দায়মোচনের ম্যাচ
পোস্টটি ৩০৪৭ বার পঠিত হয়েছেমুশফিকুর রহিম এক ওভারে চারটি চার মেরেছেন । ১২ বলে ২২ এর সমীকরণ থেকে দল তখন প্রায় জয়ের বন্দরে চলে এসেছে । ওভার বিরতিতে কপালের ঘাম মুছে প্রান্তবদলের সময় মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে কিছু একটা বললেন মনে হল। শেষ ওভারে দরকার ৪ রান ।সহজ জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। দিল্লীতে দাঁড়িয়ে খুব সম্ভবত তখন দুজনের মনে বেঙ্গালুরু ভেসে আসছে। ৩ বছর আগের মত আরেকটি স্লগ সুইপে মুশফিক একটু আগে আউট হয়ে যেতে পারতেন । কিন্তু দল নির্বাচনে ফিল্ডিং কে প্রধান বিবেচনা করা ইন্ডিয়ান স্কোয়াডের কেউও ওরকম লোপ্পা একটা বাউন্ডারি লাইনের ক্যাচ মিস করে! ক্রুনাল পান্ডিয়া করেছেন। ক্রুনাল পান্ডিয়া যে ম্যাচটাই ফসকে ফেলেছেন তা হয়ত তখনও বুঝতে পারেননি ভারতীয় স্কোয়াডের কেউই । শেষ ওভারে দীপক চাহার বল করতে এল, মুখে রাজ্যের হাসি। বোধহয় পছন্দ হল না কাপ্তান রোহিতের, কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনীর কাছ থেকে শেখা গ্যাম্বল করতে চাইলেন তিনি। ৩ বছর আগে ধোনী এরকম শেষ ওভারে বল তুলে দিয়েছিলেন তখন সদ্য অভিষেক হওয়া অনভিজ্ঞ হার্দিকের হাতে, পুরোদস্তুর বোলার হিসেবে তখন তাকে কম লোকই চিনত। রোহিতও চাইলেন বাজি লাগাতে, বল করতে এলেন আজকের ম্যাচেই অভিষেক হওয়া শিভম দুবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে হাত ঘুরিয়ে যার ইকোনমি ৯ ছুঁই ছুঁই । দীপকের মত নির্লিপ্ত হাসি নেই তার মুখে। এরকম পিচে একমাত্র কার্যকরী অস্ত্র স্লোয়ার ছোঁড়ার কৌশলই হয়ত বারবার মনে এঁটে নিচ্ছিলেন। এরপর যা হল, তা তো ইতিহাস!
আদতে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ যে ভারতকে হারিয়ে একটা টি-২০ ম্যাচ জিতে ফেলবে এরকম আশা খুব কমই লোকই উচ্চস্বরে করেছিল। দলের প্রাণভোমরা সাকিব আল হাসান নেই । নেই দলকে প্রত্যাশিত শুরু এনে দেওয়ার আশাব্যাঞ্জক তামিম ইকবালও। দীর্ঘদিন ধরে স্লগ ওভারে আস্থার অপর নাম হয়ে ওঠা সাইফুদ্দিনও নেই। এতসব নেই এর মাঝেও ছিল জয়ের প্রবল ইচ্ছা । ফিল্ডিং-এ প্রতিটা ডাইভে ছিল মরণকামড়ের স্বরূপ । সুন্দরবনের বাঘ তেঁতে উঠলে নাকি টেরিটরির কারো আর রক্ষে থাকেনা । বাংলাদেশও কি বাঘ নয়? ভারতই বা কিভাবে রক্ষে পাবে?
তবুও নামে ভারে এই ম্যাচ আগেভাগেই জিতে নিয়েছে যেন ভারত। ভিভিএস লক্ষণ ছাড়া আর সবাই ৩-০ ও দেখে ফেলছে দেদারছে। স্টার স্পোর্টসে সাদা চামড়ার ব্রিটিশরা তো আমাদের লজ্জাটুকুও দেখে ফেলেছিল । কিন্তু আমরা দেখেছিলাম অন্যকিছুই। পুরনো শফিউলের নতুন শুরুর কথা দেশের ক্রিকেটের আকাশে বাতাসে শোনা যায় বহুদিন ধরে। গুঞ্জন যে মিথ্যা নয়, তা তো তিনি প্রথমেই দেখিয়ে দিলেন স্বপ্নের মত এক ডেলিভারিতে। প্যাভিলিওনে ফিরতে ফিরতে রোহিতের নিজেরও হয়ত ভ্যাবাচ্যাকা লাগছিল!
পুরনো শফিউল নতুন শুরু করলে আল-আমিনই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? টি-২০ ক্রিকেটে তিনি এমনিতেও ছিলেন এক আস্থার নাম । কেলেঙ্কারিতে না জড়ালে হয়ত দলে খেলে যেতে পারতেন বহুদিন। তবে ফিটনেস ঠিক করে তিনি যে আবার ফিরিয়ে দিতে এসেছেন তার কাছে দেশের সব দেনাপাওনা, সেরকম একটি বার্তা ফুটে উঠছিল তার প্রথম স্পেলের প্রত্যেকটি ডেলিভারিতে।
পাওয়ারপ্লে শেষে টিম ইন্ডিয়ার রান রেট ৬ এরও নিচে । ঠিক এরকম একটা জায়গায় আমার মনে হয়েছে ক্যাপ্টেন রিয়াদ ভারতকে খানিকটা ‘রুম’ দিয়ে ফেলেছেন। প্রত্যাশিতভাবেই এখন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান রা চার্জ করবে। তখন সৌম্য সরকারের মত পার্ট টাইমার কাজে লাগিয়ে খানিকটা নির্ভার হয়ে গেছে যেন টিম ইন্ডিয়ার শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ । ম্যাচের এটুকু সময় ছাড়া রিয়াদের অধিনায়কত্ব আমায় মুগ্ধ করেছে। মুস্তাফিজকে তিনি ব্যাবহার করতে চেয়েছেন পরিস্থিতি বুঝেই, তাতে ২ ওভারের জায়গায় ১ ওভার করালেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মুখস্থ ব্যাবহার তিনি করাননি। লেগ স্পিনারদের নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে। টিমের লেগ স্পিনাররা জ্বলে উঠেন ক্যাপ্টেনসির গুণে। সময় ও সুযোগ বুঝে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী লেগ স্পিনারদের ব্যাবহার করতে হয়। আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে রিয়াদ সেভাবেই ব্যাবহার করেছেন।
বিল্পবের কথা এটুকু বলে শেষ করলে ঠিক হবেনা মনে হয়। নেটে চাহাল-কুলদ্বীপকে খেলে পটু ইন্ডিয়ান ব্যাটিং অর্ডার বিপ্লবকে উড়িয়ে দেবে এরকমটা ভেবেছিল অনেকেই।এখনও গুগলিটাই ঠিকমত না শেখা বিপ্লব যে লেগ স্পিনের ‘এক্সাইটিং প্রসপেক্ট’ ছিল এমনও না। তবে তার বলের কন্ট্রোল এর আগে বাংলাদেশ টিমে খেলে যাওয়া অন্যসব লেগ স্পিনারদের তুলনায় যথেষ্ট ভাল। ম্যাচে ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইট ছোঁড়ার চেষ্টা করতেও দেখা গেছে বিপ্লবকে। ভেট্টরির থেকে তিনি কিছু পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছিল । সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা বিপ্লবকে বিশ্বমানের লেগ স্পিনার হতে সাহায্য করতে পারে সেটি হল তার বোলিং একশন। এত দ্রুতগতির একশানে বিভিন্ন ভ্যারিয়েশন যোগ করতে পারলে তাকে খেলা অসম্ভব হয়ে যাবে।
নাঈম শেখের কাছ থেকে দল প্রত্যাশামত পারফর্মেন্স পায়নি। আবার গড়পড়তাও বলা যাবেনা। ডেব্যুটেন্ট হিসেবে আবার এটিকে লেটার মার্ক্স ও দেওয়া যায়। পিচ স্লো ছিল, ম্যাচে নাঈমের অত্যাধিক ডট দেওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে । সাথে ওপেনার হিসবে অভিষেকের চাপ তো থাকেই। একটা মজার তথ্য দেই, বাংলাদেশের ওপেনিং-এ কারো অভিষেক হল বহুদিন পর। সৌম্য কিংবা লিটন কারোরই সোজাসুজি ওপেনার হিসেবে অভিষেক হয়নি। নাঈমের ওপর তাই চাপ বেশি ছিল, এরকম পিচে সোজা গিয়ে নতুন বল সামলাকনো চাট্টিখানি কথা নয়।
সৌম্য সরকারের ইনিংসটা সময়োপযোগী ছিল। পিচ স্লো ছিল। সোজা ব্যাটে বল আসছিল না। এরকম ধরে রেখে খেলার দরকার ছিল কারো ।সৌম্য সেরকমই খেলেছেন। লুজ বলে ছয় মেরেছেন, অহেতুক অস্থির হননি, ভাল বলকে সমীহ করে বাজে বলের জন্যে অপেক্ষা করেছেন।এরকম পিচে যা করতে হয় আরকি। তবে এত সব কিছুর মধ্যে অধারাবাহিক লিটন অধারাবাহিকই থেকে গেছেন। যে বলে তিনি ক্যাচ দিয়ে এসেছেন সেটিও আহামরি কিছু ছিল না। খুব সম্ভবত প্রাকটিস সেশনে সোজা ছোঁড়া বলে এভাবেই ফিল্ডিং প্রাকটিস করান বাংলাদেশ দলের ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক। গুরুর বিদ্যে ভারতীয় ফিল্ডারদের ওপর ফেলবেন লিটন দাস, সেটি কি কেউ চেয়েছিল?
মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান । ভারতীয়দের বিপক্ষে তার পরিসংখ্যান অতিমানবীয় । তাই এরকম একটি পারফর্ম্যান্স দল মুশির থেকে চেয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। দিল্লীর পিচে আনইভেন বাউন্স ছিল ।বল থেমে ব্যাটে আসে, হঠাৎ করে বল লাফিয়ে ওঠে। যেসব পিচে আমরা বিপিএল খেলি আরকি। এসব পিচে রান তোলার জন্যে স্লগ সুইপ, রিভার্স সুইপের ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে হয়। মুশির চেয়ে ভাল তা আর কে খেলতে পারেন? ফাইন লেগ দিয়ে বারবার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে তিনি যখন দিল্লীকে নিশ্চুপ করে যাচ্ছিলেন, দল তখন এগিয়ে যাচ্ছিল জয়ের বন্দরে, মুশির নোঙর হাতে।
ক্রিকেটে ‘ক্যাপ্টেনস ক্যামিও’ যাকে বলা হয় সেটাই করেছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। মুশির ঐ চার চারের ওভারের আগে তার রানের ব্যাবধান কমানোর প্রচেষ্টাটাও দলকে জিততে ভালভাবেই সাহায্য করেছে ।নইলে মুশির ঐ ওভারেও দলের সুবিধা খুব বেশি হত না। এরকম পিচে নেমেই এরকম বাউন্ডারি হাঁকিয়ে রানের ব্যাবধান কমানো সহজ ছিল না। কিন্তু ‘কঠিনেরেই ভালবাসিলাম’ নীতিতে বিশ্বাসী মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ কি আর এসবে ডরাবেন?
ভারতের মাটিতে ভারতকে টি-২০ ফর্ম্যাটে হারানো সবচেয়ে কঠিন ।এ,বি,সি এমনকি ভারতের ডি দলও টি-২০ ফর্ম্যাটে ভয়ংকর হবে।হারানোর সামর্থ্য রাখে যে কাউকে। ছোটবেলা থেকে মারমার কাটকাট টি-২০ দেখে ক্রিকেট শেখা ইন্ডিয়ান ‘ইয়াং ব্লাড’ দের নিয়ে গড়া যেকোন দলই অমানবিক । আর কাল তো ভিরাট কোহলি আর জসপ্রীত বুমরা ছাড়া সবাই ছিল। কুলদ্বীপ যাদবকে এই ফর্ম্যাটে নিয়মিত পছন্দ হিসেবে ধরা হয়না। স্কোয়াডের দোহাই দিয়ে তাই এ জয়কে খাটো করে দেখবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কেননা, আমাদের তো সাকিব তামিমও ছিল না।
এতসব কিছুর মধ্যে স্লগ ওভার আমাদের ভুগিয়েছে। প্রথম ইনিংসের ১৯ আর ২০ তম ওভার বাদে পুরোটা সময় চালকের আসনে ছিল বাংলাদেশ। স্লগ ওভারের বোলিং এর বেসিকটুকুও করতে পারেনি আমাদের দুই বোলার। যে লেংথে তারা বল ছুড়েছেন সেটা এই পিচের জন্যে কার্যকরী হলেও স্লগের জন্যে ছিল না। এখানে তাই আরেকটু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। ম্যাচ তাহলে এতটা কঠিন হত না।
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তা দিয়ে শেষ করব। ম্যাচের অন্তিম লগ্নে হার্শা ভোগলে বলছিলেন, ‘He has been there before and he knows the pain’ …. আসলেই মুশি জানতেন, রিয়াদের ছয়ের পরও কি অস্বাভাবিক রকম নির্লিপ্ত ছিলেন। ম্যাচশেষে যখন হেলমেট হাতে রিয়াদ-মুশি ড্রেসিংরুমে ফিরছেন প্রকৃতি তখন বোধহয় ইতিহাসের দায়মোচনের আনন্দে তৃপ্ত…… ।
- 0 মন্তব্য