• ক্রিকেট

ট্রাজেডি ফোর্টি থ্রি

পোস্টটি ২৬০৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

একটা অতিপরিচিত মজার গল্প দিয়ে শুরু করব। গল্পটির শিরোনাম 'অন্ধের হাতি দেখা'। যারা গল্পটি আগেই পড়ে ফেলেছেন তারা পরের প্যারা থেকে শুরু করলেও করতে পারেন (অবশ্যি যদি পড়তে চান তবেই)। আর যারা অতিপরিচিত এই গল্পটির সাথে একদমই পরিচিত নন তারা পরিচিত হয়ে নিতে পারেন। অতিপরিচিত গল্পটি তবে শুরু করা যাক। চার বোকা অন্ধ বন্ধু একবার নিজেদের মধ্যে ঠিক করে ফেলল তারা জগতের মজার মজার জিনিস গুলো দেখে ফেলবে। চোখ দিয়ে নয়, স্পর্শানুভূতি দিয়ে। জন্মান্ধ বলে আসলে প্রকৃতির রূপ সম্বন্ধে তারা একদমই ওয়াকিবহাল নয়। তো যেই ভাবা সেই কাজ। অন্ধ চার বন্ধু হাতি দেখতে বিশেষ পরিচর্যায় ঢাকা চিড়িয়াখানায় ঢুকে গেল।
প্রথম বন্ধু হাতির পা ধরে মতামত দিল 'হাতি দেখতে আসলে পিলারের মত'। দ্বিতীয় বন্ধু হাতির শুঁড় ধরে মতামত দিল 'হাতি দেখতে আসলে পাইপের মত ' । তৃতীয় বন্ধু হাতির পেটে হাত বুলিয়ে মত দিয়ে ফেলল, 'হাতি দেখতে বড়সড় কুলার মত '। চতুর্থ বন্ধু একটু ভেবে চিনতে উত্তর দেবে বলে ঠিক করল। সে হাতির শুড়, পা, পেট, লেজ ধরে বলল, 'হাতি আসলে গাড়ির মত দেখতে, মাঝে বসার জন্যে বড় আসন আছে। সামনে টানার জন্যে বড় দড়ি আছে, পিছে ধোয়া বের করার পাইপ আছে, নিচে অবশ্য চাকার বদলে পিলার! '

এরপর চার বন্ধু আসলে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা আমার আর জিজ্ঞেস করার সৌভাগ্য হয়নি। তবে হঠাৎ এই রম্যের উপস্থাপনের কারণ কি? কারণটা বলব, তার আগে গল্পটির সারমর্ম ধরে ফেলি। চার অন্ধ বন্ধু কখনও হাতি দেখেনি, কেউ তাদের হাতির বর্ণনাও দেয় নি। তাই তারা পরিচিত অবজেক্ট দিয়ে হাতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এই থিওরেম টা মনে হয় আমাদের ব্যাটসম্যানরাও প্রয়োগ করেছিলেন। প্রথমত তারা কখনও উইন্ডিজের মত বাউন্সি আর মুভমেন্টের উইকেটে খেলেনি। দ্বিতীয়ত ঘরের ডমেস্টিকে এরকম বৈচিত্র‍্যময় উইকেটে খেলতে দেওয়াও তাদের হয়নি। এই ধরণের পিচে তারা একেবারে অন্ধ ধরে ফেলা যায়। তাই যে যেমন ভাবে পেরেছেন উইকেটকে ব্যাখ্যা করে নক করার চেষ্টা করেছেন।

হাতি দেখাতে পুরো দোষটা চারজনকে দিয়ে ফেলা যায় কিনা আমি জানি না, তবে আমাদের ব্যাটসম্যানদের এই থিওরেম প্রয়োগে যে আসলে পুরো দোষটাই নিষ্পাপ ব্যাটসম্যানদের দিয়ে দেয়া যাবে এমন নয়। 'গুরুদোষ' টা নিয়ে নিতে হবে বিসিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের, খুব স্পেসিফিকভাবে বললে জয়দৃশ্যের শেষ অঙ্কে 'আমিই বলেছিলাম...' বলে মৌলিকত্ব ধরে রাখা ক্রিকনাট্যের জল ঢেলে দেয়া লোকটার।

তবে এখানে একটা কথা বলা জরুরী বলে মনে করছি। যদি অন্ধ অভিজ্ঞ হত তবে কি হত? প্রবীণ অন্ধ নাকি ইন্দ্রিয় শক্তি দিয়ে প্রকৃতি বুঝতে পারেন। তাই প্রায় ১০০০০ রান আর ৫০+ টেস্ট খেলা সিনিয়রদের কাছে যদি উইকেট-এনালাইসিস জিনিসটা একটু আধটু এক্সপেক্ট করি তাহলে কি অনেক বেশি বড় অপরাধ হয়ে যাবে?

আমি ক্রিকেট এক্সপার্ট নই। ক্রিকেট ম্যাচ বিশ্লেষণে পটুও নই। তবু সাদা চোখে কিছু বিষয় নজর এড়ায় নি। প্রথমত বলতে চাই, ৪৩ রানে অলআউট হওয়ার কোন ব্যাখ্যা হয় না। উইকেট বাউন্সি হোক অথবা টার্নিং, উইকেটে মুভমেন্ট থাকুক অথবা ভাঙা... পুরো দল মিলে ৫০ এর নিচে আউট হয়ে যাবে এই বিষয়টাকে কোন ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ডিফেন্ড করা যাবে না, এর কোন ব্যাখ্যাও দেয়া যাবে না। তবে একটি কথা এখানে বলে ফেলি।

কেমার রোচ যখন ইনিংসের শুরুতে বল করতে এলেন তখন তিনি যে লেংথে বা যে টেকনিক নিয়ে বল করছিলেন তার পরিবর্তন তিনি পরে করেছেন। আউট হওয়া বলগুলো আর ইনিংসের শুরু থেকে করা বলগুলোর মধ্যে পার্থক্য ছিল। আমাদের ব্যাটসম্যানরা এটাই ধরতে পারেননি। বলের পিচিং তারা পরে রিড করতে পারেননি। প্রথম দিকে এই বল করার পর কেমার রোচ ডানহাতি আর বামহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য পরে সম্পূর্ণ আলাদা দুই টেকনিকে বল করেছেন। কিংবা একটু গভীর থেকে বলা যায় বলগুলো ফান্ডামেন্টালি আসলে একই প্রকৃতিরও ছিল। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্যে বলগুলো অফ স্ট্যাম্পে পিচিং নিয়ে বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্যে বল অফ স্ট্যাম্পে পিচিং নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। এবার বাঁহাতি -ডানহাতি ভুলে গিয়ে যদি শুধুই বলগুলোর মুভমেন্ট দেখি তাহলে বল ডানেই মুভ করছিল। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে তা বাইরে গেলেও ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে তা ভিতরে!

আচ্ছা, পিচে যখন একজন প্লেয়ার ব্যাট করেন ড্রেসিং রুমে কি সেটা অন্যান্য ব্যাটসম্যানেরা দেখেন? তামিমের আউটটা দেখলে অন্তত মুমিনুল এর এত সহজে উইকেট বিলিয়ে দেবার কথা নয়। সাথে মিমির ফুটওয়ার্কের দায়টাকেও আলাদা করে দেখতে হবে। দেখতে হবে দূরের বলকে কাভারে ঠেলে দেওয়ার সুইসাইডাল মানসিকতাকেও। দলের সেরা ব্যাটসম্যান মুশি। তিনি ব্যাটে এসে বলের পিচিং বুঝতেই ভুল করে ফেললেন। বল ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল, বাঁহাতি তামিমের আউটের সাথে তিনি বলকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন কিনা আমি জানি না। যে মুভমেন্টে তামিম আউট হলেন সেখানে ডানহাতি হিসেবে ডিফেন্স করার চেষ্টা করলেন এবং এলবিডব্লিউ হলেন। রিয়াদের আউট হওয়া ছাড়া রোচের ৫ ওভারের স্পেলের প্রায় বলই এমন ছিল। মোটকথা তিনি লম্বা সময় ঐ একই জায়গায় বল করে গেছেন, ব্যাটসম্যানেরা আত্মহত্যা করেছেন। ড্রেসিং রুমে ন্যূনতম মনোযোগ নিয়ে আগের আউট গুলো দেখলে পরের ব্যাটসম্যানেরা এত সহজে আউট হন না!

তাহলে সোহান এত রান কমফর্টেবলি কিভাবে করলেন! তিনি বল রিড করতে পেরেছেন বলেই করেছেন। ম্যাক্সিমাম শট অফ স্ট্যাম্পে ফ্রন্ট ফুট রেখেই খেলেছেন তিনি। এই উইকেটে থিতু হলে রান আসে। উইন্ডিজ ব্যাটসম্যান রা করেছেন, সোহান করেছেন, করেননি তামিম মুশফিক সাকিব।

সাকিব বরাবরের মতই দলকে বিপদে রেখে কেটে পড়েছেন। ইংল্যান্ডের সাথে ঐ ম্যাচটাতে আমরা জিততে পারতাম যদি সাকিব দিনের শুরুতেই মঈন আলীর বলে অহেতুক ডাউন দ্যা উইকেটে খেলতে না যেতেন। শ্রীলঙ্কার সাথে গত বছর প্রথম টেস্টেও তিনি অহেতুক শট খেলে দলকে বিপদে ফেলেছিলেন।ফেলেছেন আগের দিনও। দলের সেরা খেলোয়াড় তিনি। চার স্তম্ভের বড়টা তিনি। অধিনায়কের কাছ থেকে আরেকটু দায়িত্ববোধ আশা করাটা কি অনেক বেশী বোকামি হবে আমাদের?

দলের সবচেয়ে টেকনিক্যালি শার্প ব্যাটসম্যান মুশফিক। প্রথম ইনিংসে যে ডেলিভারিতে আউট হলেন, পরের ইনিংসেও বোল্ড হলেন প্রায় একই রকম ডেলিভারিতে। প্রথম বার উইকেট আগলে এলবিডব্লিউ। পরেরবার অফ স্ট্যাম্প ছেড়ে বোল্ড। সেরা খেলোয়াড়েরা নাকি ভুল থেকে সাথে সাথে শিক্ষা নিয়ে ফেলেন। মুশফিক প্রথম ইনিংস থেকে শিক্ষা নিয়ে ফেলবেন এই আশাই তো আমরা করি, নাকি? দলের সেরা ব্যাটসম্যান তো তিনিই!

পেসারদের নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে কিছু বলার নেই। টেস্ট খেলুড়ে সব দেশের সবচেয়ে বাজে পেস বোলিং লাইন আপ আমাদের। এটা মানতে না পারলেও তিক্ত সত্যি এটাই। মুভমেন্ট ক্যারিবিয়ান পেস বোলারদের মত আমরাও পেয়েছি। তবে লাইন লেংথ একুরিসির জল ঢেলে দেয়া পেসাররা তার এতটুকু সুবিধা নিতে পারেননি। রুবেল একটা বল অফ স্ট্যাম্পে করলেন, ক্রেইগ স্ট্রাগল করল, পরের বলে হঠাৎ বাউন্সার দেবার কোন যৌক্তিকতা ছিল? কাটার মাস্টার হয়ে একনাগাড়ে এক রকম বল করে যাওয়া আমাদের দরকার নেই, গতিদানব হয়ে উল্টোপাল্টা লাইন আমাদের দরকার নেই, বাটারফ্লাই শিখে হুটহাট বাউন্সার দেয়া বোলার আমাদের দরকার নেই। আমাদের পিচ রিড করতে পারা, ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝে বল করতে পারা, জায়গামত বল করতে পারা একজন বোলারের দরকার। যেটা পেয়েছি মাশরাফির মধ্যে, মিরাজের মধ্যে, বোলার সাকিবের মধ্যে।

শেষে দায়টা নিতে হবে বিসিবিকেই। কেন? ছোট্ট একটা উদাহরণ দি । ভারতীয় স্পিনার কুলদ্বিপ যাদব, যুবেন্দ্র চাহালের স্পিন সামলাতে নতুন স্পিন বোলিং মেশিন বানিয়েছে ইংল্যান্ড। জানা গেছে, 'মারলিন' নামের এই বোলিং মেশিনে ব্যাট করা নাকি নরমাল স্পিন থেকেও কঠিন। নরমাল স্পিনে স্পিনারের বল ধরার গ্রিপ থেকে কিছুটা হলেও ক্লু পাওয়া যায়। মারলিন এ ব্যাটিং অনুশীলন করার সময় হ্যান্ড স্পিড থেকে শুরু করে কিছুই আঁচ করা যায় না। শুধু বাতাসে থাকা অবস্থায় বলের রোটেশন থেকেই বুঝতে হবে বল কোন দিকে স্পিন করবে।
ইংলিশ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ইংলিশ সামারে এই মারলিন নাকি যুগান্তর ঘটিয়ে ফেলবে।

'দায়িত্বশীল' বিসিবির কাছে মুভেবল পেস সামলানোর বোলিং মেশিন বানিয়ে ফেলার দাবি বাড়াবাড়ি । তবে ডমেস্টিকে একটু ঘাসের উইকেট বানিয়ে ফেলার দাবি করা খুব কম কিছুই। এইচপি ইউনিট থেকে সবরকম উইকেটে খেলানোর অভ্যাস করাটাও খুব কম কিছুই। চার ভেন্যুতে চার ধরণের উইকেট প্রস্তুত করার দাবি করাও কম কিছুই।

মজার ব্যাপার হল, এসব বিসিবিও জানে। এসব কিছুতে সমস্যা কাটবে সেসবও বিসিবি জানে। কিন্তু সমস্যা হল- বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?