ক্রিক-পাঁচালী
পোস্টটি ১৭৯৭ বার পঠিত হয়েছেপটলডাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাব আজ নিশ্চুপ, নীরব। কলাবাগান ক্রিকেট সংঘের সহিত ৩ টি রানের ব্যাবধানে ম্যাচ হারিয়া পটলডাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যরা পড়িয়াছে বিষম চাপে। উত্তরের গো-দীঘির পাড়ের ম্যাচখানাতে এমন করিয়া হারিয়া যাইতে হইবে তাহা পটলডাঙ্গার সদস্যরা ভাবেন নাই। ভাঙাচোরা ক্লাব ঘরখানার এক কোণাতে ব্যাট হাতে লইয়া কাদামাটি পায়ে বসিয়া রহিয়াছে ছোটখাট গড়নের শেতু। শেতুর পাশেই মুর্তিবৎ চাহিয়া রহিয়াছে হাসান। মাথায় আজ তাহার কিছুই খাটিতেছে না। এমন করিয়াও কেউ ম্যাচ হারে? সন্ধ্যা অবধি এতবার এত করিয়া ভাবিয়া ভাবিয়া হাসান চুপসে গিয়াছে।
বড়সড় ধাক্কা খাইয়াছে দলপতি রাফি । বলা হইয়া থাকে, রাফির নিকট জাদুকরি ক্ষমতা বিদ্যমান। চুপসানো দল তিনি নিমিত্ত চিত্তমাত্র চাঙ্গা বানাইয়া ফেলিতে পারেন। আন্ত:গ্রাম ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপের একখানা ট্রফি তিনি পটলডাঙ্গাকে দিয়া তবেই দল হইতে অনির্বান লাভ করিবেন বলিয়া ঠিক করিয়াছিলেন। সেই রাফিও আজ চুপ মারিয়া গিয়াছে। ঘরের এক কোণায় বসা সুঠাম দেহের রাব্বি উশখুস করিতেছে। বলাই বাহুল্য, তাহাদিগেরা আজ যে এমত চুপ মারিয়া গিয়াছে সেই দায় কিছুটা রাব্বিরও বটে। তবে তাহাতে তাহার লেশমাত্র ভাবনা আছে বলিয়া বোধ হইতেছে না। অন্তত এক পলক চাহিয়া তাহা কোনক্রমেই মনে হইল না।
পশিম দিকে বেড়ার ক্লাবঘরের এক্কেবারে কোণায় প্রায় অন্ধকার কোণায় বসা ইকবাল আজ পঞ্চাশ মারিয়াছে, তবুও আসিতে আসিতে প্রিয় বন্ধু হাসান ইকবালের প্রতি অভিমান দেখাইয়াছে। কাঠের ব্যাটখানা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে দেখিতে ইহার কারণই ইকবাল অনুসন্ধান করিতেছে বলিয়া বোধ হয়।
ক্লাবঘরখানার বাহিরে প্রকান্ড নারিকেল গাছ প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় নড়িয়া উঠিল। বোধ হইল, পরমেশ্বর যেন নারিকেল গাছ এদিক ওদিক দুলাইয়া ক্লাবঘরখানার নীরবতার সহিত দুষ্টুমি করিলেন। এ উপহাসেই কিনা কে জানে, রাফির আর এ নীরবতা সহ্য হইল না। সে কথা কহিয়া উঠিল, 'তারপর? আমরা কি সবাই এখানেই থামিয়া যাইব?'
রাফির কথা রাব্বির কিছু কানে পৌছাইতেছে বলিয়া মনে হয় না। সে ভাবিয়াছিল, রাফি, ইকবাল, শেতু, হাসান, মাহমুদ এর ঘাড়ে চড়িয়া আজও ঠিকই জিতিয়া যাইবে। সাঁঝের পর তাহার পাশের গ্রামের সকিনার সহিত গঞ্জে চুড়ি কিনিতে যাইবার কথা ছিল। ম্যাচ হারের পর সে বাহির হইতে পারিতেছে না। সে না পারিতেছে কিছু বলিতে, না পারিতেছে কিছু করিতে। এমনিতেই পাশের বাড়ির ছোটনকে মারিয়া ক্লাবঘরে তাহার দুর্নাম রটিয়াছে। ক্লাব কত্তামশাই 'গৌরাঙ্গদেব আপন' তাহাকে ক্লাবের অভ্যন্তরীন সমস্ত প্রতিযোগিতা হইতে নিষিদ্ধ করিয়াছে। এরই মধ্যে আজ সকিনার সহিত যাওয়া ঠিক হইবে না। পৃথিবীটা নাকি গোল হইয়া ঘুরিতেছে, কখন কি কোথায় ঘটিয়া যায় বলা মুশকিল। তাহার বন্ধু শশির এক ললনার প্রেমে ফাসিয়া দল হইতে বিচ্যুত। গোল পৃথিবীর এই গোল চক্রান্তে সকিনা কেমন হইবে তাহা রাব্বি ভাবিয়া কূল পাইতেছে না। রাফি কিন্তু বকিয়া চলিয়াছে.....
'আমাদিগের নিজের ভুলেই আমরা বারংবার ম্যাচ হারিতেছি। শেতু আজ যাহা করিল তা তাহার কাছ হইতে আশা করি নাই। তবুও শেতুকে ধন্যবাদ দিতে হইবে বৈকি! ম্যাচ জিতিবার প্রান্তরে নিয়া গিয়াছিল এই শেতুই। তবুও গত বছরের আগের বছর উত্তরপাড়ার সহিত শেতু যেভাবে আউট হইলে দল হারিয়াছিল, এইবারও কলাবাগানের সহিত শেতু এমত পরিস্থিতিতেই আউট হইয়া ফিরিয়া আসিবে তাহা আমি ভাবি নাই।''
এই পরাজয়-নাট্যের দুর্ভাগা সৈনিক মাহমুদের কথা এতক্ষণে বলা হয় নাই দেখিয়া লেখক নিজেই অবাক হইলেন। প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ মাহমুদ সম্বন্ধে তবে বলা যাক। পটলডাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাবের প্রায় সব বড় বড় জয়ের কান্ডারি এই মাহমুদ। টানা প্রতি ম্যাচে পঞ্চাশ একশোর ফুলঝুড়ি তিনি উড়ান না। কতিপয় বড় বড় ম্যাচে দল যখন খাদের কিনারে তখন এই মাহমুদ শুধু খাদ থেকে টানিয়াই তুলেন না, রীতিমত জয়োৎসব করিয়ে ছাড়েন। রাফির ভীষণ আস্থার জায়গা এই মাহমুদ।
রাফি বকিয়া চলিল ''কুবের, তুমি আজ যাহা করিয়াছ তাহাকে আমি ক্ষমা করিতে পারিব না। দু:স্বপ্ন এক বছরে একবার দুইবার দেখা দিতে পারে, তোমার এই বছরেই দেখা দিয়াছে তিন তিনবার। তোমার বলের সারি-দিক কিছুই ঠিক হইতেছে না। কালকের ম্যাচেই দেখিতেছ না কেন? পরম আস্থায় তোমার উপর যখন বল করার দায়িত্ব প্রথমবারের মত চাপাইয়া দিলাম, শুরুর বলেই তুমি এমন একখানা বল ছুড়িলে, যাহার পিতা মাতাই আমি মাঠে বসিয়া ঠিক ঠাওর করিতে পারিলাম না। আসিয়াই ব্যাটসম্যানের অতটা সামনে বল ফেলাইয়া মাথার উপর দিয়া যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করিয়া আমি কিছুই পাই নাই। '
কুবের খুশি হইল না। কেহই তাহাকে খুশি করিতে পারে না। পারিবে কেমনে? স্বয়ং খুশিই তাহাকে পারে নাই খুশি করিতে। কুবের মনে মনে গতির ঝান্ডায় প্রচন্ড উত্তাপে অভিমান জমাইতেছে। সেই অভিমানে শোধরানোর প্রকল্প নাই, চেষ্টা নাই, অভিপ্রায় নাই।
এমত সময়ে কত্তা হন্তদন্ত হইয়া ক্লাবঘরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়াই হাসানের উপর খুব একচোট ক্ষেপিয়া গেলেন। সমস্ত দায় হাসানের উপর চাপাইবেন এই ভাবিয়া যেই না মুখ খুলিতে যাবেন দেখিলেন, অদূরেই সাগর বসিয়া রহিয়াছে। বিকট চিৎকারে বেড়ার ঘরের প্রতিটা ধূলিকণা যেন উড়িয়া যাইবে এমন করিয়া বিকট হা করিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, 'দল হারিয়াছে আর তুমি এখনও বসিয়া রহিয়াছ সাগর?'
বজ্রনিনাদ যেন সাগরের মাথার উপর ঝাপাইয়া পড়িল। রাফি, হাসান ভ্রাতাদিগেরাও তো বসিয়া রহিয়াছে। তাহার বসিয়া থাকাতে দোষ কিছু আছে কি?
'তোমার তো খেলাতেই কোন মন নাই। মন থাকিলে কি আর ম্যাচ হারার পর বসিয়া থাক?'
'তো আপনি তাহাকে কি করিতে বলেন?' হাসান প্রশ্ন করিয়া বসিল। খুব এক সূক্ষ মাপের ক্ষেপিয়া গেল বলিয়াও বোধ হইল।
কত্তা 'গৌরাঙ্গদেব আপন' থতমত খাইয়া গেলেন। ম্যাচ হারিয়া গেলে বসিয়া থাকাতে কি দোষ আছে তাহা হাতাইয়া হাতাইয়াও বাহির করিতে পারিলেন না। শেষে কিছু খুজিয়া না পাইয়া খুব একচোট রাগিয়া-চাগাইয়া বলিয়া ফেলিলেন, 'তুমি কথা বলিতেছ কেন হে? দেখিতেছ না আমি এখনও মরি নাই। তোমারও তো খেলায় মন নাই! '
রাফি কত্তার এই অযাচিত কথাতে খুব একচোট বিরক্ত হইলেন। কিন্তু তিনি রাগিলেন না। দলপতিকে রাগিলে চলে না। কত্তার সহিত আসা দুর্জন কে ইশারায় কত্তাকে নিয়া যাইতে বলিলেন। কুজন কত্তাকে উঠাইয়া নিয়া চলিয়া গেল। রাফি আবারও শুরু করিল... দলকে নিজ গুণে চাঙ্গা করিতে লাগিল। হাসান সিরাজ সবাই ঘিরে বসিয়া পড়িল... ইকবাল এতক্ষণে হাসানের অভিমানের কারণ খুজিয়া পাইয়াছে। সুজয়ের গুণ তাহার মধ্যে স্থানান্তরিত হইয়াছে বলিয়াই হাসান রাগ করিয়াছে ঠাওর করিল সে।
রাব্বি কিন্তু সকিনার সময় নিয়া উসখুশ করিতেছে.... কাল সকালেই আবার পরদিনের ম্যাচের নিমিত্তে পটলডাঙ্গা ছাড়িয়া কিটিরপুরে রওনা করিতে হইবে........
(এই গল্প নিতান্তই অনুর্বর মস্তিষ্কেত উর্বর কল্পনা। বাস্তবের সহিত কোন মিল থাকলে তা একান্তই কাকতালীয় আর তার দায় এই অধম লেখক নেবেন না)
- 0 মন্তব্য