'ফিরে আসার' নাকি 'উপরে ওঠার'?
পোস্টটি ৮৯২৯ বার পঠিত হয়েছেদেশটা(!) ভারী মজার। ভারী মজার তাদের ক্রিকেটটাও। এমনিতেই ক্রিকেটে তাঁরা 'বনেদী বংশ'র বংশধর। তবে সেখানে এখন কিছুটা 'যদি কিন্তু' লেগে গেছে বৈকি! লক্ষীর সেই মঙ্গলঘট যদিও বা পুরোটা খালি হয়নি, আবার পূর্বসূরিদের মত সেই ঘট টইটুম্বুরও নেই। ঘটের তলায় যা পড়ে আছে তা দিয়েও কিন্তু চমক কম দেখাচ্ছে না তাঁরা!
শেষবার যখন আমরা সেখানে খেলতে গেছি, অবস্থা খানিকটা করুণই ছিল আমাদের। স্বপ্নের মত ২০১২ আর ২০১৩ কাটানোর পর ২০১৪ তে এসে লাগল শনির দশা। প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কা সিরিজ, ঘরের মাঠে পিচ বুঝতে না পারা আর অতিমাত্রায় ডিফেন্সিভ কাপ্তানীতে সাঙ্গা একাই মেরে দিলেন ৩০০! এরপর ওয়ানডে ম্যাচে জেতা ম্যাচ সিচুয়েশনে হিউজ বল আর আর তেমনই মাইনর পরিমাণ রান করতে পারলেন না আল আমিন! এরপর টি-২০ সিরিজে শেষ ওভারে ১৫ নিতে পারলেন না ইনফর্ম বিজয়। একের পর এক ক্লোজ ম্যাচ হারে দেশের ক্রিকেট যখন টালমাতাল তখন হেরে গেলাম সহযোগী দেশ আফগানিস্তানের কাছে।
সেই বছর টি-২০ বিশ্বকাপে হংকং এর কাছে হার, দেশের ক্রিকেটে মৌসুমি সমর্থকদের তখন যায় যায় রব। এমনই এক ক্রান্তিকালে গুরু জার্গেনসন পদত্যাগ করলেন। নতুন কোচের প্রথম এসাইনমেন্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে গেল বাংলাদেশ। ভেঙে পড়া বাংলাদেশের ভেঙে পড়া ব্যাটিং লাইন আপ এর সুযোগ নিয়ে প্রথম ম্যাচে অলমোস্ট দেড়শ বলে বিজয় মেরে দিলেন একশ। একখানা ম্যাচও আর জেতা হল না তখন! একার্থে তখন ট্যুরটাকেই অর্থহীন লাগছিল। ওহ, সাথে কিন্তু আবার অস্ত্রের সেরা তূণও ছিল না!
শনির দশা কেটে গেছে। সেবার চাকিং এর অভিযোগ পাওয়া আল আমিন এবার স্কোয়াডে নেই। দেড়শ বলে একশ করা বিজয় আর নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারেননি। আধুনিক ক্রিকেটের স্ট্রোক মেকার এর চাহিদা পূরণে ব্যার্থ বিজয় থেকে গেছেন দলের বাইরেই।
যা হোক, এতসব 'গাজীর গানে' র মোদ্দাকথা হল ৪ বছর পর আবারও উইন্ডিজ সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, চাহিদা ভিন্ন, লক্ষ্য ভিন্ন, ভিন্ন দলের মানসিকতাও। তবে ক্রিকেট দেবী এক সুতোতে মিলিয়ে দিয়েছেন দুই সিরিজের দুই 'পরিচ্ছেদ' কে। সেবারও নতুন কোচ হাতুরু দায়িত্ব নিয়ে চলে গেছিলেন উইন্ডিজ। এবারও রোডস দায়িত্ব নিয়ে একই পথের পথিক।
ইতোমধ্যেই টেস্ট স্কোয়াড ঘোষণা হয়েছে। এই প্রথম উইন্ডিজের বিপক্ষে কোন টেস্ট সিরিজ বাংলাদেশ র্যাংকিং এ এগিয়ে থেকে খেলতে নামছে।
স্কোয়াডে নিশ্চয়তা
টেস্ট স্কোয়াডে পাঁচজনের জায়গা পাকাপোক্ত ধরে ফেলা যায়।
ওপেন করবেন তামিম। ৩ এ নামবেন মুমিনুল। চারে মুশফিক। পাঁচে সাকিব। ছয়ে রিয়াদ। সাথে ওপেনিং পজিশনে নন স্ট্রাইকে ইমরুল কায়েসের অন্তর্ভুক্তিও মোটামুটি নিশ্চিত ধরে ফেলা যায়। সমস্যা থাকবে বাকি স্পটগুলো নিয়ে। বাকিরাই বা কোন রোল টা প্লে করবেন?
নাজমুল হোসেন শান্ত
বাংলাদেশ ক্রিকেটে ইয়াং নার্সিং আজন্ম চাওয়া। একের পর এক ডেব্যু ম্যাচের চমক, তারপর হারিয়ে যাওয়া এদেশের ক্রিকনাট্যের চিরায়ত দৃশ্য। প্লেয়ারদের পরিচর্যার অভাব এদেশের ক্রিকেট বোর্ডের বহুদিনের পুরোনো অভ্যাসের মধ্যে পড়ে। কিন্তু অভাগার সাম্রাজ্যেও কেউ কেউ লটারি জিতে ফেলে। নাজমুল হোসেন শান্ত আমাদের ক্রিকেটে সেই 'বিরল প্রজাতির' একজন যাকে অন্তত গ্রুমিং করে এই পর্যায় অব্দি আনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে টেম্পার ধরে রাখা, দলের বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখা, কিংবা অত্যাধিক তাড়াহুড়ো না করা, শান্ত কে এদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ভাবা হত অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এত কিছু নিয়ে শান্ত খেলবেন টা কোথায়? এর আগে প্রথমে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করি, ইমরুল কায়েস কি এখনও জায়গা পাবেন? একজন নিয়মিত টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে লাস্ট ১০ ইনিংসে তিনি কয়টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন? আচ্ছা ন্যাশনাল টিম এর স্ট্যাটিসটিক্স বাদ দিচ্ছি। শেষবার হওয়া বিসিএল/এনসিএল এ তিনি সাকল্যে সেঞ্চুরি করেছেন একটি। সেখানেও আবার নেমেছেন তিন নম্বরে। প্রথমত তিনি কি আবারও একটি সুযোগ পাবেন? দ্বিতীয়ত যদি পেয়েই যান, ডমেস্টিকে তিনে খেলা ইমরুল কি ন্যাশনালে ওপেন করবেন?
প্রথমটির উত্তর 'না' হলে শান্ত কে দিয়ে ইমরুল এর 'সোয়াপ' করানোর পক্ষে আমি। প্রথমটি 'হ্যা' হয়ে দ্বিতীয়টি 'না' হলে মিমিকে চারে ঠেলে শান্ত কে তিনে খেলালে মন্দ হয় না! তিনের চেয়ে চার নম্বরের পরিসংখ্যান কিন্তু মুমিনুলের ঢের ভাল!
পেস বোলিং লাইনআপ
টেস্টের পেস বোলিং লাইন আপ এর কিছু স্ট্রাটেজি আছে। দলে দুইজন বোলারের থাকা অত্যাবশ্যকীয় এখানে। প্রথমত একজন 'এক্স-ফ্যাক্টর' থাকবেন যিনি ক্রুশাল টাইমে উইকেট এনে দেবেন। দ্বিতীয়ত একজন 'বোলিং মেশিন' থাকবেন যিনি লম্বা লম্বা স্পেলে বল করে যাবেন। মুস্তাফিজের ইঞ্জুরিতে দলে প্রথমটির অভাব। মোহাম্মদ শহীদের ইঞ্জুরির পর ফর্মহীনতার সূত্রে দলে দ্বিতীয়টির অভাব বহু আগে থেকেই। দলের এই পেস বোলিং লাইন আপ নিয়ে তাই লম্বা-চওড়া কোন আশা করতে পারছি না। রুবেল কিংবা শফিউল টেস্ট ক্রিকেটের বোলিং রপ্ত করতে পারেননি কেউই। ডমেস্টিক লংগার ভার্সন না খেলা রুবেল আর সেই ডমেস্টিকেই কালেভদ্রে জ্বলে ওঠা শফিউল নিয়ে তাই আমি বেশি কিছু আশা করতে পারছি না। এবং এর সাথে আরেকটি যে সমস্যা জুড়ে দেওয়া যায় তা হল- এদের দুইজনের কেউই লম্বা কোন স্পেল বল করার জন্য পারফেক্ট নন। খুব সম্ভবত এই সুযোগে এক বিদেশ সফরে বাদ পড়ে আরেক বিদেশ সফরে দলে ফিরছেন কামরুল ইসলাম রাব্বি। এক সময় রাব্বি কে আদর্শ পেস বোলার মনে করা হলেও দিনে দিনে ফর্মহীনতায় সেই আশার আলো তিনি জ্বালাতে পারেননি। তবে নিয়মিত বিরতিতে বল করতে পারা, বৈচিত্র্যময় বোলিং একশন, আর সুইং করাতে পারা রাব্বির উপর প্রধান ভরসা করা ছাড়া উপায় কিছু আছে কি? শেষ সংযোজন আবু জায়েদ চৌধুরী রাহী। উইকেটের দুই পাশেই সুইং করাতে পারেন, টেস্টে ডে বাই ডে স্লো হওয়া উইন্ডিজ পিচে আবু জায়েদ কি একটা সুযোগ পাবেন?
স্পিন এ্যাটাক
ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেট 'বংশ পরম্পরায়' বাউন্সি ধরে ফেলা যায়। এই তথ্য শুনে যদি আপনার চোখে 'গ্যাবার পিচ' ভেসে ওঠে তাহলে বলতে হচ্ছে 'আজ্ঞে ভুল ভাবছেন'। বংশ পরম্পরার দাবি উইন্ডিজ উইকেট মানেনি সে তো বহুদিন হল। আবার বলা ভাল, কিছুটা মেনেও চলেছে! সত্যি বলতে উইন্ডিজের উইকেট এমনই এক বিরল প্রজাতির যেখানে সেরা স্পিনার উইকেট আদায় করতে পারবেন, আবার সেরা পেস বোলার আগুন ঝরাতে পারবেন। শেষবার যখন উইন্ডিজ সফরে গেছি, তখনও আমরা ধরাশায়ী হয়েছিলাম 'একটু জোরে বল করতে পারা' স্পিনার সুলেমান বেন এর কাছে। এরপর ঐ উইকেটেই শাদাব খান, রশিদ খানেরা ভেল্কি কম দেখাননি। আবার পেস বোলাররাও চুপ করে বসে থাকেননি। তাই উইন্ডিজ উইকেট কে 'গ্যাবা' মনে করে পুরো দায়িত্ব ভঙ্গুর পেস বোলারদের উপর দিয়ে দিলে আসলে ভীষণ খারাপ হয়ে যাবে। বরং তাইজুল মিরাজকেও দায়িত্ব টা নিতে হবে। গুরুদায়িত্ব নিতে হবে খোদ কাপ্তানকেই।
এই সিরিজে ভাগ্যদেবী কিন্তু নিছক একটা পরিহাস ও রেখেছেন। আগের বারের দলে 'নিষিদ্ধ' সাকিব আল হাসান এবার কিন্তু অধিনায়কই। সে যা হোক, এই সিরিজ টা কে আসলে কি বলে উপমা দেওয়া যায় সেই চিন্তা করছি। টেস্টে ক্রিকেটের মাপকাঠিতে ক্রমাগত উন্নতি করা বাংলাদেশের জন্য এটা হতে পারে 'উপরে ওঠার গল্প'! আবার আফগানিস্তানের কাছে টি-২০ ক্রিকেটে কাবুলিওয়াশ বাংলাদেশের কাছে এই সিরিজ হতে পারে 'ফিরে আসার গল্প'! তা ফিরে আসার নাকি উপরে ওঠার... কিসের গল্প মেনে নিয়ে খেলা দেখবেন সেই বিবেচনা আপনার ওপরই নাহয় ছেড়ে দিলাম।
- 0 মন্তব্য