• ফুটবল

সি আর সেভেন : এক অতি মানবের উত্থান

পোস্টটি ৬৭৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো দ্যস সান্তোস আইভেরো রোনালদো নামটা যেকোনো পুর্তগীজ এর কাছেই আলাদা ধরনের এবং বেমানান।

আলাদা হলেই বা কি? পিতা জোসে দিনিস আভেইরো হয়তোবা তখনি ভেবে রেখেছিলেন তার এ ছেলে হবে আর দশজন সাধারন পুর্তগীজ অপেক্ষা আলাদা, সেইজন্যতো বাবা বিখ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোন্যাল্ড রেগানের সাথে মিলিয়ে রাখেন নিজের ছেলের নাম।

দিনিস আর মারিয়ার ঘর আলো করে যখন রোনালদোর জন্ম তখন তাদের মাথায় রাজ্যের চিন্তা। চার সন্তান এর খরচ তারা কিভাবে যোগাবেন? মারিয়ার রাঁধুনি আর দিনিস মালি দুজনের সামান্য আয়ে সম্ভব হচ্ছিলো না এই বড় পরিবার চালানো, বাধ্য হয়ে দিনিস মালির পাশাপাশি কাজ নিলেন স্থানীয় ক্লাব আন্দেরিনহায়। হয়তোবা ওপর থেকে বিধাতা নিজেই এই কাজটা পাইয়ে দিয়েছিলেন দিনিসকে। বাবার সুবাদেই রোনালদোর ফুটবল আঙ্গিনায় পা রাখা।

মাত্র আট বছর বয়সেই যোগ দেন আন্দেরিনহায়। মাত্র দশ বছরেই পুর্তগাল এর বড় বড় ক্লাবগুলোর নজর পরে রোনালদোর ওপরে। বেনিফিকার সাপোর্টার হলেও ভাগ্য রোনালদোকে টেনে নেয় বেনিফিকার প্রতিদ্বন্দ্বী স্পোর্টিং সিপিতে। আর সেটাই ঘুরিয়ে দেয় রোনালদোর ভাগ্যের চাকা। অভাবের সাথে লড়াই করে বেরে ওঠা রোনালদো স্পোর্টিং এ এসে তার জাত চেনানো শুরু করে। স্পোর্টিং তার অপার সম্ভাবনা বুঝেই ১৪ বছর বয়সে রোনালদোর মাকেও তার কাছে নিয়ে আসে যাতে করে রোনালদোর কোনো মানসিক চাপ না থাকে। ফুটবল ক্যারিয়ার এর কথা ভেবে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে মন দেন চৌকো মাঠটাতে। কিন্তু ফুটবল ইশ্বর যাকে রাজা বানানোর কথা ভেবে রেখেছেন তার পথ কি এতোটা মসৃণ হয়? হৃতস্পন্দন এর সমস্যায় ক্যারিয়ার শেষ এর মুখে পরেন রোনালদো। কিন্তু ইশ্বর এর পরীক্ষাতেও উৎড়ে যান তিনি। স্পোর্টিং তরুণ দল ছেড়ে মুল দলে এসেই জোড়া গোল করে রোনালদো জানান দেন যে ফুটবল বিশ্বকে তিনি শাসন করতেই তিনি এসেছেন। মাত্র ষোল বছর বয়সেই রোনালদোতে মজে যান তৎকালীন লিভারপুল ম্যানেজার জেরার্ড হুলিয়ার। কিন্তু লিভারপুল এত কম বয়সী কারো ওপর আস্থা রাখতে অস্বীকৃতি জানায়। লিভারপুল হয়তো পরে ঠিকি কপাল চাপড়েছে যখন পর বছরেই স্যার এলেক্স ফার্গসুনের জোহুরী চোখ রোনালদোকে নিয়ে আসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তখন সদ্য সাবেক হয়েছেন ডেভিড বেকহ্যাম,পারি জমিয়েছেন স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। ইউনাইটেড বেকহ্যাম এর একজন রিপ্লেসম্যান্ট খুজছিল আর তরুণ রোনালদোতে ভরসা রেখেই তার হাতে তুলে দেয়া হয় ঐতিহ্যবাহী ৭ নম্বর জার্সিটা যেটা বেকহ্যাম রেখে গেছেন। যেই জার্সিতেই এক সময়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন জর্জ বেস্ট, ব্রায়ান রবসন, এরিক ক্যান্টোনার মতো প্লেয়াররা।

রনালদো দেরি করেননি আস্থার প্রতিদান দিতে,ভেঙ্গে পরেন নি পবিত্র এ জার্সির চাপ সামলাতে। ২০০৬ এর দিকে যখন রোনালদো দ্যা ফেনোমেনন এর ক্যারীয়ার অস্তগামী তখনি আরেক রোনালদোএ উত্থান। ২০০৬-০৭ মৌসুমটাই অনেক এর মতে রোনালদোর রোনালদো হয়ে ওঠার শুরু, যদিও ইতোমধ্যে দুইটি শিরোপা জেতা হয়ে গেছে তার। এ সময়েই প্রথম বারের মতো রোনালদোর সাথে রিয়াল মাদ্রিদ এর নাম যোগ হয়। দল বদলের বাজারে তুমুল গুঞ্জন ওঠে রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদে আসছে। ততোদিনে রিয়াল এর ও সাজানো বাগানের ফুলগুলো শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু সমস্ত গুঞ্জনে পানি ঢেলে রোনালদো ইউনাইটেড এর সাথেই চুক্তি নবায়ন এর ঘোষনা দেয়। নতুন মৌসুমে যেনো আরো ক্ষুরধার হয়ে ওঠে রোনালদো। এ মৌসুমেই রোনালদো ইউনাইটেড এর হয়ে তার প্রথম হ্যাট্রিক লাভ করেন এবং ইউনাইটেড এর অধিনায়ক এর দায়িত্ব পালন করেন এবং ইউনাইটেড দীর্ঘ নয় বছর পরে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে নেয়। কিন্তু কথায় আছে রিয়াল মাদ্রিদ এর রাডারে একবার যে ধরা পরে তাকে রিয়াল এনেই ছাড়ে । দলবদল এর বাজারে আবার খবর চাউর হয় যে রোনালদো নিজেই রিয়ালে যেতে ইচ্ছুক , এ ব্যাপারে সে সময় ইউনাইটেড রিয়াল এর বিরুদ্ধে ফিফাকে জানালেও ফিফা কোনো ব্যাবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। 

নতুন মৌসুমের সুচনা মোটেই ভালো হয়নি রোনালদোর, পরেন ইনজুরিতে, তার ওপর আবার মারাত্মক দূর্ঘটনায় দুমড়ে মুচড়ে যায় সাধের ফেরারী গারিটি,যদিও অলৌকিক ভাবে অক্ষত থাকেন রোনালদো। সব মিলিয়ে ওল্ড ট্রাফোর্ড এ সুখী থাকতে পারছিলেন না রোনালদো। পরের মৌসুমেই সে সময় এর রেকর্ড ৮০ মিলিয়ন এর বিনিময়ে যোগ দেন রিয়ালে। রিয়ালে তখন ৭ নম্বর জার্সিতে মাঠ মাতাতেন রাউল আর এ কারনে সি আর সেভেন ১ম মৌসুম খেলেন ৯ নম্বর জার্সিতে। পরবর্তী মৌসুমেই রাউল ক্লাব ছাড়লে সি আর সেভেন পান তার চির পরিচিত ৭ নম্বর জার্সি। এরপর রাজার রাজ্য শাসন শুরু। রিয়ালের সমস্ত ড়েকর্ড নিজের করে নিয়েছেন, চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছেন সাথে জিতিয়েছেন দুটি করে লা লিগা, কোপা দেল রে ও স্প্যানিশ সুপার কাপ, জিতেছেন তিনিটি ইউরোপিয়ান সুপার কাপ ও তিনটি ক্লাব বিশ্বকাপ।

সমস্ত অর্জন নিজের করে নিয়ে যেই বয়সে অনেকে বুট তুল রাখে সেই বয়সে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পারি জমিয়েছেন জুভেন্টাসে। 

রোনালদোকে কেবল তার সময়েরই নয়, সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবেই মনে করা হয়।

শুধু ক্লাব ই নয় জাতীয় দলের হয়েও আছে তার অর্জন। লিজেন্ড ফিগোর ছায়ায় খেলতে শুরু করলেও পরে ছাড়িয়ে গেছেন ফিগোকেও। একক প্রচেষ্টায় দলকে জিতিয়েছেন ২০১৬ ইউরো কাপ। জাতীয় দলের হয়ে পেয়েছেন ১০০ গোলের দেখা।

রোনালদো সেই যোদ্ধা যাকে কেবল ৫ টি ব্যালন ডি ওর আর ক্লাব ও ব্যাক্তিগত অর্জন দিয়ে মাপা যায়না, রোনালদো কেবল রোনালদোই। 

FB_IMG_15999844534716646

বিবিসি স্পোর্টস এর সাংবাদিক ইয়ান হলওয়ে একবার রোনালদো সম্পর্কে বলেছিল "ছেলেটা আপনাকে অসুস্থ করে তুলবে! তার চলাফেরা, আচরণ সবকিছুই তার শ্রেষ্ঠত্বের সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে নিজেই এটার মাপকাঠি। সে একটা ছয় ফুট উচ্চতার অতিমানব, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সুদর্শন - কিছু না কিছু সমস্যা তার মাঝে থাকা উচিৎ!"

সত্যিই রোনালদো এক অতিমানব। রোনালদোর তুলনা কেবল রোনালদোই।

আজ কি বাবা দিনিস ওপর থেকে দেখছেন তার ছেলে আজ সত্যিই আর দশ পুর্তগীজ এর থেকে আলাদা? সে জন্যেই হয়তোবা রোনালদো তার প্রতিটি অর্জন এর শেষে আকাশ পানে দুহাত তুলে বাবার উদ্দ্যেশ্যেই বলেন তোমার স্বপ্ন সার্থক বাবা আজ তোমার ছেলে শুধু নামেই নয়, সব দিক দিয়েই আর দশজন থেকে আলাদা।