গেছে, ফেদেরার তত নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর তিনি, একটার পর একটা শিরোপা জিতে চলেছেন বছরের পর বছর- একটুও কি আলসেমি ধরেনি, একবারের জন্যও কি ছেদ পড়েনি অধ্যবসায়ে? ধরত হয়ত, যদি না ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে না থাকতেন নাদাল। সব জিততেন ফেদেরার, কিন্তু কাদামাটিতে এসে পা হড়কাত প্রতিবছর- মাটির রাজাকে তার কোর্টে এসে হারিয়ে যাবার সৌভাগ্য এত বছরেও হয়নি সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড়ের। সেটার প্রতিশোধ তুলে নিতেন ঘাসের কোর্টে- ২০০৮এ সেখানেও যতি পড়ল, নিজের রাজ্যে হেরে বসলেন নাদালের কাছে, সাথে খুইয়ে বসলেন র্যাঙ্কিয়ের শীর্ষস্থানও। ফিরে আসতে দেরি করলেন না মোটেও- সে বছরই জিতলেন ইউএস ওপেন। নাদাল শক্ত জবাব দিলেন পরের বছরের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে- জবাবটা এত শক্ত ছিল যে সেই ফাইনালকে এখনও ধরা হয় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেরা ম্যাচ হিসেবে। ফেদেরারের জবাবটাও তৈরি ছিল বুঝি- প্রথমবারের মত ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে নিলেন সেবার- দশ বছরের মধ্যে একমাত্র বারের মত নাদালের ফাইনালে না পৌঁছাতে পারার সুযোগ কাজে লাগিয়ে। এই রাজ্য খোয়ানোর দুঃখেই কিনা- ২০১০এ নাদাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেললেন পুরো টেনিস সার্কিট- তিন তিনটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেন- যার মধ্যে পরম আরাধ্য ইউএস ওপেনও ছিল। ফেদেরার সন্তুষ্ট থাকলেন শুধু অস্ট্রেলিয়ান ওপেন নিয়েই।
৫।
ফেদেরার আর নাদালের পুরো ক্যারিয়ারটাই গেছে এরকম ইঁদুর-দৌড় দৌড়ে। তাদের দ্বৈরথের মত কোন কিছু আর কোন খেলায় কোনকালে আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে ক্রীড়া-ইতিহাসবিদদের। সমস্যা হল- সংখ্যা দিয়ে এই দ্বৈরথের মাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টার মত বোকামি হয় না আর। দু'জন একেবারেই দুইমেরুর খেলোয়াড়- একজন মুনি-ঋষিদের মত সৌম্য- আরেকজন রেসের ঘোড়ার মত পাগুলে। একজনের ওয়ান-হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ডে পিকাসোর তুলির ছোঁয়া- আরেকজনের ফোরহ্যান্ডে সুপারকারের সমান আরপিএম। একজন সার্ভ আর ভলির তোড়ে উড়িয়ে দেন নেটের ওপাশের জনকে, ত আরেকজন বেজলাইন ধরে দৌড়ে খাটিয়ে মারেন। একজন ঘাসের কোর্টে ফুল ফোটান ত আরেকজন লাল মাটিতে তুর্কি-নাচন নাচান। এই এত তফাতের পরও দু'জন এসে মেলেন এক বিন্দুতে- মানুষ হিসেবে। পরিসংখ্যানের হিসেবে তাদের দ্বৈরথের সমকক্ষ হয়ত আরও পাবেন (টেনিসেই আছে- বিশ্বাস না হলে নাদাল-জোকোভিচের দ্বৈরথের হিসেব দেখে আসুন গিয়ে)- খেলোয়াড়ির হিসেবে আর পাবেন না। স্পোর্টসম্যানশিপের পরাকাষ্ঠা বলে যদি কিছু দেখতে চান- দেখে আসুন এই দুইজনের খেলা। একজন আজকে আরেকজনকে হারাচ্ছেন ত আরেকজন সেটার বদলা নিচ্ছেন দু'দিন পরেই, কিন্তু বদলাবদলির পুরোটাই ওই আয়তাকার কোর্টের মধ্যে- খেলাশেষে দু'জনের মধ্যে আপনি রেষারেষির কোন রেশই পাবেন না। দুজনেই দুজনের স্বঘোষিত ভক্ত- বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় সেটা স্বীকার করে নিতে কার্পণ্য করেননি দুজনের কেউই। এই এত বছর পরেও একজনের আরেকজনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ- বারো বছর পরেও একজন আরেকজনকে ফাইনালে পেয়ে কিশোরদের মতই উত্তেজিত।
প্রতিপক্ষের প্রতি এই সম্মান, এই শ্রদ্ধা আপনি খুব বেশি দেখেছেন কি? মনে ত হয় না।
৬।
Time, thou art a harsh mistress!
সময় জিনিসটা বড্ড কেমন- কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। বয়স ছুঁয়েছে দুই কিংবদন্তিকেই। পঁয়ত্রিশে পা দিয়েছেন রজার ফেদেরার- ধার কমেছে, ভার কমেছে। ত্রিশে পা দেয়া নাদালের আসল শত্রু ইনজুরি- খেলার ধরণের কারণেই যেটা তাকে ভুগিয়েছে ক্যারিয়ারজুড়ে। নাদালের নামের পাশে কোন গ্র্যান্ডস্ল্যাম নেই দু'বছরের ওপরে- ফেদেরারের গ্যাপ তার চেয়েও আরো দু'বছর বেশি। ফুরিয়ে গেছেন দু'জনেই- এমনটা ধরে নিয়েছিলেন সবাই। জোকোভিচ-মারে-ভাভরিঙ্কারা দোর্দন্ড প্রতাপে উঠে এসেছেন- কাজেই তাঁরা দু'জন ফিরে আসবেন সে আশাটাও বুঝি দিন দিন অলীক হচ্ছিল। সেইসব সংশয়বাদীদের মুখে চুনকালি মাখতেই কিনা- টেনিসঈশ্বর মুচকি হাসলেন। তাই, আর মাত্র চব্বিশটা ঘন্টা, তারপর ফেদেরার নামবেন সবরকম কোর্টে কম করে পাঁচটা গ্র্যান্ডস্ল্যামের বৃত্ত পূরণের আশায়। আর চব্বিশটা ঘন্টা, নাদাল নামবেন সব ক'টা গ্র্যান্ড স্ল্যামের ট্রফিতে কম করে দু'বার নিজের নাম লেখানোর স্বপ্ন পূরণে। আরেকবার আমরা দেখব ঋষির সাথে ম্যাটাডোরের লড়াই, আরও একবার দেখব পেইন্টারের সাথে ভাস্করের যুদ্ধ, আরেকবার মাতাল হব সর্বকালের সেরা দ্বৈরথের সুধায়।
এটাই কি শেষবারের মত? আমি ভবিষ্যতবক্তা নই- হয়ত এটাই শেষ, হয়ত না।
কিছু কি এসে যায় তাতে?
- 0 মন্তব্য