• ফুটবল

আরো একটি শোকগাথা

পোস্টটি ১৩৪৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রথম আলোর “খেলার লেখা, লেখার খেলা” বিজ্ঞাপনটা দেখে নস্টালজিয়ায় হোক বা পুরষ্কারের বইগুলোর লোভে হোক – লিখতে বসে গেলাম। আকাশি নীলের সমর্থক হওয়ায় যদিও এযাবতকালে দীর্ঘস্থায়ী সুখের অনুভূতি হয়নি তবুও মায়া ভালোবাসার কারণে সমর্থন এতটুকু কমেছে কেউ বলতে পারবে না। নস্টালজিয়াই যেহেতু লেখার উপজীব্য তাই আমার দেখা আর্জেন্টিনার সেরা বিশ্বকাপটাই রোমন্থন করছি।

বিশ্বকাপের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সফল দল গুলোর বীরত্বগাথার চেয়ে আশার ফুল ফুটিয়ে রূপকথা না হওয়া গল্পগুলোই বেশ আলোচিত। মারাকানার মরাকান্না, জিকো-ফ্যালকাও-সক্রেটিস দের ৮২’র ব্রাজিল, অপার্থিব ক্রইফের টোটাল হল্যান্ড, গ্যালোপিং মেজর আর ম্যাজিকাল ম্যাগায়ার্স, ইউসেবিওর পর্তুগাল – বিশ্বকাপের বিশ্বগাথার বহুপঠিত গল্প।

 আরেকটি হাহাকার তোলা দলের কথা খুব কম সময়েই বলা হয় – ২০০৬ এর পেকেরম্যানের আর্জেন্টিনা। টানা তিনবারের আর্জেন্টিনা হন্তারক জার্মানির সাথে শেষ বিশ্বকাপের শেষ মুহুর্তে গোটশের গোলে হারা ম্যাচটাই হয়তো অনেকের কাছে আর্জেন্টিনার অন্যতম সেরা হতাশা বলে মনে হতে পারে, কিনতু আর্জেন্টিনার সেবার ফাইনালে যাওয়াটাই অনেক মনে হয়েছিলো আমার কাছে। গতবারের টিমে অতিমানব মেসি থাকলেও তার সাথে ছিল খেলা ভুলে যাওয়া শিশুতোষ কিছু নীল জার্সির প্লেয়ার, সেই টিমের ফাইনালে ওঠাই অনেক বড় অর্জন। যদিও কষ্ট কম হয়নি এত কাছ থেকে আনন্দমিছিল পন্ড হওয়ায়।

এদিক থেকে ২০০৬ এর আর্জেন্টিনা ছিল পরিপূর্ণ একটি দল। মাঝমাঠে অলস সৌন্দর্যের প্রতীক রিকুয়েমে যেন সূর্যের মতন, সর্বচ্ছেদী আলোর মতো সহখেলোয়ার দের নিরন্তর বল যুগিয়ে গেছেন। প্রতিপক্ষ আক্রমনে – ভয় নেই, আছেন সোরিন, আয়ালা, হেইঞ্জের মতো সেনা, তাদেরও পার করতে পারলে আটকে দেবে আবোনদানজিয়েরির প্রশস্ত হাত। আক্রমনে ক্রেসপো, সাভিওলা, তেভেজ, রদ্রিগেজ আর ছোট্ট জাদুকর মেসি।

এই ভয়ংকর আর্জেন্টিনার সর্বগ্রাসী রুপ দেখেছিলো তৎকালীন সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো। ফুটবলে সুন্দর যা যা থাকা সম্ভব তার সবই ছিলো ৬-০ গোলের এই ম্যাচে, ছিলো না শুধু সার্বিয়া! ক্যাম্বিয়াসোর তুলির শেষ আচর লাগানো ২৫ পাসের গোলটি ছিল রূপকথার মতোন। শেষের দিকে পেকেরম্যান ছেড়ে দিলেন তার ঝোলার চমক মেসিকে। অল্পসময়েই মন্ত্রমুগ্ধচ্ছটায় আচ্ছন্ন করে রাখল টেলিভিশনের পর্দা। খেলা দেখে এতটা উচ্ছ্বসিত কখনও হইনি। মনে হল, আহ মরে গেলেও আর কোনো আফসোস থাকবে না!

আর্জেন্টাইন ডাচ রাণী ম্যাক্সিমাকে দোটানা থেকে বাচাতেই যেন ড্র হল পরের হল্যান্ড- আর্জেন্টিনা ম্যাচ। কিন্তু চোখ ধাধানো আক্রমনে মাঠ মাতিয়ে রেখেছিলো আলবিসেলেস্তেরা।

গ্রুপ পর্ব শেষে প্রথম প্রতিপক্ষ মেক্সিকো। সহজ প্রতিপক্ষ বলেই কিনা প্রথমের ক্ষুরধার আক্রমনে বিচলিত আর ভ্রান্ত মনে হল আর্জেন্টাইন রক্ষণ কে। পাঁচ মিনিটেই গোল তুলে নেয় মার্কেজ, গোল খেয়েই যেন সৎবিৎ ফিরে পেলো ঘুমন্ত দানো। অনন্য অসাধারন আক্রমন থেকে তুলে নিলো সমতাসুচক গোল অল্পসময়েই। এরপর দু দলই আক্রমনের পসরা সাজিয়ে বসল। বার কয়েক আর্জেন্টিনার ওষ্টাগত প্রাণ রক্ষা করলেন আবোনদানজিয়েরি আর মেক্সিকোকে রক্ষা করলেন ক্রেসপোরা। ফল বদলাতে তুরুপের তাস মেসিকে নামিয়ে দিলেন পেকেরম্যান, আক্রমনের ধার বৃদ্ধি পেল। রিকুয়েমে, মেসি আর তেভেজে চেপে ধরা আক্রমনে বল পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেছিলো মেক্সিকোর। এর মাঝে মেসির একটি গোল বাতিল হল ভুল অফসাইডে, এজন্য যেতে হল অতিরিক্ত সময়ে। অবশ্য দর্শকদের হতাশ হতে হয়নি, বরং অসাধারাণ এক ভলিতে অতিরিক্ত সময়ের অতিরিক্ত আনন্দই উপহার দিয়েছিলেন রদ্রিগেজ। আনন্দ চলল শেষ মিনিট পর্যন্ত।

এবার সেই কোয়ার্টার ফাইনাল। প্রতিপক্ষ স্বাগতিক জার্মানি আর অলিম্পিয়াস্টাডনের ৭২,০০০ দর্শক। প্রথমার্ধে দেখে শুনে খেলল দু’দলই, সাথে হাত পা জড় করে বসে রইলাম আমরাও। বলের দখল বেশিরভাগ সময়েই আর্জেন্টিনার পায়ে। শুরু থেকেই আশা ছিলো মেসি নামবে কিন্তু পেকেরম্যানের উপরই ভরসা রাখতে হল। বিরতির পরপরই কর্ণার পায় আর্জেন্টিনা। মায়েস্ত্রো রিকুয়েমের বাড়ানো ছুটন্ত বলে মাথা ছোয়ালো উড়ন্ত আয়ালা। সাথে সাথে গর্জে উঠল টেলিভিশন, গর্জে উঠলাম আমি, সাথে পুরো মহল্লা!

এবার দাতে নখ কামড়ে অপেক্ষার পালা। জার্মানি একের পর এক শটে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছিল আর আল্লাহ-আল্লাহ করছিলাম, রক্ষণ ভরসা হয়ে ছিলো। কিনতু ভাগ্য সরে যেতে শুরু করেছে। ৭১ মিনিটে গোল বাচাতে যেয়ে আহত হলেন গোলে প্রাচীর হয়ে থাকা আবোনদানজিয়েরি, উঠে যেতে হল, মাঠে নামল কোন ম্যাচে না খেলা ফ্রাঙ্কো।

franco

আশঙ্কা হয়েছিল, ভয় ধরেছিল, পরে তা সত্যি হল ৮০ মিনিটে ক্লোসার গোলে। ইতোমধ্যে মাঠে নেই গোল বাচাতে উঠে যাওয়া রিকুয়েমে, সাব শেষ বলে নামানোর উপায় নেই মেসিকেও। হঠাৎ অতি রক্ষনাত্মক হওয়ার মানসিকতাই দূরে ঠেলে দিলো দলকে। তবুও চেষ্টা করে গেছেন ক্যাম্বিয়াসো, রদ্রিগেজরা। দ্বিতীয়ার্ধ শেষের আগে বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তে পেনাল্টি বঞ্চিত করল আর্জেন্টিনা কে, সেটা না হলে হয়ত ...... যাইহোক ভাগ্যদেবতা ততক্ষণে জে আর আর মার্টিনের সাথে আকাশি নীলের শোকগাথা লিখতে বসে গেছেন। মনে হচ্ছিলো পেনাল্টি ঠেকাতে পারবে না ফ্রাঙ্কো, পারলোও না, তার সাথে পারে নি আয়ালা, পারলো না ক্যাম্বিয়াসো, পারলো না নতুন শতকের নতুন ধারার ফুটবল দেখানো পেকেরম্যান। শেষ হলো আরো একটি আশার গল্প।

আমি ক্রুইফের টোটাল ফুটবল চাক্ষুস দেখিনি, দেখিনি দোর্দন্ড প্রতাপশালী পুসকাসদের ধরাপতন। কিন্তু মায়াবী সুন্দরের মূর্ছনা তোলা রিকুয়েমে বাহিনীর হারিয়ে যাওয়ার সাক্ষী হওয়া কোনো অংশে কম কষ্টের না। যাইহোক প্রতিবারের মতো এবারও অকুন্ঠ সমর্থন আর প্রার্থনা থাকবে টিম মেসির জন্য, থাকবে চ্যানেল না পালটানো বা বসার জায়গা না পাল্টানোর মতো কুসংস্কারও। ইনশাল্লাহ চার বছর পর হবে- এই আশা যেনো এবারো না করতে হয় সেই প্রত্যাশাই থাকবে।