• ক্রিকেট

দেশ বিদেশে সৌম্য সরকার

পোস্টটি ৫৫৩৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সৌম্য শান্ত সরকার, নামে আর স্বভাবে শান্ত হলেও ব্যাট হাতে বোলারদেরকে শাসন করার সময় মোটেও শান্ত থাকতে চাননা। টি২০ স্পেশালিষ্ট হিসেবেই সমর্থকরা মানে তাকে। ক্রিকেটীয় ব্যকরণের দিক থেকে যদি নাও হয়ে থাকেন তবুও সমর্থকদের ভাবনার বা চাওয়ার দিক থেকে অবশ্যই তিনি ধুমধারাক্কা – চার - ছক্কার ক্রিকেটের জন্যই আদর্শ। দলের প্রয়োজনে বলও হাতে তুলে নেন প্রায়শই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১ম বাংলাদেশী হিসেবে দ্বিশতক হাকানো এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের টেস্ট, টি২০ আর ওডিআই এর দেশের মাটি আর বিদেশের মাটির শুধু ব্যাটিং পারফরমেন্স নিয়েই “দেশ বিদেশে সৌম্য সরকার”।

 

 

ক্রিকেটের যে ফরমেটের জন্য তাকে আদর্শ মনে করা হয় সেই টি২০ এর দেশ বিদেশের পারফরমেন্স দিয়েই তবে শুরু করা যাক। ক্রিকেটের আধুনিক এই সংস্করণে সৌম্যের অভিষেকটা ২০১৫ এর বিশ্বকাপের পর পাকিস্তান সিরিজে। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ২৪ এপ্রিল ২০১৫। লাল সবুজ জার্সিতে দর্শকদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে সেদিন টি২০ ফরমেটে প্রথম মাঠে নামেন সৌম্য সরকার। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে ৫ উইকেটে ১৪১ রান করে পাকিস্তান। জবাব দিতে নামা বাংলাদেশের হয়ে ৫৯ নাম্বার জার্সি পরে প্রথমবার টি২০ তে ওপেন করতে নামেন সৌম্য। কিন্তু বিধি বাম- প্রথম টা একেবারেই ভালো হলো না। দুঃস্বপ্নের মতো শুরুটা হলো তামিম ইকবালের সাথে ভুল বোঝবুঝিতে কোনো বল না খেলেই রান আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে। পরের ম্যাচটা খেলতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল গুণে গুনে ৭১ টি দিন।

 

 

সেদিনের সেই শূন্য রানের ইনিংসটি থেকেই টি২০ ফরম্যাটের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথ চলা শুরু। এর মধ্যেই খেলে ফেলেছেন অর্ধশত ম্যাচ। তার ক্যারিয়ারের এই ৫০ টি ম্যাচের মধ্যে ২১ টি নিজ দেশে আর বাকি ২৯ টি বিদেশের মাটিতে। দেশের মাটিতে খেলা ২১ ম্যাচে ১৩১.২৯ স্ট্রাইক রেটে মোট রান করেছেন ৪০৭ আর দেশের বাইরে ৪৭৭। এওয়ে ম্যাচে স্ট্রাইক রেট ১৩৬.৯০ হলেও নিউট্রাল ভেন্যুর ১৩ ম্যাচে তার স্ট্রাইক রেট ৮৫.৬০ মাত্র। এওয়ে ম্যাচের এভারেজ হোম ম্যাচের থেকেও বেশি। এই ২ ক্ষেত্রে এভারেজ যেখানে ২৪.৭৩ আর ২১.৪২ সেখানে নিউট্রাল ভেন্যুর ম্যাচগুলোতে এভারেজ মাত্র ৮.২৩। হোম আর এওয়ে তে ভালো করলেও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে গেলে যেন জল ছেড়ে ডঙায় উঠে আসা মাছের মতোই হয়ে পরেন সৌম্য শান্ত সরকার। তবে দেশের মাটি আর বিদেশের মাটিতে বাউন্ডারি হাকানোতে তেমন তারতম্য নেই সৌম্যের, পার্থক্যটা ১ এর।

 

 

নিরপেক্ষ ভেন্যুর ওই ১৩ টি ম্যাচের মধ্যে ৬ টি ম্যাচই ২০১৬ এর টি২০ বিশ্বকাপের, ৩ টি ম্যাচ নিদাহাস ট্রফির। এই ২ টি টুর্নামেন্টের সাথে ২০১৬ এর এশিয়া কাপের পারফরমেন্সও খুব একটা মনের মতো ছিলো না সৌম্যের। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে সৌম্য সরকারের ব্যাট যতটা হাসে টুর্নামেন্টে যেন ঠিক তার উলটো। টুর্নামেন্টে সৌম্য ব্যর্থ ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও। ২০১৬ এর টি২০ ফরমেটের এশিয়া কাপে ৫ ম্যাচ খেলে ১৮.৮০ গড়ে মাত্র ৯৪ রান সৌম্যের নামের পাশে। দেশের বাইরের বাকি ২ টুর্নামেন্টের গড় ১০.৭১ আর ১০.০০। এখন অব্দি ২ টি টুর্নামেন্ট ফাইনাল খেলেছেন সৌম্য যেখানে স্কোর ১ আর ১৪। টুর্নামেন্টে সৌম্য কতটা ব্যর্থ তা এতেই অনেকটা পরিষ্কার হয়তো, বাকিটুকুর জন্য অপেক্ষা করুন ওডিআই নিয়ে আলোচনায় আসা পর্যন্ত।

 

 

বাংলাদেশের পর সবথেকে বেশি ১২টি ম্যাচ খেলেছেন সৌম্য ভারতের মাটিতে। ৯৯.৩৮ স্ট্রাইক রেটে সেখানে তার মোট সংগ্রহটা ১৬২ রানের।  টি২০ এ সৌম্যের দেশ বিদেশের পারফরমেন্সের আলাপনের ইতিটা এখানেই টেনে নিয়ে শুরু করা যাক একদিনের ক্রিকেটে তার পারফরমেন্সের আলোচনা।

 

অভিষেকটা ২০১৪ এর পহেলা ডিসেম্বর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচে তাইজুলের সাথে একই দিন অভিষিক্ত সৌম্যের শুরুটা এখানেও মনের মতো ছিলো না। ১৮ বলে ২০ রান করে ফিরতে হয়েছিলো প্যাভিলিয়নে। তবুও ওই ১ ম্যাচ খেলেই ২০১৫ বিশ্বকাপের দলে যায়গা করে নেন সৌম্য। বিশ্বকাপের পারফর্মেন্সও তেমন ভালো ছিলো না। তবে দ্রুত রান তোলার সক্ষমতার কারণে জায়গা করে নেন সমর্থকদের মনে।

 

সেদিন থেকে এ পর্যন্ত সৌম্য সরকার একদিনের ক্রিকেটে খেলেছেন ৫৫ টি ম্যাচ যার মধ্যে মাত্র ১৭ টি দেশের মাটিতে আর বাকি ৩৮ টি দেশের বাইরে। সবথেকে সফল অবশ্য দেশের মাটির ওই ১৭ ম্যাচেই। দেশের মাটির ১৭ ম্যাচে গড়টা ৫৩.৩৩। মোট রান ৭৭০। দুটি শতকের দুটিই বাংলাদেশে। প্রতিপক্ষের মাটিতে মাত্র ১ ম্যাচ কম খেলেও গড়টা প্রায় অর্ধেক আর মোট রান মাত্র ৩৭৭। নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলা ২২ ম্যাচে সবথেকে কম ২৬.৪০ গড়ে মোট রান ৫৮১। দেশের মাটিতে যেখানে বাউন্ডারির সংখ্যা ১১২ টি সেখানে এক ম্যাচ কম খেলে এওয়ে ম্যাচে সংখ্যাটা ৫০ আর ৫ ম্যাচ বেশি খেলে নিউট্রাল ভেন্যুতে সংখ্যাটা ৮০। দেশের মাটিতে যেখানে খেলেছেন ১০৭ স্ট্রাইক রেটে সেখানে এওয়ে আর নিউট্রালে স্ট্রাইক রেট ৮৯.৫৪ আর ৯৪.৩১ করে। সব দিক থেকেই বলা যায় একদিনের ক্রিকেটে দেশের মাটির সৌম্য আর বিদেশের মাটির সৌম্যে পার্থক্যটা অনেক। টি২০ এর মতো সৌম্য ব্যর্থ ৫০ ওভার ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও।

zzz1

নিজ দেশের পর সবথেকে বেশি ১২ ম্যাচ খেলেছেন ইংল্যান্ডে; সবগুলোই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ম্যাচ। যেই ১২ ম্যাচে গড় মাত্র ১৬.৬৬ আর মোট রান ২০০। টি২০ এর মতো এখানেও টুর্নামেন্টে ব্যর্থ সৌম্য সরকার। এই ফরম্যটে খেলে ফেলেছেন ২ টি বিশ্বকাপ, সাথে এশিয়া কাপ আর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও। তবে কোন টুর্নামেন্টেই সফল না সৌম্যের ব্যাট। এখন পর্যন্ত সৌম্যের খেলা ৫৫ ম্যাচের মধ্যে ২০ টি ম্যাচই এই ৩ টুর্নামেন্টের। যেই ২০ ম্যাচে সৌম্যের সংগ্রহ ৪০৮ রান যেখানে দ্বিপাক্ষিক সিরিজের ২৮ ম্যাচে রান হাজার ছুঁই ছুঁই। তবে ত্রিদেশীয় সিরিজে সৌম্য়ের গড় আর স্ট্রাইক রেট দুটোই সর্বোচ্চ।  ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ৭ ম্যাচে ৫৭.৬৬ গড় আর ১০৮.৪৬ স্ট্রাইক রেটে মোট রান ৩৪৬। বাউন্ডারি হাকানোতেও পিছিয়ে আছেন মেজর টুর্নামেন্টগুলোতে।

 

সিরিজ/টুর্নামেন্ট    -   ম্যাচ    -    গড়         -    মোট রান

দ্বিপক্ষীয় সিরিজ  -   ২৮      -    ৩৮.৯৬  -   ৯৭৪

বিশ্বকাপ              -    ১৪      -    ২৪.৩৫    -   ৩৪১

এশিয়া কাপ         -    ২        -    ১৬.৫০    -   ৩৩

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি   -    ৪        -     ৮.৫০     -    ৩৪

টুর্নামেন্ট ম্যাচে সৌম্যকে অবশ্যই আরও অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে যা এখন অন্তত পরিষ্কার। এবার শেষ আর ক্রিকেটের সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ ফরমেট টেস্ট ফরমেটে সৌম্যের দেশ বিদেশের পারফর্মেন্স নিয়ে আলোচনা করা যাক, যদিও সৌম্যকে এই ফরমেটের জন্য আদর্শ মনে করা হয়না- তবুও কিছু কীর্তি সাদা পোশাকের ক্রিকেটেও আছে সৌম্য সরকারের।

 

সাদা পোশাকের ক্রিকেটে সৌম্য সরকারের অভিষেক বাকি ২ ফরম্যাটে অভিষেকের পর। যে সিরিজে টি২০ অভিষেক হয় সৌম্যের সেবারের টেস্ট সিরিজেই তামিম ইকবালের ডবল হান্ড্রেড করা ম্যাচে দেশের টেস্ট ইতিহাসের ৭৬ তম ক্রিকেটার হিসেবে মাঠে নামেন সৌম্য সরকার। ২০১৫ এর ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সেই টেস্টের ২ ইনিংসেই ৭ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করে ২ ইনিংসেই ৩৩ রান করে আউট হন সৌম্য সরকার। ১ম ইনিংসে খেলেছেন ৫৫ বল আর ২য় ইনিংসে ৪৫।

download (14)

৩ ফরমেটে সৌম্য যেন ৩ রকম। টি২০ তে দেশ বিদেশে তার পারফর্মেন্স প্রায় সমানে সমান আবার একদিনের ক্রিকেটে দেশের মাটিতে অনেক বেশি সফল বিদেশের মাটির তুলনায়। কিন্তু টেস্টে তারও উলটো। এখানে বিদেশের মাটিতেই বেশি সফল সৌম্য- আরও বিশেষ করে বলতে গেলে নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলংকার মাটিতে। এখন পর্যন্ত মোট টেস্ট খেলেছেন মাত্র ১৫ টি, ইনিংস ২৮। দেশের মাটিতে ৮ টি ম্যাচ আর দেশের বাইরে সংখ্যাটা ৭।

 

সৌম্যের দেশের মাটিতে খেলা ৮ টি ম্যাচের পারফরমেন্স একদম সাদামাটা। ৮ ম্যাচ এ ব্যাট হাতে নামতে পেরেছেন ১৪ বার। এই ১৪ বার ২২ গজে নেমে সর্বোচ্চ ইনিংসটি মাত্র ৩৭ রানের। গড় ১৬.৭১ আর স্ট্রাইক রেট ৪৫.৬১। দেশের মাটিতে খেলা ১৪ ইনিংসের সর্বমোট সংগ্রহ যেখানে ২৩৪, সেখানে লঙ্কার মাটিতে ২ ম্যাচেই রান ১৯৫। সর্বোচ্চ ইনিংসটি ৭১ রানের। ক্যারিয়ারের ৪ ফিফটির ৩ টিই এসেছে এখান থেকে। গড় ৫০ ছুঁই ছুঁই। তার যেকোনো দেশে করা পারফরমেন্স অনেক গুণে ছাড়িয়ে গেছেন ২০১৭ আর ২০১৯ এর ২ দফায় তাসমান পারে খেলা ৩ ম্যাচে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদেরই বিপক্ষে খেলা ৩ ম্যাচেই করেছেন ক্যারিয়ারের বাকি ১ অর্ধশত আর একমাত্র শতক। ১ রানের জন্য ১৫০ এর মাইলকফলক ছুঁতে না পারা সেই ১৪৯ রানের ইনিংসটি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এ বোল্ট সাউদিদের বিরুদ্ধে। টেস্টে তার এই একমাত্র সেঞ্চুরিটি বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যান হিসেবে ২য় দ্রুততম। সর্বোচ্চ ইনিংসের দিক থেকে ওই ১৪৯ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশিদের মধ্যে ১৪ তম। ব্লাকক্যাপসদের মাটিতে ৫৩.৩৩ গড়ে প্রায় ৭৫ স্ট্রাইক রেটে সংগ্রহ ৩২০ রান। তাসমান পারে যেন নয়া বসন্ত পেয়ে বসেছিলেন সৌম্য। সবথেকে কম সফল আফ্রিকার মাটিতে ও আফ্রিকার বিপক্ষে। যে আফ্রিকার বিপক্ষে টি২০ তে সবথেকে সফল সৌম্য, সেই আফ্রিকার বিপক্ষে ১ ম্যাচ খেলে সংগ্রহ টা ১২ রানের।

 

সৌম্যের এই ছোট্ট ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত সৌম্যের যা ব্যর্থতা তার অন্যতম একটি খুব দ্রুত আউট হয়ে যাওয়া। টি২০ তে সৌম্যের আছে ৮ বার শূন্য রানে আউট হওয়ার পরিসংখ্যান, ওডিআই তে ১০ রানের কম করেই আউট হয়েছেন ১৪ বার আর টেস্টে ২০ রানের কমে আউট ১৫ বার। শুরুর দিকে মাথা ঠান্ডা রেখে শুরু করলে হয়তো সৌম্যের পরিসংখ্যান আরও অনেকটাই সমৃদ্ধ থাকতো। সামনে আরও অনেক সময় বাকি, যেতেও হবে অনেকটা পথ। শুভ কামনা রইলো সৌম্যের জন্য। একদিন সৌম্যরাই এনে দেবে এদেশের ক্রিকেটের বড় বড় সাফল্য- এমন আশা নিয়েই বসে থাকব সৌম্য সরকারের একেকটা পেরিস্কোপ দেখতে।