• ক্রিকেট

লাভ, লাই, ড্রামা

পোস্টটি ৬৮২৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পৃথিবীর সৌন্দর্য নাকি একা একা উপভোগ করা যায়না। জীবনের অর্থ খুঁজতে হলেও নাকি পাশে একজন ভালোবাসার মানুষ লাগে! সেই ভালোবাসার সংজ্ঞাও আবার বিচিত্র- কালের প্রবাহে গহীন ভালোবাসা হয়ে যায় অশান্তির আধার, আবার বিষময় কোন সম্পর্কের অন্তঃকোঠায় জন্ম নেয় ভালোবাসার ফুল। লেসলি হিলটনের ব্যাপারটাও তাই- ক্রিকেট-জীবন সেখানে মিলেমিশে একাকার। ক্রিকেটার হতে পারেন তিনি, কিন্তু জন্ম তো নিয়েছিলেন মানব সমাজেই। কাঠের ব্যাট-বলে তো কেবল মাঠের ক্রীড়া চলে, মানব মনের ক্রীড়া তো সেই জড়বস্তুর দক্ষতায় বিবর্তিত হয়না! তবে দুটো ক্রীড়াই সমান চিত্তাকর্ষক, টেস্টের কোন সেশনের মতো ভালোবাসাতেও হটাত ঘূর্ণন আসে, খেলার লাগাম যেমন হুট করেই লাগামহারা হয়ে যায়, জীবনটাও তো কখনো কখনো সেই পাগুলে সেশনের মতো হয়ে যায় টালমাটাল।

হিলটন জন্মেছিলেন শত বর্ষ আগে, অতলান্তিকের বিশালতা গায়ে মেখে। জ্যামাইকান হেসলির ছোটবেলা কেটেছে মহাসমুদ্রের বালুকাবেলায়, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও স্বপ্ন দেখেছেন অতলান্তিকে প্রত্যহ অস্ত যাওয়া লাল সূর্যের চাইতেও বড়। পেস বোলিং খুব ভাল পারতেন, তাই ভেবেছিলেন এই সামর্থ্য দিয়েই উড়াবেন সফলতার পাল। ভালোই করেছিলেন তিনি, একুশ বছর থেকেই নিয়মিত ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। ৪০ ম্যাচে প্রায় ২৫ গড়ে ১২০ উইকেট, পরিসংখ্যান বলছে বোলার হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলেন না।

লেসলির টেস্ট খেলার স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৩৫ সালের সূচনায়, এক অদ্ভুতুড়ে টেস্টের মধ্য দিয়ে। খেলা শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই বৃষ্টির তোপ বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে। তখন তো আর উইকেট বা আউটফিল্ড কিছুই ঢেকে রাখা হত না; আর ম্যাচের দিন সকালে বৃষ্টি না থাকাটাই ছিল খেলা শুরু হবার সবচাইতে বড় কারণ। টসে জিতে ইংল্যাণ্ড অধিনায়কের বোলিং করবার সিদ্ধান্তটা ছিল একেবারেই সঠিক, চষা ক্ষেতের মত ক্রিকেট পিচে স্বাগতিকদের ১০২ রানে অলআউট করতে ইংল্যাণ্ডের লেগেছিল মাত্র ৪৭ ওভার।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজের বোলাররা অবশ্য এই স্কোরটাকেই অনেক বড় করে দিয়েছিলেন স্বাগতিকদের জন্য। মাত্র ২৯.৩ ওভারে ফেলে দিয়েছিলেন সাত উইকেট- লেসলি হিলটন ছিলেন সবচাইতে কিপ্টে; মাত্র আট রান খরচায় ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন ইংলিশ মিডল-অর্ডার। তবে টেস্টে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও- ইংলিশ ক্যাপ্টেন বব ওয়াইটের পরবর্তী চালটা আধুনিক ক্রিকেটের জন্য মোটামুটি শেষ কথাই! একই কথা প্রযোজ্য জ্যাকি গ্রান্টের পালটা চালের ক্ষেত্রেও। বব ওয়াইট ঐ ৮১ রানেই ইনিংস ঘোষণা করে দেন বৃষ্টির পর পিচের সুবিধা নিতে! জ্যাকি গ্রান্টও একই কাজ করেন, ওয়েস্ট ইণ্ডিজের ৫১ রানে বৃষ্টি নামায় তিনি যখন ইনিংস ঘোষণা করেন, তখন স্বাগতিকদের লিড মাত্র ৭৩!

1

জ্যাকির ফাটকাটা অবশ্য বুমেরাং হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির পর খটখটে রোদ উঠায় ব্যাট করা তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। মার্টিন্ডেল ৫ উইকেট নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইংল্যাণ্ডের জয়রথে কোন বাঁধা হতে পারেননি। লেসলি নিয়েছিলেন এক উইকেট।

লেসলি হিলটনের অভিষেক সিরিজটা অবশ্য জয়েই রাঙ্গানো ছিল। বাকি তিনটি ম্যাচের মধ্যেই দুইটিই ওয়েস্ট ইণ্ডিজ জিতে নিয়েছিল, ১৬ উইকেট নিয়ে লেসলি সেই সিরিজে বেশ চমৎকার ভূমিকা রেখেছিলেন।

পরের চার বছর আর জাতীয় দলের খেলা ছিল না, আন্তর্জাতিক সীমানায় লেসলির পথচলা থমকে ছিল ঐ চার টেস্টের গণ্ডিতেই। ১৯৩৯ এ ইংল্যাণ্ড সফরের জন্য দল ঘোষিত হল, কিন্তু মধ্য ত্রিশে থাকা লেসলির জায়গা হলো না সে দলে। জ্যামাইকান মানুষ ক্ষেপে গেল, বোর্ডের এই অনুচিত কর্মের জবাব দিতে নিজেরাই তৈরি করল ফাণ্ড। ফাণ্ড থেকে অর্জিত ৩০০ পাউণ্ডে লেসলি দলের সাথেই চললেন ইংল্যাণ্ড। বোর্ডের স্কোয়াডে থাকেননি, তবে দুটো টেস্ট ঠিকই খেলেছিলেন! ব্যর্থ হয়েছিলেন ভয়াবহভাবে, জ্যামাইকানদের আস্থার প্রতিদান না দিতে পারায় ঐ বছরই ছেড়ে দেন খেলা। জীবনের টেস্ট ম্যাচের লীলাখেলার সূচনাটাও সেখান থেকেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে ফোরম্যান হিসেবে জ্যামাইকান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। সেখানেই প্রেমে পড়েন এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের মেয়ের। প্রেমের অতলান্তিকে ডুবে যাওয়া লার্লিন রোজ তখন বংশ, অর্থ, সম্মান এগুলোর কিছুই পরোয়া করে নি। কিন্তু সামাজিক মর্যাদায় অনেক নিচু লেসলিকে মেনে নিতে রোজের উচ্চবিত্ত বাবার ব্যাপক আপত্তি ছিল। মেয়ের থেকে দূরে রাখতে লেসলির নামে মামলাও ঠুকেছিলেন তিনি! কিন্তু ভালবাসা হার মানে নি, শেষ পর্যন্ত লেসলির সাথেই রোজের বিয়ে হয়। পরের বছর তাদের ঘরে সন্তানও আসে!

ক্রিকেটই যেখানে নাটকীয় সেখানে জীবন তো আরো বড় রঙ্গমঞ্চ! লেসলির টানে উঁচু ঘর ছেড়ে নেমে আসা সেই রোজই পরে শুরু করে বিশ্বাসঘাতকতা! চাকরির নামে নিউ ইয়র্ক এসে অবোধ প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তৃতীয় মানুষ ফ্রান্সিসের সাথে। লেসলির কাছে নিউ ইয়র্কবাসী বন্ধুরা এই প্রেমের ব্যাপারে জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠাতো। কিন্তু রোজকে জিগ্যেস করা হলে সে নিছক অস্বীকার করত।

এক সময় লেসলির জিদের কাছে রোজ হার মানে। শক্ত প্রমাণ হাজির করার পর রোজ স্বীকার করে নেয় যে, লেসলিকে দিয়ে তার পোষাচ্ছে না। সে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া, উচ্চশিক্ষিত এবং সংস্কৃতিমনা। লেসলির সাথে তার যায়না, তার মানসিক চাহিদা লেসলির মনের দেয়ালে বরাবরই উপেক্ষিত। শেষ সেশনে এসে ম্যাচ হেরে যাবার মতো অবস্থায় পরে লেসলি তখন নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারেনি; অনেক অপমান, তিরস্কার, সংগ্রাম সয়ে যে মানুষকে সে নিজের করে নিয়েছিল, সেই মানুষকেই একে একে সাতটা গুলি করে সে হত্যা করে! ঐ রাতেই!

rsz_thumbnail

আদালতে লেসলির আত্নপক্ষ সমর্থনের বিষয়টা ছিল খুবই হাস্যকর। ঝগড়ার এক মুহুর্তে সে নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু ভুলক্রমে সেই গুলি নাকি রোজের গায়ে লেগে যায়! সাতটা বুলেটের আঘাত যেহেতু কোনভাবেই সেই ধারণাকে সমর্থন করেনা, তাই আদালত তার জন্যে মৃত্যুদণ্ডই ধার্য করে দেয়। ১৯৫৫ সালের ১৭ মার্চ সে দণ্ড কার্যকর করা হয়। লেসলিই ইতিহাসের একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটার, যিনি হত্যার অভি্যোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন।

হিলটনের হয়ে বিখ্যাত দুজন আইনজীবী মামলা লড়েছিলেন। এঁদের একজন নোয়েল নিথারসল ছিলেন জ্যামাইকা ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক। স্ত্রীকে হত্যা করলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছিলেন। যেদিন তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয় সেদিন ছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে টেস্টের প্রথম দিন। কাকতালীয়ভাবে সে ম্যাচটিও হচ্ছিল কেনসিংটন ওভালে, যেখানে লেসলি হিলটন তার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছিলেন। ঐদিন মাঠে বেশ কিছু দর্শক প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছিলেন, যাতে লেখা ছিল ‘Hang Holt, Save Hylton’!