• ক্রিকেট

এডি বারলো: দেশের ক্রিকেটের ভিনদেশী বন্ধু

পোস্টটি ২২৮৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ক্রিকেট ; শুধুই একটি খেলার নাম? হয়তো তাই, হয়তো নয়। ক্রিকেটটা কারো কারো কাছে নিছক বিনোদন, কারো কাছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। কারো কাছে অবসর কাটানোর মাধ্যম, আবার কারও কাছে অমৃতরসের মতোই দামী। বিশেষ করে  লাল সবুজের এই দেশে ক্রিকেটটা অন্তত খেলার থেকে একটু হলেও বেশি কিছু।

 

স্বাধীন বাংলার জন্মের আগে এদেশে ফুটবলটা ছিলো সবথেকে জনপ্রিয়। মোনেম মুন্না, শেখ আসলাম, কাজি সালাউদ্দিনদের খেলা দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুটবল প্রেমীরা এসে উপচে পড়তো স্টেডিয়ামগুলোতে। সে সময় ফুটবল এতটাই জনপ্রিয় ছিলো যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ফুটবলের মাধ্যমে করে যেতে পেরেছেন স্বাধীন এক দেশ পাবার সংগ্রাম।

 

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রকিবুল, জুয়েল বা মুশতাকদের ক্রিকেটটাকেও এদেশে পরিচিত করানোর চেষ্টা করতে থাকেন একশ্রেণীর ক্রীড়াপ্রেমী ।  ক্লাব ক্রিকেটের মাধ্যমে ক্রিকেটের যে বীজ রোপিত হয়েছিলো সেদিন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এদেশে, সেই বীজ থেকে বৃক্ষ জন্মে আজ শাখা প্রশাখা মেলেছে অনেক, স্বপ্নও হয়েছে বড়। কোটি ক্রিকেটপ্রেমীকে সাথে নিয়ে সে স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখার সময়ও এসেছে এখন।

 

এই এতোদূর হেটে চলা এমনি এমনি হয়নি।  হাটি হাটি পা পা করে এগোতে থাকা দেশের ক্রিকেটটাকে নিয়ে কোটি মস্তিষ্কের এতো বড় স্বপ্ন দেখার সাহসও একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে অগণিত মানুষের ঘাম,শ্রম,মেধা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। লাল সবুজের টাইগারদের জন্য ভালোবাসা দেয়া, শ্রম দেয়া এমনই একজন ভিনদেশী এডি বারলো (Eddie Barlow) ; যাকে নিয়েই গল্প করব আজ।

 

এডি বারলোর সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রত্যক্ষ সম্পর্কটা বছর দেড়েকের। দুর্জয়-বাশারদের প্রথম টেস্ট ম্যাচের রণপরিকল্পনাকারী। গর্ডন গ্রিনিজ বা ডেভ হোয়াটমোর মতো মহাতারকা না হলেও মহাপ্রেমিক ছিলেন বটে। তাইতো দেশের ক্রিকেট ছাড়ার প্রায় ২ দশক পরেও কীবোর্ডে কেউ একজন তার নামের ১১ টা অক্ষর বার বার টাইপ করে চলেছে।

 

বাড়ির উঠোনে বসে বেতারযোগে দল বেধে ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফির ফাইনাল ম্যাচের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে যে জয়ের খবর পেয়ে দেশজুরে আনন্দ মিছিল করেছিলো বাঙালিরা, সেই জয়ের কারিগর ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ নামের অন্য এক ভিনদেশী।  নিজের সাফল্যে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া এই কোচ বরখাস্ত হন '৯৯ এর বিশ্বকাপে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে তার ৩ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষের ঠিক আগেরদিন। তারই স্থলাভিষিক্ত হয়ে বাংলাদেশে আসেন এডি বারলো।

 

'৯৭ এর আইসিসি ট্রফি জয় আর '৯৯ এর বিশ্বকাপে ভালো পারফরমেন্সের সাথে দর্শক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশকে এনে দেন টেস্ট স্ট্যাটাস। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগ মুহূর্তে আনা হয় সাউথ আফ্রিকান এডিকে। 

 

মূলত এডি বারলো শুধু বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসেননি। এসেছিলেন বোর্ড ডিরেক্টর হিসেবে। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো নিয়ে কাজ করানোর জন্যই ১৯৯৯ এ আনা হয় তাকে।কাজও করছিলেন সেভাবেই।জাতীয় দলকে নিয়ে কাজ শুরুর আগেই তিনি হাত দেন ঘরোয়া অবকাঠামোগত দিকে।ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করেন পরবর্তী ১০ বছরের পরিকল্পনা। তার পরিকল্পনা মতেই শুরু হয় 'বাংলাদেশ জাতীয় লিগ' যা দেশের টেস্ট দলকে আরো সমৃদ্ধ করে, বাড়ায় দেশের খেলোয়ারদের টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা। তিনিই বদলে দেন দুর্জয়, বুলবুলদের মানসিকতা। শেখান কিভাবে হতে হয় আত্মপ্রত্যয়ী, কিভাবে খেলতে হয় আক্রমণাত্মক। 

 

এডি বারলোকে নিয়েই অগ্রসর হতে থাকে বাংলাদেশ তার প্রথম টেস্ট খেলার স্বপ্ন পূরণের দিকে। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ এক কালবৈশাখী এসে নামে এডির জীবনে। বাংলাদেশ ক্রিকেটটাকে অকৃত্রিম  ভালোবাসা এডির উপর পরে স্ট্রোকের ভয়াল থাবা। তার স্বাভাবিক হাটাচলার সাথে সাথেই  মুহূর্তের জন্য থেমে যায় কোটি বাঙালির স্বপ্নের প্রথম টেস্টের দিকে এগিয়ে চলা।প্রথম টেস্টে  ভারপ্রাপ্ত কোচ করা হয় সারোয়ার ইমরানকে ; তবে হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে এডি তখনো থেকে যান তার প্রিয় দলটার সাথেই।

 

অসুস্থতা নিয়েই ২০০০ সালে দল নিয়ে কেনিয়া যান ICC নক আউট টুর্নামেন্টে। সাথে সেই হুইলচেয়ার।

 

১০ নভেম্বর ২০০০।  কোটি বাঙালির স্বপ্ন যেদিন পূরণের পথে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে লেখা হবে নতুন এক ইতিহাস। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সেদিন খেলতে নামবে অভিষেক টেস্ট ম্যাচ। গাঙ্গুলী-সুনিলদের ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচ খেলতে নামার আগে হুইলচেয়ারে বসেই ম্যাচের পরিকল্পনা সাজান এডি বারলো।

 

টস জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয়া নাইমুর দুর্জয়ের দল প্রথম ইনিংসে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে করে ৪০০ রান।  যেখানে নতুন এক ইতিহাস লেখেন আমিনুল বুলবুল। ৩য় প্লেয়ার হিসেবে দেশের অভিষেক টেস্টে শতক করেন তিনি। তার শতকের পর তাকে অভিনন্দন জানাতে হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন এডি। স্ত্রীর সহায়তায় উঠে দাঁড়ানও; যেই স্মৃতিটুকু আজও বারবার বুলবুলকে মনে করিয়ে দেন এই ভিনদেশী এডি বারলোর কথা।

 

এরপর আর বেশিদিন দলের সাথে থাকা হয়নি এডির। হুইলচেয়ারকে সঙ্গী এডি পেরে উঠেননি নিজের সাথে।স্ট্রোকের পর থেকেই তার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। অসুস্থতার জন্য ২০০১ এর শুরুর দিকেই সেই দিনটা এসে যায়। বিদায় জানাতে হয়েছিলো ভালোবাসার বাংলাদেশ দলটাকে। বিদায়ের দিন কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়েছিলেন স্ত্রীর সহায়তায় নিজের পায়ের উপর ভর দিয়েই। হুইলচেয়ারটা খালি রেখেই। নিজ পায়ের উপর ভর দিয়ে সেদিন কেঁদেছিলেন এডি বারলো, কাঁদিয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে। ভালোবাসা দিয়ে, ভালোবাসার চাদর মুড়িয়ে নিয়েই বিদায় নিয়েছিলেন দেশের ক্রিকেট থেকে।

 

এই ভিনদেশী মহাপ্রেমিক জন্মেছিলেন ১৯৪০ এর ১২ই আগষ্ট। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিলো শিক্ষক হবেন। কিন্তু শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই তার কোনো এক কোচের এক কথাতেই বদলে ফেলেন জীবনের লক্ষ্য। কোচ সেদিন তাকে বলেছিলো ক্রিকেট বাদ দিয়ে অন্য কিছু খেলতে, ক্রিকেটটা তার জন্য না। 

 

জেদ নিয়ে পরে যান ব্যাট বল নিয়ে। রাইট হ্যান্ড ব্যাটসম্যান এর পাশাপাশি ছিলেন মিডিয়াম পেস বোলার। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে খেলতেই একদিন ডাক পান দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে। ১৯৬১-৬২ তে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘটে টেস্ট অভিষেক। 'Bunter' খ্যাত এই প্রোটিয়া খেলেছেন ৩০ টি আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ। ৫৭ ইনিংসে ৪৫.৭৫ গড়ে ব্যাট হাতে করেন ২৫১৬ রান। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২০১ আর অর্ধশতক ১৫ টি। ৬ টি আন্তর্জাতিক শতকের ৫ টিই করেন আবার অজিদের বিপক্ষে। ১ বার ৫ উইকেট সহ বল হাতেও ৪০ টি উইকেট আছে তার নামের পাশে।

 

ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরও সমৃদ্ধ। ২৮৩ ম্যাচ খেলে ৪৩ টি শতক আর ৮৬ টি অর্ধশতকের সাহায্যে করেন ১৮ হাজার ২১২ রান। বল হাতে নেন ৫৭১ উইকেট; সাথে ১৬ বার নেন ৫ উইকেট। লিস্ট এ ক্যাটগরির ৯৯ ম্যাচেও রান ১০ হাজার ছুঁই ছুঁই।

 

'৬১-৬২ তে অভিষিক্ত এডি বারলো ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন '৬৯-৭০ এ। বর্ণবাদ বিতর্কে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গন থেকে সে সময় নিষিদ্ধ না হলে হয়তো তিনিও হয়ে থাকতে পারতেন একজন মহাতারকা। 

 

কোচের পদ থেকে বিদায় নিয়েও ভুলে যাননি বাংলাদেশকে। ২০০৫ এর জুনে ইংল্যান্ডে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের দলের খেলা দেখেছিলেন এডি। সেই হুইলচেয়ারে বসেই বলেছিলেন টাকা জমিয়ে আরেকবার বাংলাদেশে আসবেন ঘুরতে। আর আসা হয়ে উঠেনি।সেই মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে সে বছরের ৩০ ডিসেম্বর এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ভালোবাসার সেই ভিনদেশী এডি বারলো।

 

তার বিদায়ের এতবছর পরও বাংলাদেশ ক্রিকেট আজও ছন্নছাড়া। মাঝে কিছুদিন ট্র‍্যাকে থাকলেও আবারও অনেকটা ছিটকে গেছে ট্র‍্যাক থেকে। দিন এনে দিন খাওয়া কুলি-মজুর-ফেরিওয়ালারা যে স্বপ্ন দেখেছিলো দলটিকে নিয়ে তা আজও আছে, থাকবেও। হয়তো উচ্ছ্বাসটা সবসময় একরকম হবে না। '১৯ বিশ্বকাপের আগে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে এডমিশন মিশনে নামা ছেলেটার আজ ভর্তিযুদ্ধ শেষ। তবে যুদ্ধ শেষে সেই পুরোনো ভালোবাসার কোথায় যেন একটা কমতি মনে হচ্ছে তার কাছে। সবার চোখে মুখে প্রকাশ না পেলেও বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে এখনো দরিদ্র মায়ের ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া ছেলেটাও চায় লাল সবুজের জার্সি গায়ে দেবে, তারকা চিহ্নওয়ালা জার্সি। হয়তো একদিন সে দিন সত্যিই আসবে।

 

 '৯৭ এর আইসিসি ট্রফি, '৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো, '০৭ এ ভারতকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয়া, সবশেষ দশকে ভারত,পাকিস্তান,দক্ষিণ আফ্রিকাকে টানা একদিনের ম্যাচের সিরিজে হারানো, ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট হারানো কিংবা দেশের শততম টেস্টে জয় বা আন্তর্জাতিক সহস্রতম টিটোয়েন্টিতে ভারতকে হারিয়ে যে ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন দেখিয়েছে দল,সেই স্বপ্ন গুলো একদিন এক হয়ে উড়াল দেবে আকাশসম স্বপ্ন ছুঁতে। সেদিনের আশাতেই অপেক্ষায় আছে দেশের কোটি হৃদয়। আর অসীম অনন্তকাল ব্যবধান থেকেও শহীদ জুয়েল, মুশতাক বা মাঞ্জারুল ইসলাম রানাদের সাথে এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করতে থাকবে একজন এডি বারলোর নামও।