রামগরুড়ের ছানা
পোস্টটি ৪৫৯৪ বার পঠিত হয়েছে১৯৯৯ সালের আগের কোন একটি ম্যাচ। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড। এমন সময়ে বাংলাদেশের কোন এক প্লেয়ারের মাথা ফেটে গেছিল। রক্তও ঝরছিল। দলের প্রয়োজনে তিনি তাই নিয়েই মাঠে খেলে গেছিলেন!
এ ধরণের ডেডিকেটেড প্লেয়ারদের যারা বাছাই করেন তারাই হলেন ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচক। বর্তমানেও এ পদে বহাল তবিয়তেই আছেন জাতীয় দলের সাবেক দুই ক্রিকেটার, এখন অব্দি বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তী!
তারপরও তাদের কাজে সমালোচনার কমতি নেই। কর্তা-কর্মীর হস্তক্ষেপ, জবাবদিহিতায় দুর্বলতা, পরিপূর্ণ ব্যাখ্যার অভাব, দৃঢ়চেতা মানসিকতার অভাব- সবমিলিয়ে নিজেরা যতরকমভাবে নিজেদের ভাঁড়ে প্রমাণ করা যায়, তারা করেছেন। প্রধান পদে আসীন দেশের 'ইতিহাসের অন্যতম সেরা' ব্যাটসম্যান এ কাজে যারপরনাই পটু!
সাব্বিরের উদাহরণটি 'কাছে থেকে দূরে'। সাব্বিরের দলে নেওয়াতে প্রধান নির্বাচক,ডিসিপ্লিনারি কমিটি, স্বয়ং বোর্ড সভাপতি কেউই নাকি শাস্তি কমানোর ব্যাপারটি জানতেনই না। কি অদ্ভুত, কি কিম্ভুত! ব্যাপারটা গোড়া থেকে ভাবা যাক!
ক্যাপ্টেন তার চাহিদা নির্বাচককে জানিয়েছিলেন, যথাযথ ক্রিকেটীয় যুক্তিও দিয়েছিলেন। নাটক টা শুরু এর পরে, উদ্বোধক স্বয়ং প্রধান নির্বাচক! ক্যাপ্টেন তার চাহিদামত প্লেয়ার চাইতেই পারেন, কিন্তু তাকে দলে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান নির্বাচক। এখন তিনি যখন ক্যাপ্টেনের সাথে একমত হয়ে সাব্বিরকে দলে ঢোকালেন তিনি কি একবারের জন্যেও প্রয়োজন মনে করেননি এটুকু নিশ্চিত হবার যে সাব্বির আদৌ শাস্তিমুক্ত হয়েছিল কিনা। ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক হিসেবে অবশ্যই তার জানা থাকার কথা যে সাব্বিরকে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। সেটি জেনেও তিনি সাব্বিরকে দলে নেওয়ার আগে একবারের জন্যেও শাস্তি কমানোর বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত হবার প্রয়োজন মনে করলেন না?
নির্বাচক দল তৈরি করে পাঠিয়ে দেন বোর্ড সভাপতির কাছে। বোর্ড সভাপতি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সেই দল অনুমোদন করেন। এখন প্রধান নির্বাচক যখন বোর্ড সভাপতির কাছে দল পাঠাল, স্বাক্ষর করার আগে তিনি অবশ্যই সেই দলটি পড়ে দেখেছিলেন। বোর্ড সভাপতি হিসেবে সাব্বিরের শাস্তি দিয়েছিলেন তিনিই। সুতরাং, সাব্বির তখনও নিষেধাজ্ঞায় সেটি তো তার অজানা থাকবার কথা নয়। খেলোয়াড় তালিকাতে সাব্বিরের নামটি থাকার পর অবশ্যই কি বোর্ড সভাপতির উচিত ছিল না অনুমোদনের আগে শাস্তি কমানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া? তিনি অন্তত প্রধান নির্বাচককে ডেকে পাঠাতে পারতেন, প্রধান নির্বাচককে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন আদৌ সাব্বিরের শাস্তি কমানো হয়েছিল কিনা। কিংবা তিনি ডিসিপ্লিনারি কমিটিকে তলব করতে পারতেন!
এর কোনটি না করে তারা ছেলেখেলায় মেতে উঠেছেন। প্রধান নির্বাচক জানতেন না শাস্তি কমানোর বিষয়, বোর্ড সভাপতিও না জেনেই স্বাক্ষর করেছেন, ডিসিপ্লিনারি কমিটি তো আঁধারেই থাকার ভান করেছে!
তো এই যে বোর্ডের শীর্ষ পদে থেকেও তারা হয় জানলেন না , নাহয় না জানার চমৎকার অভিনয় মিডিয়ার সামনে করে বসলেন.. এতে কি বোঝা গেল?
ধরে নিচ্ছি, চারপাশে এই ইস্যুতে প্রচন্ড সমালোচনায় তারা জেনেও না জানার 'অজ্ঞতা' সজ্ঞানে বরণ করেছেন। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের শীর্ষ কর্তাব্যাক্তি হিসেবে এই 'অজ্ঞ' সাজা টা কি যথেষ্ট শোভন হয়েছে? বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে পৌছেছে, তাতে কি দায় এড়ানোর সুযোগ আছে? নিশ্চিত ভাবেই এটি ছিল দায়িত্বে পরিপূর্ণ অবহেলা!
আর যদি তারা সত্যিই না জেনে থাকেন তবে এটি দায়িত্বে অবহেলা নয়, এতে এটিই প্রমাণিত হয় ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ পদে থাকার যথাযথ যোগ্য ব্যাক্তি তারা নন! সেখানে থাকার ন্যুনতম যোগ্যতা তাদের নেই!
সাব্বিরের উদাহরণ দেবার সময় 'কাছে থেকে দূরে' বলেছিলাম। কারণ কাছের উদাহরণটি ছিল বেমক্কা ইমরুল কায়েসের অন্তর্ভুক্তি। নিউজিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে দল ঘোষণার সময় ইমরুল কায়েসকে নেওয়া হয়নি। না নেওয়ার পক্ষে যুক্তিও দেওয়া যায়। পেস বোলিং মানানসই কন্ডিশনে ইমরুল কায়েসের ব্যাটিং স্ট্যাটই এই না নেওয়ার পক্ষে কথা বলে। সামনে যেহেতু ওয়ার্ল্ড কাপ পেস বোলিং ফ্রেন্ডলি কন্ডিশনে আর নিউজিল্যান্ডও শুধু তাই-ই নয় বরং ওয়ার্ল্ড কাপের প্রস্তুতিপর্ব তাই বলাই বাহুল্য এই স্ট্যাট অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে!
পেস বোলিং ফ্রেন্ডলি এমন কন্ডিশন পাওয়া যাবে মূলত ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড, উইন্ডিজ-এ। এসব দেশে ইমরুল কায়েসের ব্যাটিং গড়-
ইংল্যান্ড-২৩.৮০
অস্ট্রেলিয়া- ৩.৫০
নিউজিল্যান্ড- ৩৭.৭১
উইন্ডিজ-৩.৬৭
সাউথ আফ্রিকা-২৩.০০
আয়ারল্যান্ড- ৫.০০
এর মধ্যে শুধুমাত্রই নিউজিল্যান্ড এর সাথেই এভারেজ টা মোটাসোটা দেখাচ্ছে। এখন ওয়ার্ল্ড কাপের প্রস্তুতি সফরে 'শুধুমাত্রই নিউজিল্যান্ড ফ্রেন্ডলি' ব্যাটসম্যানকে না নির্বাচন করায় নির্বাচকদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু এখানেও বোর্ড কর্তারা নাটকের কমতি রাখলেন না। ইমরুল কায়েস ততদিনে এক জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে বেশ কিছু ভক্ত জোগাড় করে ফেলেছেন। মিডিয়াতে ইমরুলের না থাকা নিয়েও সমালোচনা হচ্ছিল। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে তো তিনি রীতিমত খেলা ছেড়ে দেবার হুমকিও দিয়ে বসলেন।
সেই বেসরকারী টিভি চ্যানেল যখন বোর্ড কর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বললেন 'ইমরুল বাদ পড়ার আমি কোন কারণ দেখছি না।'
সিলেকশন প্যানেলের সিদ্ধান্তে বাদ পড়া কারো যদি কোন কারণ বোর্ড সভাপতি না দেখেন, দুই পরিস্থিতি যে সাংঘর্ষিক হয়ে যায় তা কি বোর্ড সভাপতি বুঝেছেন? মিডিয়াতে কথা বলায় আরেকটু পরিণতিবোধ বোর্ড কর্তার কাছ থেকে আমরা আশা করতেই পারি!
বোর্ড কর্তা, প্রধান নির্বাচকের এই খেয়ালি আচরণ অবশ্য এদেশের ক্রিকেটে নতুন নয়। দায়িত্ব নেবার পর থেকেই মূলত তিনি এই স্বতপ্রবৃত্ত ধারা বজায় রেখেই বহাল তবিয়তে কাজ করে চলেছেন। এই যেমন মাঝে -সাঝেই ডাক পড়ে পেসার শফিউল ইসলামের। বেঞ্চে বসে 'সরাসরি খেলা' উপভোগ করেন, এরপর যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই বাদ পড়ে যান। হঠাৎ কি যুক্তিতে শফিউল দলে ঢুকে পড়েন, আবার কি যুক্তিতেই বা বাদ পড়েন তার কোন ব্যাখ্যাই প্রধান নির্বাচক কখনও সুস্পষ্টভাবে দেননি। কে জানে, তিনি হয়ত জানেনই না। তবে দেশের ক্রিকেটে প্রচলিত আছে, শফিউল কেন আসেন আর শফিউল কেন যান তা শফিউল নিজেও জানেন না!
মজার ছলে শফিউলের অন্তর্ভুক্তি পার করে দেওয়া গেলেও সৈকতের বাদ পড়াকে মজার ছলে নেওয়া যাবে না। ২০১৮ এর শুরুতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্টে হঠাৎ করেই মোসাদ্দেক সৈকতকে বাদ দিয়ে সাব্বির রহমানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রধান নির্বাচককে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন যেহেতু সাব্বির টি-২০ দলে আছে তাই তাকে টেস্টে অন্তর্ভুক্ত করে ম্যাচের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়!
টি-২০ এর প্রস্তুতি একজন ব্যাটসম্যান টেস্ট ম্যাচ খেলে সারবেন, এবং এ কারণে তাকে একটি টেস্টে খেলানোও হবে- এই যদি হয় একজন প্রধান নির্বাচকের চিন্তাধারা তবে বলতে বাধ্য হতে হয়, গল্পের 'নূরা পাগলা' ও এর চেয়ে ঢের বুদ্ধিমত্তা নিজের মধ্যে ধারণ করেন!
টেস্ট ইতিহাসে যতজন বোলার বল করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বাজে এভারেজ রুবেল হোসেনের। এমন একজনকে ২০১৮ এর উইন্ডিজ ট্যুর অব্দি দলে নেওয়া হয়েছে। সঠিক ফরম্যাটের সঠিক প্লেয়ার বাছাইয়ের ব্যার্থতা যে প্রধান নির্বাচক শুধুই রুবেলের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন এমন নয়। ডমেস্টিক সার্কিটে ফার্স্ট ক্লাসেই সবথেকে উজ্জ্বল স্ট্যাটিসটিক্স থাকা মোসাদ্দেক হোসেনকে লিস্ট-এ ম্যাচ দেখে টেস্ট ম্যাচে সিলেকশন দেওয়া হয়নি। একজন নির্বাচক যদি সঠিক জায়গাতে সঠিক খেলোয়াড়কে নির্বাচন না করতে পারেন, তবে একজন নির্বাচক হিসেবে তার আসল কাজটা কি আমার জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়!
প্রধান নির্বাচকের খামখেয়ালি লিখতে বসলে এন্ট্রপির মান শূন্যে পৌছে যাবে, সেদিনও হয়ত শেষ হবে না। তবে, স্কটল্যান্ডের সাথে মাথা ফাটিয়েও ব্যাট করতে নামা ফারুক আহমেদও এক সময় নির্বাচক ছিলেন। এখনকার প্রধান নির্বাচক তখনও সিলেকশন প্যানেলে ছিলেন। নিশ্চুপ, বিকারহীন সুকুমার রায়ের রামগড়ুরের ছানা না হয়ে কিছু শিখলেও তো পারতেন... নইলে শ্রদ্ধাভাজন সব সাবেক খেলোয়াড়েরা এমন করে হাসির পাত্র কি আর হতেন!
- 0 মন্তব্য