• ক্রিকেট

আঁধার রাতের স্বপ্ন

পোস্টটি ৩৫৯৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সন্ধ্যের আলো আঁধারিতে তেমন কিছু দেখা যায়না৷ মাগরিবের আজান দিয়েছে খানিক আগে৷ দলে দলে সবাই ছুটছে মসজিদের দিকে৷ বিপলুর এ সময়টা ঘরের বাইরে থাকা মানা ৷ নীলফামারির ছোট্ট একটা মফস্বলে তার বাস৷ শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া যেন কেবল লাগতে শুরু করেছে। কদিন আগে মাত্র রহমান চাচার চায়ের দোকানে টিভি কেনা হয়েছে। চাচার বিকিকিনি বেড়ে গেছে এতে। দোকান ফাঁকা করাটাই যেন এখন মুশকিল কাজ৷ ক্রিকেট খেলে বাসায় ফিরতে আজ বুঝি দেরি হয়ে গেল৷ শফিক চাচার জন্যেই তো যত ঝামেলা।

খেলার মাঝে এমন এক দুইবার করে তেড়ে আসলে ম্যাচ শেষ করতে তো সময় যাবেই। এই যেমন আজকেই, শেষ দুটো ওভারই মাত্র বাকি ছিল। হঠাৎ লাঠি হাতে তেড়ে আসলেন শফিক চাচা, 'মাগরেব হইয়ে এলো, হারামজাদারা এখনও মাঠে...' বলে যেই দৌড় টা দেওয়ালেন বিপলুদের। ক্ষেতের আলে পা পিছলে নাহিদের পা টাই গেল মচকে।

কিন্তু এসব আর মা কে কেই বা বোঝাবে। পিঠে দু চার লাঠির বাড়ি আজ পড়বে বলে মনে হচ্ছে। ক্রিকেট খেলাটাকে যে মা একদমই দেখতে পারেন না৷

অবস্থা ততটা ভাল নয় বিপলুদের। চুন খসে পড়া ইটের দেওয়ালের বাসা, মাথার উপর ঠাঁই পায় ফুটো টিনের চাল। সেই ঘরে রাগে খিটখিটে বাবা আর সতর্ক মা নিয়েই তাদের বাস৷ নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবশ্য বলা যাবেনা, কিন্তু পান্তা ছাড়া যে কিছুই জোটে না সেটা জোর গলাতেই বলা যাবে৷ দুবেলা দুমুঠো আহার জোগাড় করাই যেখানে বিপলুর জন্যে সমস্যা, সেখানে ক্রিকেট নিয়ে তার বাড়াবাড়িটা বাবা-মায়ের চোখে বড় বেশি করে বাজে৷ কিন্তু বিপলুও ছাড়বার পাত্র নয়৷ স্কুল শেষ করে মাঠে ক্রিকেট খেলে তবেই তার বাড়ি ফেরা চাই। তার আগে? কক্ষনও নয়!

চুপে চুপে বাসায় ঢুকল বিপলু। মা দেখেনি মনে হয়। হঠাৎ ডাক শোনা গেল ,' বিপু ফিরলি?'

রাতের খাবার খেয়েছে বিপলু৷ চাচা এসেছে গ্রাম থেকে। সাথে ইলিশ এনেছিল। তাই দিয়ে খাওয়া আজ জমেছে বেশ। বাসার সবাই ঝিমুনো শুরু করেছে। দশটা বাজতেই আলো বন্ধ হয়ে যাবে৷ বিপলু ঝিমুতে পারছেনা৷ উশখুশ করছে। বারদুয়েক বিন্দি আপা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে, 'অমন অস্থির অস্থির করছিস কেন? শরীর খারাপ করেছে?'

'কিছু না' বলে চুপ থেকেছে বিপলু৷ তবুও মনটা তার অশান্তই রয়ে গেছে। রাত একটায় বাংলাদেশের খেলা আছে। বাসায় টিভি নেই। রহমান চাচার বাসায় যেতে হবে। চাচা বাসায় ফিরবার পথে ১২ ইঞ্চি টিভি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাবেন। বাবা জেগে থাকতে বাসা থেকে বেরুনো মুশকিল।

বাবা ওই ঘরে চাচার সাথে গল্প করছেন। এবার খালে জাল ফেলা হয়েছিল। মাছ পড়েছে বেশ। সেসব গল্প খুশির আতিশয্যে বলে চলেছেন চাচা। গ্রামে পাশের বাড়ির গফুর মিয়ার বাসায় নাকি আগুন লেগেছিল। সেই নিয়েও আফসোস হচ্ছে৷ আর আফসোস হচ্ছে বিপলুর এই ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি৷ খিটখিটে মেজাজের বাবা যেখানে খাইয়ে পরিয়ে বিপলুকে মানুষ করছেন সংসারের দায় মোচনের আশায়, ফুটো টিনের চাল সারাবার আশায়, পাশে একটা ছোট্ট গোয়াল ঘর তৈরি করবার আশায়।

সাড়ে দশটা বেজে গেছে৷ সাড়ে নটা থেকে মড়ার মত পড়ে রয়েছে বিপলু৷ ঘুমের ভান ধরেছে। একবার মা এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করে না সূচক মন্তব্য করে চলে গেছেন। সারা বাসা এখনও অন্ধকার, শুধু বিন্দি আপার ঘরে আলো জ্বলছে৷ সামনে তার কি জানি পরীক্ষা৷ খুব পড়ছে বিন্দি আপা৷ সাতটা বিয়ের প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়েছে বাবা। মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে চান তিনি। আদতে, বিন্দির পড়াশোনার পেছনে খরচ তার অল্পই। বৃত্তি পেয়ে স্কুলে সে বিনা বেতনেই পড়ছে৷

জানালার রডগুলো হাত দিয়ে দেখছে বিপলু৷ এরপর আস্তে করে দুটো রড উঠে গেল। জাদুমন্ত্রে নয়, আগেই ওগুলো ওরকম ছিল। গেল ফুটবল বিশ্বকাপের সময় রাতে খেলা দেখতে বার হতে হয়েছে। তাই এ ব্যাবস্থা করে রেখেছে বিপলু। টুপ করে বাইরে নিজের শরীরটাকে ফেলে দিল বিপলু। এরপর আস্তে করে জানালার রড দুটো জায়গামত বসিয়ে দিল। এরপর হাটতে লাগল রহমান চাচার বাড়ির দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে বিপলু। সামান্য একটা ওয়ানডে সিরিজের সামান্য একটা ম্যাচে জয় নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। যে স্বপ্ন রাত এগারোটায় বাসা থেকে লুকিয়ে এই অন্ধকার পথে চলতে বাধ্য করেছে। ভোরের আগেই আবার বাড়ি ফিরতে হবে। চলছে বিপলু, সঙ্গে তার স্বপ্ন, আশা আর ভালোবাসা.......