• ক্রিকেট

ক্রিক-পাঁচালী (পর্ব-৩)

পোস্টটি ৮৪৬৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রকৃতির সব থেকে সুন্দর সময় কোনখানা? বিকেল! সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনীর পর মনুষ্যলোকের দেহ যেমন অবসাদে বিছানায় ঢলিয়া পড়ে, কিন্তু দেহজুড়ে রহিয়া যায় দিবালোকের প্রত্যেকটি কার্যসাধনের তৃপ্তি, তেমনি সূর্যদেব সারাদিন অক্লান্ত রথগমনের পর এ সময়খানাতেই অবসাদে পশ্চিম দিকে যেন ঢলিয়া পড়েন, কিন্তু প্রকৃতিতে ছড়াইয়া দেন নিজের সমস্ত কার্যের তৃপ্তি আর বৈকল্যে সেই তৃপ্তিই যেন মনুষ্যসমাজ মুঠি ভরিয়া উপভোগ করিয়া থাকে।

এমনই আশ্চর্য এই সময়ে পটলডাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাবের বেড়ার ঘরখানা বহুদিন পর যেন প্রাণ ফিরিয়া পাইয়াছে। কিটিরপুর হইতে ফিরিবার পর দলের প্রত্যেক সদস্য ক্লাবঘরখানা ছাড়িয়া নিজ নিজ গৃহে ফিরিয়া গিয়াছিল। মাঝে এক ধর্মীয় উৎসব থাকার দরুন দলের প্রত্যেক সদস্য হৈ হৈ করিয়া তাহা উপভোগ করিয়াছে, একে অপরের সহিত কোলাকুলি সারিয়াছে।

সময় এমনি করিয়া চলিয়া যায় না। সাময়িক আমোদের পর প্রত্যেককেই নিজ নিজ কার্যে ফিরিতে হয়, যেমনি করিয়া প্রতিটি পাখি সাঁঝের মায়া ভুলিয়া নীড়ে ফিরিয়া আসে।

পড়ন্ত সূর্যের আলোকরশ্মি ভাঙ্গা জানালা দিয়া ক্লাবঘরখানার মেঝেতে উঁকি দিয়া যাইতেছে। তাহারই পাশে টুলে বসিয়া ইকবাল নিজের ব্যাটখানা দেখিতেছে, 'হাসান, তোর কি মনে হয় আন্ত-ক্লাব চ্যাম্পিওনশিপে আমাদিগের দৌড় কোথায় গিয়া থামিবে?''

বন্ধুবর হাসান কোন প্রত্যুত্তর করিল না। ইকবাল প্রত্যুত্তর আশাও করে নাই। হাসানের স্বভাব সম্বন্ধে সে জানে না এমন তো নহে। কিন্তু কি যেন এক ভাবিয়া হাসান মুচকি হাসিয়া জবাব দিল, 'আমরা যেথায় গিয়া থামিতে চাহিব, দৌড় সেখানেই থামিবে বোধ করি। "

ভারী দার্শনিক উত্তর। এর উপর কথা চলিবে না। বলা বাহুল্য, ইকবাল আর চালাইলোও না।

প্রাকটিস করিতে যাইতে হইবে। ক্লাবঘরখানার সামনে এক ছোটখাট পুকুর রহিয়াছে। পুকুরখানা আমি একবার দেখিতে গিয়াছিলাম। দেখিয়া বড় চমৎকৃত হইয়াছিলাম। তবে ইহাকে 'ছোটখাট পুকুর' নাকি 'বড়সড় ডোবা' কোনটা বলিয়া চিহ্নিত করা উচিত সেই ধাঁধার উত্তর আজও ঠাওর করিয়া বাহির করিতে পারি নাই। সকলে ছোটখাট পুকুর কহিতেছে দেখিয়া আমিও তাই ছোটখাট পুকুর লিখিয়া দিয়া চালাইলাম।

পুকুরখানার পাশে এক প্রকান্ড মাঠ। সেই মাঠে ক্লাবঘরখানার নতুন কিছু সদস্য সবেমাত্র প্রাকটিসে নামিয়াছে। পটলডাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাবের নবনিযুক্ত কোচ 'পথিক মশাই' বেশ কিছু সদস্যকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। উদ্দেশ্য নতুন কিছু নহে, আসছে ৩১ শে ভাদ্র হইতে আরম্ভ হইতে যাওয়া আন্ত:ক্লাব ক্রিকেট চ্যাম্পিওনশিপের দল বাছাই।

রাফি ক্লাবঘরখানার ভেতরে প্রস্তুত হইতেছে। হাটুতে তাহার বেজায় সমস্যা। কয়েকটা পথ্য লইয়া তাহাকে প্রাকটিসে নামিতে হয়। খেলার পর নিজ হস্তে হাটুতে জমিয়া ওঠা রস বাহির করিতে হয়। রাফির এহেন কার্য অদূরে বসিয়া দেখিতেছে সিরাজ। দেখিয়া রাফির প্রতি যেন পুনর্বার শ্রদ্ধা অনুভব করিল সে। রাফিকে লইয়া তাহার ভাবনা অত্যাশ্চর্য, তাহার ভাবনায় রাফি যেন কোন গ্রীক পুরাণের যোদ্ধা। যে কিনা যেকোনভাবেই নিজের মহিমা দেখাইতে সক্ষম। রাফিকে দেখিয়া সিরাজ নিজের মধ্যে আশ্চর্য এক শক্তি অনুভব করিল। আদতে রাফি এমনই, সকলের মাঝে মিশিয়া রহিয়াছে কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরের এক উদাহরণ!

ক্লাবঘরখানার অদূরে মুখ গোমড়া করিয়া সাগর বসিয়া রহিয়াছে। মন তাহার বেজায় খারাপ। গ্রামে তাহার নামে কুৎসা রটিয়াছে। হাসান আস্তে করিয়া উঠিয়া গিয়া সাগরের পাশে বসিল। তাহার কাঁধে হাত রাখিল। সাগর চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া তাকাইল,

'হাসান ভাই, আমি এসব করি নি।"

হাসান এক পলক সাগরের দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর বলিল,

'তুই করিয়াছিস কি করিস নি, ইহা এখন মুখ্য বিষয় নহে। তুই যেইমাত্র ক্লাবঘরখানাতে পা রাখিয়াছিস সেইমাত্র হইতে তুই শুধুই এই ক্লাবঘরখানার। অন্য কোন ভাবনা যেন তোকে গ্রাস করিতে না পারে। অন্য ভাবনা মূল ভাবনাকে আক্রমণ করিতে সর্বদা চেষ্টায় থাকে। মূল ভাবনাকে তাই অন্য ভাবনার আক্রমণ হইতে সর্বদা রক্ষা করিতে হয়। '

সাগর মনে মনে কিছুটা সাহস পাইতেছে। সাহসী হাসান তাহাকে দাঁড়াইতে শিখাইয়া দিল যেন। সে হাসানের দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিল,

'আমি খেলিব কিন্তু আমাকে জড়াইয়া যাহা শাখা প্রশাখা মেলিতেছে তাহা আমার মাথায় আসিবে না এ কেমনে হয়!'... এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থাকিয়া পুনর্বার কহিল,

'আমি না চাহিলেও তো পারিতেছি না হাসান ভাই'

হাসান এইবার খানিকটা রাগিয়া উঠিল মনে হইল। তবে তাহা ক্ষণিকের জন্যে। কণ্ঠ শান্ত করিয়া কহিল,

'তুই যদি ক্রিকেট খেলাটা ভালবাসিয়া থাকিস আর এই ক্লাবঘরখানাকে ভালবাসিয়া থাকিস তবে কেন পারিবি না? খেলাটার জন্যে হইলেও তো ভুলিতে পারিস। যাহাকে ভালবাসা হয় তাহার জন্যে ব্রহ্মান্ড জয় অসম্ভব?'

এই কথার পর আর কোন কথা খাটিবে না। সাগর উঠিয়া দাঁড়াইল । মাঠে এমনিতেই সরকার অপেক্ষা করিতেছে। সাগরের তাহাকে বোলিং করিবার কথা। দ্রুত হাতে গোছগাছ করিয়া সাগর ক্লাবঘরখানা হইতে বাহির হইয়া গেল। শেতু বাহির হইয়াছে তাহারও বহুক্ষণ আগে.........।